এশিয়া ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বাংলাদেশে অবকাঠামোর উন্নতি সংক্রান্ত একাধিক প্রকল্পে অর্থায়ন করছে৷ তারই একটি দেখতে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন ডয়চে ভেলের বেটিনা স্টেহক্যাম্পার৷
বিজ্ঞাপন
যশোর থেকে ৩০ কিলোমিটার গেলে নারিকেলবাড়ি৷ বাসে শীততাপ এমনই বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, বেটিনার রীতিমতো শীত করছিল৷ বাইরে মোটরবাস, রিকশা আর মানুষের স্রোত৷ রাস্তার অবস্থাও খুব ভালো নয় – জার্মানি থেকে আসা বেটিনার যা মনে হওয়া স্বাভাবিক৷ ঘণ্টা দেড়েক পরে যখন গাড়ি থামল, তখন বেটিনা দেখলেন, রাস্তার মাঝখানে রঙিন কাপড় দিয়ে সাজিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে৷ স্টেজে ও রাস্তায় বহু লোক বসে রয়েছে৷ ঐ রোদেই৷
বেটিনা প্রথমে ভেবেছিলেন, বোধহয় কোনো বিয়েবাড়িতে এসে পড়ছেন৷ পরে বুঝলেন, এ আয়োজনের উপলক্ষ্য তিনি ও তাঁর সঙ্গিসাথীরা নিজেই – জার্মানি থেকে আসা একটি ছোট দল, যে দলে বেটিনার মতো সাংবাদিক, জার্মানির সরকারি উন্নয়ন ব্যাংক কেএফডাবলিউ আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এডিবি-র প্রতিনিধিরা রয়েছেন৷ চিত্রা নদীর ওপর ৯০ মিটার দৈর্ঘের যে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে, তার অর্থায়ন করেছে এই সব সংস্থা৷
জার্মানির কিছু আকর্ষণীয় সেতু
আকর্ষণীয়, মজার, ঐতিহাসিক – জার্মানিতে রয়েছে এমনই কিছু ব্রিজ৷ ছবিঘরে থাকছে সে সবের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবচেয়ে প্রাচীন
জার্মানির সবচেয়ে প্রাচীন এই সেতুটি ট্রিয়ার শহরে মোজেল নদীর উপর অবস্থিত৷ শুরুতে এটা কাঠের তৈরি ছিল৷ এরপর রোমানরা সেটাতে পাথর আর শিলার ব্যবহার করে৷ ছবিতে যে পাথরের পিলারগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো প্রায় ১,৯০০ বছর আগের! আর উপরের অংশটায় প্রথম সংস্কার করা হয় আটশো বছর আগে আর দ্বিতীয়বার প্রায় দুশো বছর আগে৷
ছবি: imago/ARCO IMAGES
সেতুর নীচে বিস্ফোরক!
এই ব্রিজটি জার্মানির মূল ভূখণ্ডকে বাল্টিক সাগরে অবস্থিত ফেমান দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত করেছে৷ ১৯৬৩ সালে শীতল যুদ্ধের সময় সেতুটি নির্মাণ করা হয়৷ সে সময় সম্ভাব্য আক্রমণের কথা মাথায় রেখে ব্রিজের নীচে বিস্ফোরক জমা করে রাখা হয়েছিল৷
ছবি: Fotolia/Pascal Walz
ব্রিজের সড়কের দুপাশে দোকান
এয়ারফুর্ট-এর পায়ে হাঁটা এই সেতুর দুপাশে রয়েছে গ্যালারি আর বিভিন্ন শিল্পকর্ম বিক্রির দোকান৷ প্রতিটি দোকানের অর্ধেক অংশ কাঠের তৈরি৷ প্রায় আটশো বছর আগে যখন ব্রিজটি তৈরি হয় তখন সেখানে মুদি দোকানিরা পণ্য বিক্রি করতেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সেতুর সড়কে ছাদ!
ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ১২৭২ সালে তৈরি এই কাঠের ব্রিজটিতে ছাদ রয়েছে৷ সে সময় নির্মিত অনেক কাঠের সেতুতেই নিরাপত্তাজনিত কারণে এমনটা করা হতো৷ মজার ব্যাপার হলো এই সেতু পাড়ি দিয়ে আপনি জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ডে চলে যেতে পারবেন!
