গত এক মাসে দেশের বন্যাকবলিত এলাকাগুলোতে পানিতে ডুবে ৪৫জন, বজ্রপাত, সাপের কামড় ও অন্যান্য কারণে মোট ৭০ জনের মৃত্যু হয়েছে৷ এখন দেশের ১৩টি জেলা বন্যাকবলিত, ১০টি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে৷
বিজ্ঞাপন
ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের খবর অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বৃহস্পতিবারের বুলেটিনে জানানো হয় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে বন্যার পানিতে ডুবে৷ এছাড়া বজ্রপাতে ১৪ জন, সাপের কামড়ে একজন এবং অন্যান্য কারণে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে৷
গত মে মাসে সিলেট অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয়, বিরতি দিয়ে আরেক দফা বন্যাও হয়৷ সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার দেখা দেয় ভয়ঙ্কর বন্যা, যাতে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জ জেলাসহ সিলেটের অধিকাংশ উপজেলা ও হাওরাঞ্চল৷ এছাড়া ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায়ও বন্যা দেখা দিয়েছে৷
দেশে এখন ১৩টি জেলা বন্যাকবলিত বলে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বৃহস্পতিবারের তথ্য৷ ১০টি নদী এখন বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছে৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, গত এক মাসে মৃতদের মধ্যে ৪৮ জন সিলেট বিভাগের, ১৮ জন ময়মনসিংহ বিভাগের এবং চারজন রংপুর বিভাগের৷
গত ১৭ মে থেকে ২১ জুন পর্যন্ত বন্যার কারণে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৪৮ জন৷ এদের মধ্যে ২ হাজার ৮৯৫ জন ভুগেছেন ডায়রিয়ায়৷ এছাড়া আরটিআইতে (শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ) ১১৮ জন, বজ্রপাতে ১৫ জন, সাপের কামড়ে ৪, পানিতে ডোবা ৪৩ জন, চর্ম রোগে ১৯৫ জন, চোখের প্রদাহে ৭৪ জন, বিভিন্নভাবে আঘাত পেয়েছেন ৬৪ এবং অন্যান্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৬৪০ জন৷
বন্যাতথ্যচেয়েছেমাউশি
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যাকবলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীদের তথ্য চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর৷ বুধবার অধিদপ্তর থেকে আঞ্চলিক পরিচালক ও উপপরিচালকদের কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়৷
চিঠিতে বলা হয়, জেলা বা উপজেলায় কতগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্য কবলিত এবং কতজন শিক্ষার্থী বন্যা কবলিত রয়েছে, তার তথ্য মনিটরিং অ্যান্ড ইভ্যালুয়েশন উইংয়ের ই মেইল থেকে জানাতে হবে৷
জেলা ও উপজেলার সব তথ্য একত্রিত করে কলেজ পর্যায়ের তথ্য আঞ্চলিক পরিচালক ও স্কুল পর্যায়ের তথ্য আঞ্চলিক উপপরিচালকের (মাধ্যমিক) ই মেইল থেকে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে৷ তবে বিচ্ছিন্ন কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা জেলা-উপজেলা থেকে পাঠানো তথ্য গ্রহণযোগ্য হবে না৷
এনএস/এসিবি (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)
পানিবন্দি সিলেট শহর
গত কয়েকদিন ধরে সিলেট শহর এবং এর আশেপাশের এলাকাগুলো পানির নীচে তলিয়ে গেছে। গত দুই দিনে বৃষ্টি কমলেও সিলেট শহরের একাধিক স্থান এখনো পানির নীচে। গতকাল সোমবার পর্যন্ত সেই অঞ্চলগুলোতে ছিল না কোনো বিদ্যুৎ সরবরাহ।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বিদ্যুৎ নেই
সিলেট শহরের কালীঘাট এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় বাসিন্দা জানান, গত চার-পাঁচ দিন যাবত বন্যার কারণে তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এতে তাদের সীমাহীন ভোগান্তি হচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ কবে নাগাদ আবার শুরু হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টদের কেউ।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
বসতবাড়ি এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে পানি
শহরের কালীঘাট, উপশহরসহ একাধিক স্থানে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে আবাসিক এলাকা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হাঁটু সমান বা কোথাও তার চেয়েও বেশি পানি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো গত রোববার পর্যন্ত বন্ধ ছিল, সোমবার থেকে পানি কিছুটা নেমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খুলতে শুরু করেছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
নদী আর সমতল মিশে একাকার
সিলেটের সুরমা নদীর পাশেই লালদিঘীরপাড় বাজার এলাকা। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, নদীর সাথে সমতলের কোনো পার্থক্য নেই। দুই জায়গারই পানির উচ্চতা এক। নদীর কাছাকাছি গিয়ে দেখা যায়, সেখানে লাল কাপড় দিয়ে নদীর সীমানা চিহ্নিত করা হয়েছে যেন কোনো ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
গবাদি পশুও সংকটে
