1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
বিচার ব্যবস্থা

বাংলাদেশে বিচার পাওয়ার যত হিসাব-নিকাশ

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
১৭ ডিসেম্বর ২০২১

বাংলাদেশে বিচার বা প্রতিকার যেন সবলের জন্য, দুর্বলের জন্য নয়৷ আবার সবল ও দুর্বলের মধ্যেও আপেক্ষিকতা ও শ্রেণিভেদ রয়েছে৷ যদিও সংবিধানে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে৷

বাংলাদেশে বিচার বা প্রতিকার যেন সবলের জন্য, দুর্বলের জন্য নয়৷ আবার সবল ও দুর্বলের মধ্যেও আপেক্ষিকতা ও শ্রেণিভেদ রয়েছে৷ যদিও সংবিধানে বিচার পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW

সবশেষ যে উদাহরণটি সামনে এসেছে তা হলো পুলিশ সার্জেন্ট মহুয়া হাজং-এর বাবা বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার মনোরঞ্জন হাজংকে গাড়ি চাপা দেয়ার মামলা নিতে ঢাকার বনানী থানার গড়িমসি৷ সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর বৃহস্পতিবার রাতে ১২ দিন পর অবশ্য মামলা নেয়া হয়েছে৷ কিন্তু আসামিরা অজ্ঞাত৷

ওই ঘটনায় পুলিশ ঘটনার পরপরই গাড়িসহ দায়ীদের আটক করেছিল৷ কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের ছেড়ে দেয়া হয়৷ তাদের নাম ঠিকানা সব থাকলেও মহুয়া হাজং-এর এজাহারে তার উল্লেখ নেই৷ আসামিরা এখন অজ্ঞাত হয়ে গেছেন৷ শেষ পর্যন্ত মহুয়া মামলা করতে পারলেও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে৷

মহুয়া হাজং পুলিশের সদস্য হলেও তার চেয়ে অধিক ক্ষমতার ব্যক্তির কাছে তিনি আপেক্ষিকভাবে দুর্বল৷ মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, ‘‘আমরা জেনেছি ওই ঘটনার জন্য একজন বিচারপতির ছেলে দায়ী৷ পুলিশ ক্ষমতাবান হলেও বিচারপতি আরো ক্ষমতাবান৷ ফলে এখানে মহুয়া হাজং অধিকতর ক্ষমতার কাছে দুর্বল৷ ক্ষমতা এবং দুর্বলতা একটা আপেক্ষিক বিষয়৷ তবে ক্ষমতা থাকতে হবে- সেটা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, আর্থিক, জেন্ডার বা ধর্মের- যাই হোক না কেন৷''

এই সব কিছুর মূলে রয়েছে বিচারহীনতা, রাষ্ট্র নাগরিকদের দায়িত্ব নেয় না: নূর খান

This browser does not support the audio element.

সবল আর দুর্বলের প্রতিকার বা বিচার সম্পর্কিত কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক:

  • মুক্তিযোদ্ধার জমি দখল করে ১০ তলা ভবন নির্মাণ

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান৷ কিন্তু এই শ্রেষ্ঠ সন্তানরা কতটা বিচার বা প্রতিকার পাবেন তা নির্ভর করছে তার সামাজিক, আর্থিক বা অন্য ধরনের সক্ষমতা কতটা, তার উপর৷ মুক্তিযোদ্ধা ডা. সিদ্দিকুর রহমানের মোহাম্মদপুরের বাড়ি দখল করে সেখানে ১০ তলা ভবন নির্মাণের অভিযোগ উঠেছে একজন ট্রাফিক ইন্সপেক্টরের বিরুদ্ধে৷ ওই ট্রাফিক ইন্সপেক্টর ২০১৪ সালে রাতের আঁধারে লোকজন নিয়ে বাড়িটি দখল করে নেন৷ এরপর সেখানে একটি ১০ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন৷

মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান দুদক, রাজউক এবং পুলিশ সদর দপ্তরে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাননি৷ পরে তিনি দেওয়ানি আদালতে মামলা করেন৷ কিন্তু মামলা চলাকালেই প্রভাব খাটিয়ে নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাওয়া হয়৷