ছবি: picture-alliance/dpa
বিশ্বের সবচেয়ে বড়
স্যাক্সনি ও বাভারিয়া রাজ্যের মধ্যে অবস্থিত এই ব্রিজটি ইট দিয়ে তৈরি৷ এখনো পর্যন্ত ইটের তৈরি এটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেতু৷ ১৮৫১ সালে নির্মিত হওয়ার সময় ব্রিজটি বিশ্বের সবচেয়ে লম্বাও ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রকৃতির মাঝে সেতু
ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই ব্রিজের অবস্থানটা কোথায়৷ ১৮৫১ সালে তৈরি হওয়া এই সেতুর কারণে পর্যটকরা এমন সব পাহাড়ি এলাকায় যেতে পারছেন না যেটা এমনিতে সম্ভব হত না৷
ছবি: Fotolia/Seewald
উপরে ট্রেন, নীচে গাড়ি
১৯৬১ সালে যখন বার্লিন প্রাচীর তৈরি হয়েছিল তখন এই ঐতিহাসিক ওবারবাউম ব্রিজটি শহরকে পূর্ব আর পশ্চিমে বিভক্ত করা সীমান্তের একটা অংশে পরিণত হয়েছিল৷ এই ব্রিজে দুটো রাস্তা রয়েছে৷ উপর দিয়ে চলে ট্রেন আর নীচ দিয়ে গাড়ি৷
ছবি: Fotolia/Marco2811
পানি ব্রিজ!
ফেসবুকের কল্যাণে অনেকের কাছেই পরিচিত এই ছবিটি৷ এটি মাগডেবুর্গ ওয়াটার ব্রিজ৷ পানির ওপর স্থাপিত এই সেতুর রাস্তাও পানির! অর্থাৎ এই সেতু দিয়ে চলে জাহাজ৷ প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউরো ব্যয়ে নির্মিত এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০০৩ সালে৷ মূলত পণ্যবাহী জাহাজের রুট সংক্ষিপ্ত করতে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে৷
ছবি: AP
সেতু এক, দেশ তিন!
নাম ‘থ্রি কান্ট্রিস ব্রিজ’৷ বুঝতেই পারছেন তিন দেশে এই সেতুর অবস্থান৷ জার্মানি, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড৷ ২৪৮ মিটার দীর্ঘ এই ব্রিজটি শুধু পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল চালিয়ে পার হওয়া যায়৷ কোনো ধরনের গাড়ির প্রবেশ নেই সেখানে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
নদীর দু'ধারে প্রায় দেড় লাখ মানুষের বাস৷ ১৫ বছর বয়সের মেয়ে রুমি তাদের একজন৷ এসেই মাননীয় অতিথিদের সঙ্গে আলাপ করে ফেলল৷ সে দশম শ্রেণিতে পড়ে আর ডাক্তার হতে চায় – জানাল সে৷ কিন্তু তার বাড়ি নদীর এক পারে, আর স্কুল নদীর অপর পারে৷ কাজেই স্কুলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যায়; জামাকাপড়, খাতাপত্র ভিজে যায়৷ বর্ষায় ঘোর বৃষ্টিতে সরু বাঁশের সাঁকোয় করে ফেরিতে উঠতে হয়৷ কাজেই রুমির কাছে এই নতুন ব্রিজ যে কতটা আনন্দের ব্যাপার, তা কল্পনা করা শক্ত নয়৷
চাষি আর ব্যাপারিদের জীবনেও বড় পরিবর্তন এসেছে৷ ব্রিজ তৈরি ছাড়াও, এডিবি আর কেএফডাবলিউ স্থানীয় রাস্তাঘাট, ঘাটবাজার মেরামতের টাকা দিয়েছে৷ সেই সব প্রকল্পে ২০১৪ সাল যাবৎ হাজার হাজার দিনমজুর কাজ পেয়েছে৷ এখন নদীর এপার থেকে ওপার মাল নিয়ে যাওয়ার, অথবা প্রবল বর্ষণেও মালপত্র যাতে না ভেজে, বাজারেই তার ব্যবস্থা করা রয়েছে৷ বাজারের কয়েকটি দোকান মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত – জার্মান উন্নয়ন ব্যাংকটি এর জন্য জোর দিয়েছিল৷
পানির উপর হচ্ছে সবজি চাষ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি গ্রামের বেশিরভাগই বছরের পুরোটা সময় জলাবদ্ধ থাকে৷ এ সব গ্রামের মানুষেরা ভাসমান পদ্ধতিতে গাছের চারা এবং সবজি উৎপাদন করে কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়েছেন৷
ছবি: DW
কৃষকের কৌশল
বছর জুড়েই জলাবদ্ধতা, সাথে কচুরিপানার মিছিল৷ ফলে পিরোজপুরের নাজিরপুর এলাকার নিম্নাঞ্চলে স্বাভাবিক উপায়ে কৃষিকাজ কার্যত অসম্ভব৷ তবে বৈরী এই পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করে নাজিরপুরের কৃষকরা নিজেদের কৌশলে চালিয়ে যাচ্ছেন কৃষিকাজ৷
