ঈদে ‘পাখি ড্রেস’ নিয়ে উৎসাহ আতঙ্কে পরিণত হয়েছে৷ এই পোশাক না পেয়ে দুই কিশোরীর আত্মহত্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের মধ্যে বাংলাদেশে ভারতীয় একটি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধের দাবি উঠেছে৷
ছবি: DW/P. M. Tewari
বিজ্ঞাপন
ভারতের বিনোদনমূলক টিভি চ্যানেল স্টার জলসার জনপ্রিয় সিরিয়াল ‘বোঝে না সে বোঝে না'৷ তারই একটি নারী চরিত্রের নাম পাখি৷ সিরিয়ালে চরিত্রটি যে থ্রি-পিস পরেন তা-ই বাংলাদেশে পাখি ড্রেস নামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ এবারের ঈদে কিশোরী ও তরুণীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এই পোশাক৷
রবিবার গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় নূরজাহান খাতুন (১৪) নামে এক কিশোরী ঈদে পাখি ড্রেসের আবদার করেও না পেয়ে রাগে অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ পুলিশ ও তার পরিবারের লোকজন জানান, ঈদ উপলক্ষ্যে নূরজাহান তার মা ও বড় বোনের কাছে পাখি ড্রেস চায়৷ ওই পোশাক কিনে না দেওয়ায় রবিবার নূরজাহানের সঙ্গে তার মা ও বোনের ঝগড়া হয়৷ এরপর কষ্টে-অভিমানে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে নূরজাহান৷
বাঙালি নারীর দশ গুণ
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ নারীর গুণ সম্পর্কে জানিয়েছেন ডয়চে ভেলের পাঠকরা৷ তাঁদের মতামত এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি বাঙালি নারীর দশগুণ নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
আবেগী, স্বাধীনচেতা
গরবিনি, আবেগী এবং স্বাধীনচেতা – বাঙালি নারীর সঙ্গে এই তিনটি বিশেষণই মানানসই৷ আবেগ যেমন তাঁদের দ্রুত স্পর্শ করে, তেমনি স্বাধীনতার প্রশ্নে কিন্তু তাঁরা সত্যিকার অর্থে অনড়৷ নিজের সত্ত্বা নিয়ে অহংকার তাঁদের আছে বটে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মধ্যে রয়েছে অসীম ধৈর্য্য৷
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
শাড়িতে সবচেয়ে সুন্দর
বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে শাড়ি৷ সেই শাড়ি বাঙালি নারীর সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তোলে চমৎকারভাবে৷ বিভিন্নভাবে শাড়ি পরতে জানেনও তাঁরা৷ আর ‘উপহার হিসেবে শাড়ি’? – কোন বাঙালি মেয়ে না চায় বলুন?
ছবি: DW/A. Islam
উৎসব প্রেমী
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন৷ নববর্ষ, ঈদ কিংবা দুর্গা পূজা – সব উৎসবই যেন বাঙালি নারীর জন্য তৈরি৷ প্রতিটি উৎসবের সঙ্গে মানানসই পোশাক পরতে এবং সেই উৎসবের উপযুক্ত রান্নায় পারদর্শী তাঁরা৷ ডয়চে ভেলের পাঠক সুজন খানের কথায়, ‘‘বঙ্গের নারী লাজুক প্রকৃতির, কিন্তু যে কোনো উপলক্ষ্যেই প্রাণ খোলা হাসি উপচে পড়ে তাঁদের৷’’
ছবি: Zaman/AFP/GettyImages
‘নো ডায়েট’
বাঙালি নারী ‘ডায়েট’ করছেন, এমনটা বেশ বিরল৷ তাই খাওয়ার ব্যাপারে তাঁরা বেশ উদার৷ কথায় বলে না, মাছে-ভাতে বাঙালি? অবশ্য মাছ-ভাতের পাশাপাশি ফুসকা কিংবা চটপটি পেলে তো আর কথাই নেই৷ আসলে টক, ঝাল, নোনতা, মিষ্টি, এমনকি তেতোও পছন্দ এই নারীদের৷
ছবি: Debarati Mukherji
রান্নার শখ
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই ধরুন৷ দেশ সামলানোর কঠিন দায়িত্ব পালনের মাঝেও রান্না ঘরে যেতে ভোলেন না তিনি৷ গত বছর ছেলের জন্য রান্না করার সময় তোলা তাঁর এই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছিল৷ বাঙালি মেয়েরা রাঁধতে যে ভীষণ ভালোবাসেন!
