1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশ: অন্তর্বর্তী আমলেও থেমে নেই বিচারবহির্ভূত হত্যা

৪ নভেম্বর ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের ১৪ মাসের দায়িত্বকালে বাংলাদেশে ৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন- অধিকার।

BdTD | Bangladesch Dhaka | Protest gegen "Crossfire" Tötungen
প্রতীকী ফটোছবি: picture-alliance/ZUMA Wire/M. Rakibul Hasan

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা মঙ্গলবার বলেছেন, "নিরাপত্তা বাহিনী বা যে কোনো বাহিনী বা যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড হোক না কেন, প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে আইনের মাধ্যমে ফয়সালা করা হবে।” কিন্তু মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সরকার যাই বলুক না কেন পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। বরং পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কা তাদের।

অধিকার বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে ৩১ অক্টোবর।  প্রতিবেদনে দেয়া পরিসংখ্যান অনুসারে এক মাসে সবচেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে- ৯টি। গত তিন মাসে এমন হত্যার ঘটনা ঘটেছে ১১টি।

অধিকার এই হিসাব করেছে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে, অর্থাৎ ২০২৪ সালের ৯ আগস্ট থেকে। তার চার দিন আগে ৫ আগস্ট আগেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ নানা ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সরব ছিল অধিকারসহ দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংগঠনগুলো।

অধিকারের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২৪ সালের আগস্টে দেশে কোনো বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এর পরের মাস থেকেই প্রতি মাসে এমন ঘটনা ঘটেছে। সেপ্টেম্বরে ৯ জন, অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে একজন করে নিহত হন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নিহত হন পাঁচজন, ফেব্রুয়ারি তিনজন। মার্চ ও এপ্রিল মাসে একজন করে মোট দুইজন নিহত হন। মে, জুন, জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন যথাক্রমে চার, তিন, ছয়, তিন ও দুই জন।

মব সন্ত্রাসের মাধ্যমেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে: নূর খান

This browser does not support the audio element.

এই ৪০ জনের মধ্যে ১৯ জন মারা গেছেন গুলিতে, ১৪ জন মারা গেছেন নির্যাতনে, পিটিয়ে মারা হয়েছে সাত জনকে।

২০২৫ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে ১১ জন নিহত হয়েছেন, তার তিনটি ঘটনার জন্য পুলিশ, একটি ঘটনার জন্য সেনাসদস্য এবং সাতটি ঘটনার জন্য যৌথ বাহিনীকে দায়ী করেছে অধিকার।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্য ঘটনাও চলছে

অধিকারের পরিসংখ্যান অনুসারে ১৪ মাসে মব সন্ত্রাসের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন ১৫৩ জন। এই ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে- ১৮টি। এক বছর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে এমন ঘটনা ঘটেছিল ১৭টি। সবশেষ তিন মাসে এমন ঘটনার সংখ্যা ৪৫টি।

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে সাত হাজার ৯৭৯টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে চলতি বছরের মার্চে- ৯৪৪টি। ৮৬২টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। গত বছরের ৯ থেকে ৩১ আগস্ট আগস্টে এই সংখ্যা ছিলো ৫০০। ৭৯৮টি ঘটনা ঘটে চলতি বছরের এপ্রিলে। গত জুন, জুলাই ও আগস্টে যথাক্রমে ৪৮৯, ৫৭৯ ও ৬৫৮টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ঘটে। গত সেপ্টেম্বরে ৩০০। ১৪ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হন ২৮১ জন। সবচেয়ে বেশি  নিহত হন চলতি বছরের মার্চে ৪৪ জন। এরপর এক মাসে বেশি নিহত হন গত বছরের আগস্টের ২৩ দিনে। মোট ৩৩ জন। 

অধিকারের হিসাবে এই সময়ে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ২৪২টি ঘটনা ঘটে। সবচেয়ে বেশি ঘটেছে গত সেপ্টেম্বরে- ৩৪টি। এ ছাড়া গত মার্চ মাসে ৩০টি, মে মাসে ২৮টি, আগস্টে ২৬টি, ফেব্রুয়ারিতে ২৫টি।

বিচারহীনতা ও দায় এড়ানোর সংস্কৃতি

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগ পর্যন্ত মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রধান ছিলেন আদিলুর রহমান খান। বিচারবহির্ভূত হত্যা ইস্যুতে মন্তব্য জানতে কয়েকবার ফোন করা হলেও সাড়া দেননি আদিলুর রহমান খান। অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলানও তাদের প্রতিবেদন নিয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

মঙ্গলবার সচিবালয়ে আইন-শৃঙ্খলা সংক্রান্ত কমিটির বৈঠক শেষে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, "নিরাপত্তা বাহিনী বা যে কোনো বাহিনী বা যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ড হোক না কেন, প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে আইনের মাধ্যমে ফয়সালা করা হবে।”

তবে এখন পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে ঠিক কী করেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

৩১ জানুয়ারি কুমিল্লায় যৌথবাহিনীর হেফাজতে যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম নিহত হওয়ার পর এ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়।। আগের রাতেই তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল যৌথবাহিনীর একটি টহল দল। পরদিন গোমতি নদীর তীর থেকে তাকে উদ্ধার হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখে সেনা ক্যাম্প কমান্ডারকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

