1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা - এক

১২ জুন ২০১১

রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা, পর্ব থেকে পর্বান্তরে তাঁর স্বচ্ছন্দ উত্তরণ, সর্বজনীন ও সমকালীন জীবনবোধকে উদার মানবিকতার দৃষ্টিভূমি থেকে গ্রহণ করার ব্যাকুলতা বাঙালির মানসক্ষেত্রে তাঁকে স্থায়ী আসন দিয়েছে৷

বাঙালি মানসে রবীন্দ্রনাথ নতুন ও নতুনতর প্রাণস্পন্দনের প্রতীক৷ রবীন্দ্রজয়ন্তীর এই সার্ধশতবার্ষিকেও তাই রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে আমাদের বিস্ময়ের অন্ত নেই, এখনো আমাদের জিজ্ঞাসার শেষ নেই৷ প্রাণময় তাঁর সৃষ্টির রহস্য আমাদের কাছে শেষ হয় না৷ আমরা সেই অশেষকে কবির সমগ্র সৃষ্টিলীলার সঙ্গে মিলিয়ে এখনো সন্ধান করে চলেছি৷


রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা, অনুধ্যান করার কাজটি বাংলাদেশে কখনো সরলরেখা অনুসরণ করে চলেনি৷ বঙ্কিম, একপেশে ও জটিল দৃষ্টিভঙ্গিতে রবীন্দ্রনাথকে অনেক সময় দেখা হয়েছে৷ আর এ অবস্থাটি সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছিল বাংলাদেশ যখন পূর্ববঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান ছিল তখন৷


দেশবিভাগের পর আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতির বলয়ে রবীন্দ্রনাথের অবস্থান নিয়ে বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক মহলে তর্কবিতর্কের সূত্রপাত ঘটে৷ এ বিতর্ক সৃষ্টি করেন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুটি ধারার বুদ্ধিজীবীগণ৷ এঁদের মধ্যে একদিকে ছিলেন বামপন্থি বুদ্ধিজীবী অন্যদিকে ছিলেন পাকিস্তানের আদর্শ ও ভাবধারার অনুসারী তথাকথিত ইসলামি তমদ্দুনপন্থি বুদ্ধিজীবী৷


বামপন্থিদের মতে রবীন্দ্ররচনা প্রগতিবিরোধী তাই তা পরিত্যাজ্য৷ আর পাকিস্তানি সংস্কৃতির বাহক বুদ্ধিজীবীর বক্তব্য: ‘‘নতুন রাষ্ট্রের স্থিতির প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজবো৷ সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র বজায় রাখার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির জন্যে যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি৷''


পাকিস্তানি সংস্কৃতিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের রবীন্দ্রবিরোধিতা ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে ওঠে৷ এক পর্যায়ে তাঁরা রবীন্দ্রনাথেরই শুধু নয়, বাংলা ভাষার অবয়বের বিপক্ষেও অবস্থান নেন৷ তাঁদের মতে যা কিছু পাকিস্তানের আদর্শের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, তা সবই পরিত্যাজ্য৷


বামপন্থিদের রবীন্দ্রবিরোধিতা স্তিমিত হয়ে আসে৷ এক পর্যায়ে দেখা যায়, যাঁরা রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাভাষার বিরোধিতায় লিপ্ত তাঁদেরই বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন এই বামপন্থি বুদ্ধিজীবীগণ৷
বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বিতর্কের প্রথম দিকে সকলেই যে রবীন্দ্রনাথের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন তা নয়৷ বেশির ভাগই ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পক্ষে৷ প্রথম দিকে এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ৷ বস্তুত এঁদেরই শক্ত অবস্থানের কারণে ঢাকার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রগতিশীলতার নতুন স্রোত বইতে শুরু করে এবং তা প্রতিক্রিয়াশীলদের রুখবার জন্য প্রস্তুত হয়৷


রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই রকম বিভিন্নমুখী, বিপরীতমুখী ভাবনাচিন্তার মাঝে চলে আসে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিক৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে প্রগতিশীল ও প্রতিক্রিয়াশীলদের মধ্যে৷ শুরু হয় প্রচণ্ড বাদানুবাদ৷


একদলের মতে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতার কবি৷ তাই তিনি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য৷ এই দলের নেতৃত্ব দেন বিচারপতি এস.এম মুর্শেদ, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, খান সারওয়ার মুর্শেদ প্রমুখ৷


অন্যদল বললেন, রবীন্দ্রনাথ যেহেতু হিন্দু তাই তিনি ভারতীয় ঐতিহ্য ও সভ্যতার ধারক ও বাহক৷ অতএব তিনি পাকিস্তানী মুসলমানদের কাছে অপাংক্তেয়৷


রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই বাদানুবাদের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ পূর্ববঙ্গ বা বাংলাদেশে সার্থকভাবে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেন৷ শতবার্ষিকের অনুষ্ঠানমালা রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা ও নাটককে বহু মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে৷ রবীন্দ্রচর্চায় তৈরি হয় আগ্রহ৷ রবীন্দ্রচর্চায় পথ দেখায় বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট, ঐকতান, ক্রান্তি, সৃজনী, সন্দীপন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক সংঘ বা সংস্থা৷


এই পরিপ্রেক্ষিতে, রবীন্দ্রনাথের বিরোধীরা তখন বলা শুরু করলেন, ‘‘রবীন্দ্রনাথের দোহাই তুলিয়া অখণ্ড বাংলার আড়ালে আমাদের তামুদ্দনিক বিপদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেওয়া চলিবে না৷''


তমুদ্দনপন্থিদের সুযোগ এসে গেলো ১৯৬৫-তে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়৷ বেতার থেকে রবীন্দ্রনাথ নির্বাসিত হলেন৷ আর সরকারি ফরমান বলে ১৯৬৭-তে রবীন্দ্রনাথ বেতারে নিষিদ্ধ হলেন৷


এই সব ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ধীরে ধীরে বাঙালির আত্মপরিচয় ও স্বাধিকার আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠলেন৷ নানান মাত্রায় রবীন্দ্রনাথকে অবলোকন করা শুরু হলো৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রচিত হলো নানান প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থ৷


প্রাবন্ধিক গবেষকদের এই সব গবেষণাকর্ম এবং সংস্কৃতিকর্মীদের রবীন্দ্রচর্চায় আমাদের জাতিসত্তার জন্য রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ডভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেন৷ আমাদের জাতীয়তাবাদী ও স্বাধিকার আন্দোলনের দিনগুলোতে রবীন্দ্রনাথ হলেন নিত্যসঙ্গী৷ তারপর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি'- হয়ে উঠলো মুক্তিকামী বাঙালির স্বপ্নের গান৷ আমাদের মুক্তিসংগ্রামে রবীন্দ্রনাথ এভাবেই অনিবার্যরূপে সংযুক্ত হলেন৷

প্রতিবেদন: ফরহাদ খান, রাজশাহী

সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল ফারূক

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