ছবি: Sajeeb Wazed
অল্পতেই সন্তুষ্ট
বাঙালি মেয়েদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলা কি খুব কঠিন? না৷ সকলেই জানেন যে, কাজটা সহজই৷ একটি লাল গোলাপ পেলে কিংবা প্রিয় রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলেই তাঁরা সন্তুষ্ট৷ ডয়চে ভেলের পাঠক রন্জু খালেদের মতে, বাঙালি নারীর মধ্যে ‘একইসাথে দৃঢ়তা ও নমনীয়তা এবং প্রজাপতির চপলতা’ রয়েছে৷
ছবি: DW/A. Islam
কাজল কালো চোখ
জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’ কিংবা রবি ঠাকুরের ‘কৃষ্ণকলি’ – বাঙালি নারীর কাজল কালো চোখের প্রশংসা পাবেন অনেক কবির কবিতাতেই৷ সত্যি বলতে কি, বাঙালি নারীর চোখ পুরুষকে টানে সবচেয়ে বেশি৷
ছবি: N.Seelam/AFP/GettyImages
বাকপটু
বাংলাদেশের কিংবা ভারতের মেয়েরা চুপ করে বসে আছেন – এমন দৃশ্য কল্পনা করাও কঠিন৷ তাঁরা কথা বলতে ভালোবাসেন৷ রান্না থেকে রাজনীতি – সব বিষয়েই একটা মতামত আছে তাঁদের৷ ডয়চে ভেলের পাঠক জিএনএস নয়নের কথায়, ‘‘নারী পুরুষের যে কোনো কষ্ট অতি সহজে ভুলিয়ে দিতে পারে৷ এই গুণই আমাকে মুগ্ধ করে, আবার সাথে অবাকও করে৷’’
ছবি: DW/A. Islam
নারীবাদী
বাঙালি মেয়েরা নারীবাদী৷ বিতর্কিত বাঙালি লেখিকা তসলিমা নাসরিন তাঁদের অনেকেরই প্রিয়৷ নাসরিনের ‘আমার মেয়েবেলা’ পড়েনি এমন নারী পাওয়া মুশকিল৷
ছবি: AFP/Getty Images
ভ্রমণপ্রিয়
বাংলাদেশি কিংবা ভারতীয় বাঙালি নারীর গুণ কি আর অল্পতে জানানো যায়, বলুন? কিছু গুণ না হয় অজানাই থাক৷ তবে একটির কথা বলে শেষ করি, বাঙালি মেয়েরা কিন্তু ঘুরতে খুব ভালোবাসেন৷ তথ্য সহায়তা: ডয়চে ভেলে ফেসবুক পাতা, ইন্ডিয়াওপাইন্স, স্কুপহুপ
ছবি: DW/A. Islam
10 ছবি1 | 10
এর আগে গত ৯ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার আরেক কিশোরী হালিমা খাতুন (১৫) একইভাবে পাখি ড্রেস না পেয়ে আত্মহত্যা করে৷ হালিমা তার বাবাকে ঈদের জন্য পাখি ড্রেস কিনে দিতে বলার পরও তার বাবা অন্য পোশাক কিনে আনায় সেও অভিমানে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে৷ হালিমা স্থানীয় মাহিদুর রহমান উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী ছিল৷
এই দু'টি মর্মান্তিক ঘটনায় বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বিশেষ করে স্টার জলসার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে৷ বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক এবং বিভিন্ন ব্লগে সমালোচনার ঝড় বইছে৷ তারা বেশ কয়েকটি ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বাংলাদেশে বন্ধের দাবি জানাচ্ছেন৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম স্টাডিজ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সফিউল আলম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কর্পোরেট পুঁজি নানাভাবে ভোক্তা শ্রেণি গড়ে তুলতে চায়৷ তারা নাটক বা সিরিয়ালের মাধ্যমে কৌশলে পণ্য উপস্থাপন করে তার বাজার সৃষ্টি করে৷ ‘পাখি ড্রেস' তার একটি বড় উদাহরণ৷'' তিনি বলেন দর্শকদের ভেতর ভোগের মানসিকতা তৈরি করে তারা৷ এতে প্রলুব্ধ হয়ে কেউ যখন সেই ভোগ্যপণ্য না পান তখন তিনি হীনমন্যতায় ভোগেন৷ এর ফলে আত্মহত্যা ছাড়াও নানা অপরাধ করতে পারেন তারা৷
মিনিস্কার্টের ৫০ বছর
নারীদের ছোট্ট একটি পরিধেয়: একাধারে তারুণ্য ও নারীবাদের প্রতীক; অপরদিকে অশালীন ও অশ্লীল বলে রক্ষণশীলদের চক্ষুশূল৷ এক টুকরো বস্ত্রই শুধু নয়, বিংশ শতাব্দীর সামজ ও সংস্কৃতির একটি মাইল ফলকও বটে৷ এরই নাম মিনি বা মিনিস্কার্ট৷
ছবি: Getty Images
চোখে পড়ার জন্যই যার জন্ম
মিনিস্কার্ট এমনই এক বস্তু, যা ৫০ বছর আগেও মানুষের নজর কেড়েছে এবং আজও কাড়ে৷ নন্দনতত্ত্বে নারীদেহের সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা আর যৌন আবেদনের মধ্যে যতোটুকু ফারাক, মিনির ক্ষেত্রেও ঠিক ততটা৷ দেহ একই থাকছে, বাড়ছে কমছে শুধু হেমলাইন৷
ছবি: imago/McPHOTO
‘উদ্ধৃতি চিহ্ন’
মিনির মজাই হলো, তা যা অবারিত রাখে, অর্থাৎ সুন্দর, সুডৌল পদযুগল৷ আবার তা অবলীলাক্রমে এমন একটা নান্দনিক পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, সমালোচনা করার মতো আর কিছু থাকে না – নাকি থাকে?