  • এজাহারে সংখ্যালঘু শব্দ থাকায় মামলা নেয়নি থানা

২০১৪ সালের আগস্টে গাইবান্ধা সদর উপজেলার গিদারী ইউনিয়ন কাউন্সিল বাজারে সংখ্যালঘু রবিদাস ও তার পরিবারের সদস্যদের মারপিট করে জোরপূর্বক ভিটেমাটি দখল করে প্রভাবশালীরা৷ কিন্তু থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে এজাহারে ‘সংখ্যালঘু' শব্দ উল্লেখ থাকায় রবিদাসের মামলা নেয়নি পুলিশ৷ তারা হারান তাদের জন্মভিটা৷

  • ধর্ষণের মামলা না নিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে

২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল বগুড়ার মুরইল বাজার থেকে অটোরিকশা যোগে যাওয়ার সময় চালক অটোরিকশা থামিয়ে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে৷ ধর্ষণের শিকার ওই নারী পরে নিজে থানায় গিয়ে চালক নাজমুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা দিতে গেলে বগুড়া সদর থানার ওসি তাকে থানায় বসিয়ে রাখেন৷ সারারাত তাকে সালিশের নামে থানায় বসিয়ে রাখা হয়৷ তারপর প্রভাবশালীদের সাথে পরামর্শ করে নানা অজুহাতে মামলা না নিয়ে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়৷

  • শিশু ওবায়দুর রহমান হত্যা মামলার আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে

২০১৮ সালের অক্টোবরে মাদারীপুরের শিবচরে ওবায়দুর রহমান (১০) নামে এক শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়৷ মামলা হওয়ার পর কয়েকজন আসামিকে শিবচর পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও তারা বিত্তশালী হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই জামিনে ছাড়া পান৷ তারপর মামলার চার্জশিট দেয়া হলেও আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন৷ উলটো শিশুটির বাবা রতন চোখদারকে আসামিরা হুমকি দিচ্ছে৷ তিনি বিত্তশালী না হওয়ায় কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না৷

  • মুরাদ বনাম আলাল

পদত্যাগী তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় ডিজিটাল আইনে মামলার আবেদন হলেও তা এখনও গ্রহণ করা হয়নি৷ কয়েকটি খারিজও করে দেয়া হয়েছে৷ কিন্তু একই ধরনের অপরাধে বিএনপি নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা গ্রহণ করা হয়েছে৷

নারী দুর্বল বলেই থানা মামলা নেয় না: অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান

This browser does not support the audio element.

‘মাৎস্যন্যায়ের মতো’

ঘটনাগুলোর বিশ্লেষণে দেখা যায় যারা দুর্বল তারা প্রতিকার পান না৷ যারা সবল তারা আইনকে উপেক্ষা করতে পারেন৷ সবল ও দুর্বল বিষয়টিও নানাভাবে বিবেচনা করা যায়৷ যেমন রাজনীতি, অর্থ, ধর্ম, জেন্ডার এবং সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি৷ আবার এটাও আপেক্ষিক৷

সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান দুলু বলেন, ‘‘এটা মাৎস্যন্যায়ের মতো৷ ছোট মাছ বড় মাছকে গিলে খায়৷ এটা এখন পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার একটি সিস্টেমে পরিণত হয়েছে৷ আর বড়কে রক্ষার জন্য আইনের নানা মারপ্যাঁচ ব্যবহার করা হয়৷ সহজ করে বলা যায়, যে যত দুর্বল তার বিচার পাওয়ার আশা তত ক্ষীণ৷ আর এই ক্ষেত্রে নারী, শিশু, মুক্তিযোদ্ধা, সংখ্যালঘু এই ধরনের কোনো পরিচয়ই কাজে আসেনা৷ বিবেচনা একটাই কে কত প্রভাশালী৷''

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘সংবিধানে সব নাগরিকের আইনের আশ্রয় পাওয়ার সমান অধিকার আছে৷ কিন্তু সেটা হয় না৷ প্রভাবই আসল কথা৷ এই প্রভাব হতে পারে রাজনৈতিক অথবা আর্থিক৷ নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুরা এমনিতেই দুর্বল তারপর যদি তাদের অর্থ বা রাজনৈতিক ক্ষমতা না থাকে তাহলে দুর্বলতা আরো বেড়ে যায়৷'' তার কথা, নারী দুর্বল বলেই থানা মামলা নেয় না৷ ৯৫ ভাগ মামলাই আদালতে করতে হয়৷

ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচার না পাওয়াকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষমতা হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা৷ ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা তাদের সংখ্যার প্রভাব ব্যবহার করেন৷ আর রাজনৈতিক প্রভাব সবসময়ই ক্ষমতাসীনদের৷ কিন্তু ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের মধ্যেও আবার ক্ষমতার বড় ছোট আছে৷ এখানে অপরাধী বড় নেতা হলে তার অপরাধের শিকার ছোট নেতা বিচার পান না৷

সংখ্যালঘু প্রভাবশালী হলেও সংখ্যাগুরুদের কাছে মানসিকভাবে দুর্বল: রানা দাশগুপ্ত

This browser does not support the audio element.

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তের ব্যাখ্যা হলো, ‘‘সংখ্যালঘুদের মধ্যে ধনি, গরিব, প্রভাবশালী আছেন৷ কিন্তু সংখ্যাগুরুদের কাছে তারা মানসিকভাবে দুর্বল৷ আর সংখ্যাগুরুরা মনে করেন দেশটা তাদের৷ সংখ্যাগুরু যদি ক্ষমতাসীন দলের হন তাহলে তো কথাই নেই৷ যদি ক্ষমতার বাইরে হন তাহলেও তার সাম্প্রদায়িক শক্তি আছে৷ আর এই ক্ষমতা পুলিশও জানে৷ তাই মামলা নিলেও আসামি গ্রেপ্তার হয় না৷ এজাহার পালটে দেয়া হয়৷ বিচারের সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না৷''

সাবেক বিচারক আজিজুর রহমান বলেন, ‘‘পুলিশ রেগুলেশনে বলা আছে মামলা সত্য হোক, মিথ্যা হোক থানাকে তা নিতেই হবে৷ কিন্তু থানা আইনকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতা ও প্রভাব বিবেচনা করে৷ এজন্য তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রভাবশালীর পক্ষে অবস্থান নেন৷ অর্থের প্রভাবতো অর্থ গ্রহণ করেই বোঝা যায়৷ বিচার ব্যবস্থায়ও এই নানামুখী প্রভাব কার্যকর৷''

অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘থানাকেই মামলা নিতে হবে৷ এটাই আইন৷ কিন্তু থানা পাশ কাটিয়ে আদালতে পাঠায়৷ এটা প্রভাশালীদের সুবিধা করে দেয়ার জন্যই৷ যেসব ঘটনা নিয়ে হইচই হয়, সংবাদমাধ্যমে শক্ত প্রতিবেদন হয়, দেশের মানুষ প্রতিবাদ করে সেসব ঘটনায় হয়তো মামলা হয়৷ আসামি গ্রেপ্তার হয়৷ কিন্তু সর্বশেষ বিচারে কী হয় তার খবর অনেকেই রাখেন না৷''

মানবাধিকার কর্মী নূর খান মনে করেন, ‘‘এই সব কিছুর মূলে রয়েছে বিচারহীনতা৷ রাষ্ট্র নাগরিকদের দায়িত্ব নেয় না৷ সংবিধানে যা আছে তা সেখানেই থেকে যায়৷ রাজনৈতিক দলগুলো ভোট আর ক্ষমতার হিসাব করে৷''

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, গৃহকর্মী হত্যায় মামলা হয় না, আবার প্রভাবশালী কেউ মামলা করার আগেই আসামি গ্রেপ্তার হয় যদি আসামি দুর্বল হয়৷ একই আইনের দুই রকমম ফল৷ তার কথা, ‘‘এখন আইন বিচার সব কিছুই ক্ষমতাবান ও বিত্তবানদের জন্য৷''

ইশরাত হাসান বলেন, ‘‘থানায় মামলা না নেয়াও একটা দণ্ডযোগ্য অপরাধ৷ এর শাস্তি তিন বছরের কারাদণ্ড৷ কিন্তু আদালতগুলো এই দণ্ড কাউকে দিয়েছে বলে আমার জানা নেই৷ এখানেও প্রভাবের বিষয় আছে৷ পুলিশের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে আদালত হয়ত সক্ষম নয়৷ আদালত এখানে পুলিশের তুলনায় দুর্বল৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