ছবি: DW
ভাসমান কৃষিক্ষেত্র
নাজিরপুরের মুগাঝোর এলাকার জলাভূমিতে ভাসমান কৃষিক্ষিত্র৷ নিজেদের উদ্ভাবিত ‘ধাপ’ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেন এ সব এলাকার মানুষরা৷ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ‘কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল’ হিসেবেও স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে নাজিরপুরে উদ্ভাবিত ভাসমান পদ্ধতির এ চাষাবাদ৷
ছবি: DW
যেভাবে তৈরি হয় ধাপ
নাজিরপুরের পানিতে ডোবা নিম্নাঞ্চল কচুরিপানা, দুলালীলতা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জল সহিষ্ণু ঘাসসহ নানান জলজ উদ্ভিদে ভরপুর৷ এ সব জলজ উদ্ভিদকে স্তূপ করে পচিয়ে তারা তৈরি করেন ভাসমান এক ধরণের ধাপ৷ এই ভাসমান ধাপের উপরেই চাষাবাদের এক নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন তাঁরা৷
ছবি: DW
পুরনো ধারা
কৃষি জমির বিকল্প হিসেবে জলাশয়ে ভাসমান চাষাবাদ দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে এ অঞ্চলে৷ কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পদ্ধতিতে কৃষির উৎপাদনশীলতা জমির চেয়ে ১০ গুণ বেশি৷
ছবি: DW
জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ
ধাপ পদ্ধতির এ চাষাবাদ হয় সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে৷ রাসায়নিক সারের ব্যবহার নেই বললেই চলে৷ ফলে উৎপাদন খরচও কম এবং স্বাস্থ্যকর৷
ছবি: DW
ভাসমান বীজতলা
জলাভূমিতে প্রথমে কচুরিপানা, শ্যাওলা ও বিভিন্ন জলজ ঘাস স্তরে স্তরে সাজিয়ে দুই ফুট পুরু ধাপ বা ভাসমান বীজতলা তৈরি করা হয়৷ এগুলো কয়েকদিন ধরে পচানো হয়৷ একেকটি ভাসমান ধাপ ৫০-৬০ মিটার লম্বা ও দেড় মিটার চওড়া হয়৷
ছবি: DW
চাষ করা যায় অনেককিছু
ভাসমান এ সব ধাপে সাধারণত লাউ, সিম, বেগুন, বরবটি, করলা, পেঁপে, টমেটো, শশা, পুঁইশাক, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, মরিচ ইত্যাদি শাকসবজি ও মশলার চারা উৎপাদন করে থাকেন কৃষকরা৷ অনেক কৃষক আবার লাল শাক, ঢেঁড়স, হলুদ ইত্যাদিও চাষ করে থাকেন৷
ছবি: DW
নেই কোনো কৃষিঋণের ব্যবস্থা
মুগারঝোরের চাষীদের জন্য কৃষি ঋণের কোনো ব্যবস্থা নেই৷ স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চরা হারে সুদ নিয়ে গরিব এ চাষীরা তাঁদের কৃষি কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন৷ স্থানীয় কৃষক আশুতোষ জানান, সরকার সহজশর্তে ঋণ দিলে তাঁরা ভাসমান এ চাষাবাদের আরও বিস্তৃতি ঘটাতে পারবেন৷
ছবি: DW
বিক্রি হয় কচুরিপানা
নাজিরপুরের মুগারঝোরে নৌকা বোঝাই কচুরিপানা নিয়ে ক্রেতার খোঁজে এক বিক্রেতা৷ এক নৌকা কচুরিপানা সাধারণত বিক্রি হয় ২-৩ হাজার টাকায়৷ এছাড়া নাজিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় এসব কচুরিপানার হাটও বসে৷
ছবি: DW
9 ছবি1 | 9
বাংলাদেশের আয়তন জার্মানির অর্ধেক, কিন্তু জনসংখ্যা জার্মানির দ্বিগুণ৷ ১৬ কোটি মানুষের বাস এদেশে৷ নদীমাতৃক দেশ, জমি সাগরের পানির চেয়ে সামান্য কিছু উঁচুতে৷ বন্যা প্রতিরোধের প্রায় কোনো ব্যবস্থাই নেই বললে চলে৷ ‘‘যার ফলে গাছপালা, বাজার-হাট, বাড়ি-ঘর অনেক সময়েই জলে আটকা পড়ে থাকে'', জানালেন এলমা মোরশেদ, যিনি খুলনা শহরে বন্যা প্রতিরোধের দায়িত্বে রয়েছেন৷ বর্ষায় খুলনার ভৈরব নদীর জল বাড়ে ছয় মিটার৷ মানুষজনের জীবিকা, রোজগার খোয়া যায়৷ এডিবি আর কেএফডাবলিউ ব্যাংক এখানেও নদী বরাবর বাঁধ দেওয়ায় অর্থায়ন করেছে৷ শহরের রাস্তা আরো উঁচু করা হয়েছে, দু'লাখ মানুষ যা থেকে উপকৃত হয়েছেন ও হচ্ছেন৷
বাংলাদেশ-জার্মানি সহযোগিতার আর কোনো উদাহরণ কি আপনার জানা আছে? লিখুন আমাদের৷