ছবি: Fotolia/Franz Pfluegl
‘টুইগি’
খড়কুটোর মতো পাতলা হাত-পা-ওয়ালা এই মডেলটিকে আজও লন্ডনের সুইঙ্গিং সিক্সটিজ-এর প্রতীক বলে মনে করা হয়৷ আসল নাম লেসলি হর্নবি৷ পরবর্তী জীবনে অভিনয়ও করেছেন৷ আজও তাঁর ছবি দেখলে মনে হয়, টুইগি রক্তমাংসের মানুষ নন, তিনি একটি ফ্যাশন স্টেটমেন্টের থেকেও বড় – তিনি জীবন সম্পর্কে একটি মন্তব্য৷
ছবি: Getty Images
মেরি কোয়ান্ট
লন্ডনের চেলসিতে ‘বাজার’ নামধারী একটি ফ্যাশন বিপণী চালাতেন মেরি কোয়ান্ট৷ পঞ্চাশের দশকের শেষেই আরো ছোট স্কার্ট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন, যা পর্যবসিত হয় ১৯৬৪ সালে তাঁর যুগান্তকারী সৃষ্টিতে: মিনিস্কার্ট৷ এই কাহিনির প্রামাণ্যতা নিয়ে হালে দ্বিধা দেখা দিয়েছে৷ কিংবদন্তী বলে, মেরি নাকি তাঁর প্রিয় মোটরগাড়ি, অস্টিন মিনির নামে খাটো স্কার্টটির নামকরণ করেন৷ এখানে মডেলদের সঙ্গে মেরি কোয়ান্ট (ডানদিকে)৷
ছবি: Express/Express/Getty Images
হাই আর্ট
মিনিস্কার্ট ছিল স্ট্রিট ফ্যাশন, ষাটের দশকে লন্ডনের মেয়েরা খাটো স্কার্ট পরতে শুরু করে: মেরি কোয়ান্ট নিজেই এ কথা বলেছেন৷ কয়েক বছরের মধ্যেই সেই রাস্তার ফ্যাশন ‘ওৎ কুতুর’, অর্থাৎ হাই ফ্যাশনে পৌঁছে যায়৷ শুধু তাই নয়, স্বয়ং ফ্যাশন গুরু ইভ স্যাঁ লরাঁ তাঁর সুবিখ্যাত মন্ড্রিয়ান ড্রেসটিকে মিনি ড্রেস-ই করেছেন৷ পিয়েট মন্ড্রিয়ান ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের এক ওলন্দাজ চিত্রশিল্পী৷
ছবি: Getty Images
গ্লোরিয়া স্টাইনেম
নারীবাদের প্রথম পর্বে যাঁরা নারীদের হয়ে কলম ধরেছিলেন এবং সোচ্চার হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে পড়েন জার্মেইন গ্রিয়ার এবং গ্লোরিয়া স্টাইনেম৷ এঁরা কিন্তু ষাটের দশকে মিনিস্কার্টকে নারীমুক্তির প্রতীক হিসেবে গণ্য করতেন এবং উভয়ে মিনিস্কার্টও পরেছেন৷
ছবি: Hulton Archive/Getty Images
শাকিরা
কলম্বিয়ার এই গায়িকা বিশ্বজয় করেছেন গান গেয়ে৷ মঞ্চে তিনি যখন তাঁর শো দেন, তখন পঞ্চাশ বছরের পুরনো ফ্যাশান স্টেটমেন্ট মিনিস্কার্টকে বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না৷
ছবি: Getty Images
7 ছবি1 | 7
ড. সফিউল আলম বলেন এটা প্রতিরোধে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা৷ এছাড়া যারা এধরণের সিরিয়াল প্রচার করে তারা যেন সেটা বন্ধ করে সেজন্য সামাজিক চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনো গণমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধের বিরোধী৷ তবে তা যদি মৃত্যুর মতো ক্ষতির দিকে নিয়ে যায় তাহলে সরকার সেই ধরণের সম্প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করতে পারে৷''
এদিকে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে ভারতের স্টার জলসাসহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচার গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে৷ তারা ক্ষতিকর অনুষ্ঠান সম্প্রচার বন্ধ না করলে বাংলাদেশে তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হতে পারে৷
ঢাকার ঈদের পোশাকের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ভারত থেকে আসা পাখি ড্রেসে বাজার সয়লাব৷ পাখি ড্রেসের ব্যাপক চাহিদার সঙ্গে এর দামও বেশি৷ তিন হাজার টাকার নীচে কোনো পাখি ড্রেস নেই৷ আর সর্বোচ্চ লাখ টাকা দামের পাখি ড্রেসও আছে৷ ফলে অনেকের সাধ থাকলেও সাধ্যে পাখি ড্রেস কুলোচ্ছে না৷ যার পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ৷ ঘটছে আত্মহত্যার মতো ঘটনা৷ এমনকি সংসার ভাঙার খবরও প্রকাশ হয়েছে সংবাদ মাধ্যমে৷