1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে বিদেশি কোচ : একপেশে নির্ভরতা, শঙ্কাময় ভবিষ্যৎ

দেবব্রত মুখোপাধ্যায় ঢাকা
১ অক্টোবর ২০২১

বাংলাদেশে প্রায় সব খেলাতেই এখন বিদেশি কোচের ছড়াছড়ি৷ কিন্তু স্থানীয় কোচ তৈরি না করে, তৈরিদের সুযোগ না দিয়ে দেশের বাইরে সাফল্য পাওয়া কি সম্ভব?

Bangladesch | Fußballtrainer und Spieler
ছবি: Mosharaf Hossain

ইতালিকে একসময় বলা হতো বিদেশি ফুটবলারদের স্বর্গ৷ সারা পৃথিবীর সেরা ফুটবলারদের প্রথম গন্তব্য ছিলো তখন ইতালি৷

বাংলাদশ কোনো খেলাতেই বিদেশি খেলোয়াড়দের সেই গন্তব্যে পরিণত হতে পারেনি৷ তবে এই দেশেও খেলাধুলা হয়ে উঠেছে বিদেশি কোচদের এক চারণভূমি৷ বিশ্বের নামকরা কোচ থেকে শুরু করে একেবারেই আনাড়ি কোচ; বিদেশি হলেই বাংলাদেশে বড় বড় পদে বসে পড়ার নজির আছে৷ দেশের শীর্ষস্থানীয় খেলা থেকে শুরু করে একেবারেই ‘অনুল্লেখযোগ্য' খেলাতেও দলের দায়িত্ব সঁপে দেওয়া হয় ভিনদেশি কারো হাতে৷

কিন্তু আসলে এই ঝাঁকে ঝাঁকে বিদেশি কোচ এনে খেলাধুলার উপকার কতটা হচ্ছে? এই বিদেশি কোচদের বিকল্প কি আসলেই দেশে নেই? দেশি কোচ তৈরির কোনো চেষ্টাও কি আছে?

বাংলাদেশের অনেক কোচ ও খেলোয়াড়ই মনে করেন বাংলাদেশের খেলাধুলায় বিদেশি কোচের দরকার আছে৷ কিন্তু সেই কোচদের কাছ থেকে গ্রহণ করে উপকৃত হওয়ার প্রস্তুতি বাংলাদেশের ফেডারেশনগুলোর নেই৷

‘খেলোয়াড়দের যারা শক্তিশালী করে তৈরি করবেন, সেই স্থানীয় কোচদের পেছনে আমরা বিনিয়োগ করছি না’

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিদেশি কোচ-নির্ভর খেলা নিশ্চয়ই ক্রিকেট৷ এই খেলাটির শুরুর দিকে দেশি কোচরা কখনো কখনো জাতীয় দলের দায়িত্ব পালন করেছেন৷ কিন্তু নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেট ‘গুরুত্বপূর্ণ' খেলা হয়ে ওঠার পর থেকে জাতীয় দলে সিংহভাগ সময় বিদেশি কোচই ছিলেন৷ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ জাতীয় দলে কখনোই কোনো দেশি কোচ পূর্ণকালীন দায়িত্ব পাননি৷

দু'জন দেশি কোচ এই সময়ে ‘ভারপ্রাপ্ত' হিসেবে কাজ করেছেন- সারওয়ার ইমরান ও খালেদ মাহমুদ সুজন৷ এছাড়া সবসময়ই এই দায়িত্বে ছিলেন ভিনদেশি কেউ৷ এছাড়া বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাকাডেমি, হাই পারফরম্যান্স ইউনিটেরও প্রধান কোচ হিসেবে বিদেশিরা দায়িত্ব পালন করে থাকেন৷

দেশের অন্যতম অভিজ্ঞ কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম বিদেশি কোচদের সাথে বিভিন্ন সময় কাজ করেছেন৷ ফলে তাদের কাছ থেকে দেখেছেন৷ তিনি মনে করেন, বিদেশি কোচরা দেশের ক্রিকেটকে সার্বিকভাবে এগিয়ে নিতে পারছেন না৷ সেটা তিনি আশাও করেন না৷ কারণ, তাদের কাছ থেকে গ্রহণ করার প্রস্তুতিই নেই আমাদের৷