নিহত তৌহিদুলের ভাই আবুল কালাম আজাদ বলেন, "তখন বিচারের কথা বলা হয়েছে। জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। আমাদের মামলাও করতে দেয়া হয়নি। পুলিশ একটা এজাহার লিখেছে, তাতে আমাদের সই নিয়েছে। আমাদের কোনো কথা শোনা হয়নি। কাউকে আসামিও করতে দেয়া হয়নি।”

তিনি বলেন, "হত্যাকাণ্ডে সেনাসদস্যরা জড়িত। আমাদের কয়েকদিন ক্যান্টমেন্টে ডেকে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে তাদের আইনের আওতায়  আনা হবে। কিন্তু কিছুই করা হয়নি। আর স্থানীয় বিএনপি নেতারা আমাদের চাপ দিয়েছে। হুমকি দিয়েছে। তারা আমাদের চুপ থাকতে বলেছে।”

আমাদের কোনো কথা শোনা হয়নি, কাউকে আসামিও করতে দেয়া হয়নি: আবুল কালাম আজাদ

This browser does not support the audio element.

আজাদের কথা ফুটে ওঠে অসহায়ত্ব, "আমরা তো আর তাদের সাথে পারবো না। তারা তো ক্ষমতাশালী। বিচার তো আর হবে না। বিচার না পেলে আমরা আর কী করবো?”

বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে  ডয়চে ভেলের পক্ষ থেকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর- আইএসপিআর এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে সংস্থাটি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বলেছেন- কারা প্রতিবেদন দিয়েছে, কী প্রতিবেদন দিয়েছে তা আমাদের জানা নেই।

পুলিশ সদর দপ্তরও এ বিষয়ে 'খোঁজ খবর নিয়ে পরে মন্তব্য করা হবে' বলে জানিয়েছে ডয়চে ভেলেকে।

প্রধান উপদেষ্টার জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ এ নিয়ে ডিডাব্লিউ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কেবল অধিকারের প্রতিদেন ইস্যুতে নয়, বরং অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময় ও মৃত্যুর যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত চলছে।

তিনি বলেন, "কোনোটির তদন্ত শেষ হয়েছে। কোনোটির তদন্ত শেষ হওয়ার পথে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা অতীতে যেটা দেখেছি সেটা হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।”

"বন্দুকযুদ্ধ, ক্রসফায়ার, কাউন্টার অ্যাটাক বলে ফ্যাসিবাদি সরকারের সময়ে ন্যারেটিভ দাঁড় করানো হয়েছিলো।  মিথ্যা তথ্য দিয়ে এমন একটি অবস্থা তৈরি করা হয়েছিলো তখন, যে এখন প্রকৃত ঘটনাগুলোও সন্দেহের চোখে  দেখে মানুষ। কিন্তু কখনো কখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তো প্রকৃত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাও ঘটতে পারে। যে যাই হোক, সরকার সব বিষয়ই নজরে রাখছে। সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় যা করার সব করবে।”

'পরিমাণ কমেছে, পদ্ধতি বদলেছে'

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত এক হাজার ৯২৬ জন। খোদ পুলিশের বিশেষ শাখা- এসবি এই তথ্য জানিয়েছে। পরিমাণগত ও পদ্ধতিগত দিক দিয়ে পরিবর্তন কিছু হলেও বিচারবহির্ভূত হত্যা থামছে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা গুম কমিশনের সদস্য মানবাধিকার কর্মী নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "সরকার এগুলো পাশ কাটিয়ে যেতে পারেনা। এখন পর্যন্ত কোনো ঘটনায় কাউকে আইনের আওতায় আনা বা তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে বলে আমার জানা নাই। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে।  আমরা গত সরকারের আমলে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছি, বিচার চেয়েছি। কিন্তু পরিস্থিতি এখনো একইরকম আছে। এটা তো চলতে পারে না।”

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "আসলে আগের সরকারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা যে ভাষ্য প্রচার করতেন, এখানো একই ধরনের ভাষ্য প্রচার করা হয়। এটা খুবই দু:খজনক। গোপালগঞ্জের ঘটনার পর একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন হয়। তারা নাকি প্রতিবেদনও দিয়েছে। কিন্তু কী প্রতিবেদন দিয়েছে, কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা আমরা জানি না।”

বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমরা অতীতে যেটা দেখেছি সেটা হওয়ার কোনো সুযোগ নাই: ফয়েজ আহম্মদ

This browser does not support the audio element.

"শুধু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নয়, মব সন্ত্রাসের মাধ্যমেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে,” বলেন এই মানবাধিকার কর্মী।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, "এখনো বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে খবর আমরা পাচ্ছি, তা খুবই দু:খজনক। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এটা তো আমরা আশা করিনি। সরকার এর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। নিলে তো এইসব হত্যাকাণ্ড ঘটতো না।”

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দেড় বছরেও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে সক্রিয় না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কাজী রিয়াজুল হক।তিনি বলেন, " সরকার জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কোনো চেয়ারম্যান নিয়োগ করেনি, কিন্তু জাতিসংঘকে মানবাধিকারের অফিস খুলতে দিয়েছে। এটা বৈপরীত্য। সরকারের উচিত ছিলো এই সময়ে  জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে পুনর্গঠন ও সক্রিয় করা। তবে কয়েকটি আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যা ভালো। যেমন এখন পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করতে পারবে কমিশন, এবং কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী সরকার ব্যবস্থা নেবে। আগে কমিশন এটা পারতো না। তবে আইন করলেই হবে না। বাস্তবে প্রয়োগ করতে হবে।”

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