সিলেট নগরীর ছড়ারপাড় এলাকার বাসিন্দা পেশায় ঠিকাদার মো. তপু গনি জানান, তিনি শখের বশে বসতবাড়িতে ছাগল ও ভেড়া পালেন ১০-১২টি। এবারের বন্যায় দুই ঘন্টার মধ্যে পানি কোমর পর্যন্ত হয়ে যাওয়ায় কিছু টের পাওয়ার আগেই তার চারটা ভেড়া মারা যায়। এতে তার প্রায় দুই লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি তার। বাকি ছাগলগুলো বাসার দোতলায় নির্মানাধীন একটি ঘরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
প্রতিবেশীদের আশ্রয় দিলেন বাড়ির মালিক
সিলেট শহরের কালীঘাট সংলগ্ন কামালগড়ের তিনতলা বাড়ির মালিক নজরুল ইসলাম। প্রতিবেীদের ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় তিনি তার বাড়িটি প্রতিবেশীদের জন্য ছেড়ে দিয়ে সপরিবারে ঢাকায় মেয়ের বাসায় চলে গেছেন। তার তিনতলা বাড়িতে এখন ছয়টি পরিবার বাস করছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ঘরছাড়া এক মাস
স্থানীয় বাসাবাড়িতে রান্নার কাজ করেন মাছিতপুর এলাকার বাসিন্দা জয়ফুন্নেসা বেগম। তিনি জানান, গত মাসে যখন বন্যা হলো, তখন থেকেই তার ঘরের ছাদ সমান পানি উঠেছে। প্রায় এক মাস যাবত তার ঘরে পানি। আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী এক চারতলা বাসায়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মৃতদেহ বহনে সমস্যা
সিলেট শহরের কামালগড়ের বাসিন্দা ৮০ বছরের হায়াত আলী বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন সোমবার। মরদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কুষ্টিয়ার গ্রামের বাড়িতে । শহরে বুক সমান পানি থাকায় মৃতের বাসা পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স যেতে না পারেনি৷ তাই প্রধান সড়ক পর্যন্ত কাঁধে করে লাশ নিয়ে আসতে হয়।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে চলছে
সিলেট শহরের তালতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) অফিসে হাঁটু সমান পানি। দুদিন আগে সেখানে কোমর সমান পানি থাকলেও গতকাল থেকে পানি নামছে। এদিকে চার দিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকায় কখনো জেনারেটর আবার কখনো প্রায় অন্ধকারেই সাধারণ মানুষকে সেবা দিতে হচ্ছে বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
খাবার পানির সংকট
সিলেটের তালতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মন্নুজান বেগম নামের একজন কলস নিয়ে পানি আনতে যাচ্ছেন স্থানীয় সরকারি পানির পাম্পে। তিনি জানান, যে বস্তিতে থাকেন, সেখানকার টিউবওয়েল বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তাই প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে এসে তাকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পানিতে বিকল যানবাহন
সিলেটের তালতলা, কালীঘাটসহ পানিতে ডুবে থাকা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, যানবাহনে পানি ঢুকে যাওয়ায় সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ছে। অনেকে পানির গভীরতা অনুমান করতে না পেরে বেশি পানিতে গিয়ে বিকল বাহন নিয়ে বিপদে পড়ছেন।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
শহর পানিতে থৈ থৈ
উপশহর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে রাস্তায় হাঁটু সমান পানি। দুইদিন পানির উচ্চতা কোমর সমান ছিল বলে জানান স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। এইসব রাস্তায় এত পানি গত ২২ বছরে কখনো দেখেননি বলে জানান আড়ত ব্যবসায়ী আলী আহাম্মদ।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পোষা প্রাণী নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে
আব্দুল জব্বার পেশায় নিরাপত্তাকর্মী, থাকেন উপশহর এলাকায়। এবারের বন্যায় তার বসতবাড়িতে কোমর সমান পানি হওয়ায় তিনি একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের দুইতলায় আশ্রয় নিয়েছেন। নীচে যেহেতু সব জায়গায় পানি, তাই সাথে নিয়ে এসেছেন তার পোষা কুকুরটিকেও।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
ভেলা বানিয়ে চলাচল
সিলেটের তালতলা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে খাল এবং রাস্তার পানির উচ্চতা এক। স্থানীয় শিশু -কিশোরেরা কলাগাছের ভেলা এবং ককশিট দিয়ে তৈরি নৌকা দিয়ে খেলার ছলে রাস্তা পার হচ্ছে। তবে এতে দুই-তিনজনের বেশি চড়া যাচ্ছে না বলে জানায় আশরাফ ও মেহেদি নামের এই দুই শিশু।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সড়কে মাছের আশায় জাল ফেলা
শহরের তালতলা এলাকায় খালের পানি স্বাভাবিক উচ্চতার চেয়ে প্রায় পাঁচ-ছয় ফুট উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে রাস্তায়ও পানি হাঁটু সমান। সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরতে এসেছেন আবু জাফর নামের এক জেলে। তিনি জানান, বড় মাছ না পাওয়া গেলেও যদি সামান্য কিছু ছোট মাছ পাওয়া যায় সে আশায় গতকাল এবং আজ জাল ফেলেছন তিনি। তবে এখনো কোনো মাছ পাননি।
ছবি: Mortuza Rashed/DW
পানি কমছে
গত দুই দিন ধরে সিলেট শহরে বৃষ্টিপাত কিছুটা কম হওয়ায় বিভিন্ন এলাকার পানি ধীরে ধীরে কমছে৷ হুট করে যেভাবে পানি বেড়ে গিয়েছিল, সেভাবে কমছে না। কারণ জানতে চাইলে একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, পানি নামার মতো জলাশয় নেই, যা টুকটাক ছিল, মানুষ ভরাট করে ফেলেছে। এই বন্যার পানি নামতে কমপক্ষে আরো পাঁচ-ছয় দিন লাগবে বলেও ধারণা করছেন তারা।