নাজমুল আবেদিন ফাহিম এই প্রসঙ্গে বলছিলেন, ‘‘বিদেশি কোচরা আমাদের খেলাধুলার অনেক পরিবর্তন করে ফেলতে পারছেন, তা আমি মনে করি না৷ এটা তাদের দোষ নয়৷ আসলে আপনি যদি কোচের হাতে পাঁচ হর্স পাওয়ার শক্তির খেলোয়াড় দেন; তিনি দশ হর্স পাওয়ারের পারফরম্যান্স দিতে পারবেন না৷ আমরা তো খেলোয়াড়দের দশ হর্স পাওয়ারের মতো করে তৈরি করছি না৷ কারণ, তাদের যারা শক্তিশালী করে তৈরি করবেন, সেই স্থানীয় কোচদের পেছনে আমরা বিনিয়োগ করছি না৷''

ফাহিম মনে করেন, জাতীয় পর্যায়ে দেশি বা বিদেশি যে কোনো কোচের কাছ থেকে সেরাটা পেতে হলে খেলোয়াড়দের আগে থেকে প্রস্তুতিটা খুব ভালো করতে হবে৷ আর সেটা করতে হলে স্থানীয় কোচদের মান বাড়াতে আরো অনেক বিনিয়োগ করতে হবে৷ তিনি মনে করেন, এই বিনিয়োগের অভাবে অনেক সম্ভাবনাময় ক্রিকেটমস্তিষ্ক কোচিং পেশায় আসছে না, ‘আমাদের এখানে স্থানীয় কোচদের পোটেনশিয়াল আছে৷ অনেকেই আছে সুযোগ পেলে ভালো কোচ হতে পারতো৷ তারা এই ভূমিকাটা রাখতে পারতো৷ কিন্তু এই পেশায় যদি ভালো আয়ের সম্ভাবনা, নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে সম্ভাবনাময়রা, যোগ্যরা তো আসতে চাইবে না৷ আর তার প্রভাব পড়বে জাতীয় পর্যায়ে৷''

‘জাতীয় পর্যায়ে বেশ ক’বছর খেলেছেন এমন খেলোয়াড়দের সুযোগ দিলে ভালো কোচ পাওয়া সম্ভব’ছবি: privat

বিদেশি কোচদের কাছ থেকে প্রাপ্যটা বুঝে নিতে গেলে যে যোগ্য দেশি কোচ দরকার, সেই কথাটায় খুব জোর দিলেন সাবেক জাতীয় হকি খেলোয়াড় এবং বর্তমান কোচ মামুন-উর-রশীদ৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘হকিতে অন্তত দেশি কোচের প্রবল সংকট৷ ফলে বিদেশি কোচের ওপর ভরসা করতেই হয়৷ আর তাদের কাছ থেকে শিখে রাখার লোকেরও অভাব৷''

মামুন বলছিলেন, ‘‘আমি বা হারুন ভাই (মাহবুব হারুন) কিছু দায়িত্ব পালন করছি৷ কিন্তু জাতীয় দল তো মূলত বিদেশি কোচ-নির্ভর৷ সমস্যা হলো, বিদেশি ভালো কোচ এনেও লাভ হয় না৷ কারণ, তার কাছ থেকে নেওয়ার যে ব্যাপারটা, সেটা আমরা করতে পারছি না৷ সেজন্য আমাদের স্থানীয় পর্যায়ের কোচিংয়ে দক্ষ লোক দরকার৷ এখন ফেডারেশনের কোচ তৈরির কোনো কার্যক্রম নেই৷ আমি ব্যক্তিগত খরচে বিভিন্ন লাইসেন্স করে এসেছি৷ এটা তো সবার পক্ষে সম্ভব না৷ ফলে স্থানীয় কোচিং দুর্বল হওয়ায় বিদেশি কোচ এনেও পুরো খেলার মান ভালো করা সম্ভব হচ্ছে না৷''

মামুন মনে করেন, হকির আরেকটা সংকট অল্প সময়ের জন্য কোচ আনা৷ তিনি বলছিলেন, ‘‘আমাদের বিদেশি কোচদেরও আনা হয় ইভেন্টভিত্তিক৷ কোনো একটা খেলা থাকলে, সেই সময় আসেন ওই কোচ৷ ফলে তার দীর্ঘমেয়াদে খেলাটায় কোনো প্রভাব ফেলার সুযোগ থাকে না৷ তবে আমি মনে করি, শীর্ষ পর্যায়ে আমাদের যতদিন স্থানীয় কোচদের তৈরি করা না হচ্ছে, ততদিন বিদেশি কোচ লাগবে৷''

তবে ফুটবলে এখন আর বিদেশি কোচ দরকার নেই বলে মনে করেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক হাসান আল মামুন৷ শেখ জামাল ধানমন্ডির বর্তমান সহকারি কোচ বলছিলেন, ‘আমাদের সময়ে আমরা বিশ্ব ফুটবল থেকে অনেক পিছিয়ে ছিলাম৷ অনেক দূরত্ব ছিল৷ এখন আর সেটা নেই৷ এখন আমাদের এখানে উয়েফা কোর্স করা কোচও আছেন৷ ফলে এখন চাইলে দেশি কোচরাও দায়িত্ব নিতে পারেন৷ আমি মনে করি, স্থানীয়দের হাতে দায়িত্ব দেওয়ার সময় চলে এসেছে৷''

সাবেক এই তারকা ফুটবলার আরো মনে করেন, এখন আগের মানের বিদেশি কোচ আসছেন না৷ ফলে ফুটবলের উন্নতিতে একেবারেই ভূমিকা রাখতে পারছেন না এখনকার বিদেশি কোচরা, ‘আমরা অটো ফিস্টার, সামির সাকিরের মতো কোচ পেয়েছি৷ এখন যারা আসছেন, তারা বৈশ্বিক বিচারে ওই মানের নন৷ এখন আসলে আমাদের ফেডারেশন চাইলে বিদেশি টেকনিক্যাল ডিরেক্টর রাখতে পারে; যেটা তারা করছে৷ কিন্তু এই টেকনিক্যাল ডিরেক্টরের যেটা করা উচিত, যে স্থানীয় ক্লাব কোচদের সাথে বসা, কৌশল নিয়ে আলাপ করা, তা কিন্তু হচ্ছে না৷ ফলে বিদেশি কোচ সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারছেন না৷''

তবে আর্চারিতে বিদেশি কোচ খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন দেশসেরা আর্চার রোমান সানা৷

ফুটবল, ক্রিকেট, হকির মতো দলীয় খেলা কেবল নয়; ব্যক্তিগত খেলা সাঁতার বা আর্চারিতেও মূলত বিদেশি কোচের আধিপত্য৷ সেরকমই বিদেশি কোচের অধীনে সাফল্য পাচ্ছেন রোমান সানা৷ তিনি মনে করছেন, আর্চারিতে শুধু বিদেশি নয়, ইউরোপীয় কোচই দরকার৷

‘স্থানীয় কোচিং দুর্বল হওয়ায় বিদেশি কোচ এনেও খেলার মান ভালো হচ্ছে না’

This browser does not support the audio element.

রোমান বলছিলেন, ‘‘আমি এশিয়ান অনেক কোচের সাথে কাজ করেছি৷ দেশি কোচের সাথেও কাজ করেছি৷ কিন্তু ইউরোপীয় কোচদের যে শৃঙ্খলা ও কাজের প্রতি ডেডিকেশন, তা কারো মধ্যে পাওয়া যায় না৷ আর ব্যক্তিগত খেলায় ভালো কোচ হতে গেলে ভালো খেলোয়াড় হওয়া দরকার৷ সেটা আমাদের নেই৷ ফলে আমাদের এখনো বিদেশি কোচের ওপরই ভরসা করতে হবে৷''

তবে রোমান সানা মনে করেন, দেশি অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের ভালো প্রশিক্ষন দেওয়া গেলে এবং শিক্ষাগত যোগ্যতায় ছাড় দিলে ভালো দেশি কোচ পাওয়া যেতে পারে, ‘‘আমি অনেক ভালো ভালো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়কে চিনি, যাদের অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা বেশি না৷ আর্চারি কেবল নয়, অন্য খেলার কথাও বলছি৷ কিন্তু ওনাদের দক্ষতা আছে৷ এখন ওনাদের যদি শিক্ষাগত যোগ্যতায় একটু ছাড় দিয়ে ভালো কোর্স করিয়ে আনা যায়, তাহলে আমরা এখানে ভালো কোচ পেতে পারি৷ আমি মনে করি, জাতীয় পর্যায়ে বেশ ক বছর খেলার অভিজ্ঞতা আছে, এমন স্থানীয়দের যত্ন নিতে হবে৷ তাদের সুযোগ দিলে ভালো কোচ পাওয়া সম্ভব বলেই মনে হয়৷''

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