এক মত বিনিময় সভায় যোগ দিতে বার্লিনে এসেছিলেন রিসার্চ ইনিশিয়েটিভস বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা৷ সেখানে ডয়চে ভেলের দেবারতি গুহকে দেয়া সাক্ষাৎকারে জনসম্পদ রপ্তানি ও রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অনেক কথা বলেছেন তিনি৷
বিজ্ঞাপন
একটা সময় বাংলাদেশ থেকে মূলত মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ আর ব্রিটেনেই জনসম্পদ রপ্তানি হতো৷ কিন্তু গত কয়েক বছরে কৃষিপ্রধান দেশটিতে বিভিন্ন কারণে কৃষিজীবী পরিবারের মানুষ অনেক বেশি হারে বিদেশমুখী হয়েছে৷ মেঘনা গুহঠাকুরতা মনে করেন, প্রধানত এ কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়ার দেশ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড বা ইউরোপের কয়েকটি দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে জীবন বাজি রাখছেন৷ সমুদ্রে ডুবে অনেকে মারাও গেছেন৷
সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং থাইল্যান্ডে যাওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জণগোষ্ঠীর মানুষ৷ তাদের অনেকেই মিয়ানমার ছাড়তে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ থেকে আরো নিরাপদ এবং উন্নত জীবনের আশায় তারা অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন৷ সমুদ্রপথে অবৈধভাবে এবং সবচেয়ে কম খরচে যাওয়া যায় বলে তারা দালালের মাধ্যমে সেই পথেই চেয়েছিলেন মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং আশেপাশের দেশগুলোতে যেতে৷ রোহিঙ্গাদের এমন বিদেশ যাত্রায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং দালালদের প্রলোভনে বাংলাদেশের কৃষিজীবী পরিবারের সন্তানরাও একইভাবে দেশ ছাড়তে মরিয়া হয়ে উঠছেন৷
মেঘনা গুহঠাকুরতা
বার্লিনে ডয়চে ভেলে বাংলা বিভাগের দেবারতি গুহকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মেঘনা গুহঠাকুরতা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বর্তমান অবস্থা নিয়েও কথা বলেছেন৷ তিনি জানান, সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৩০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা বৈধভাবে বাংলাদেশে আছে৷ তবে তার চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা অবৈধভাবে, অর্থাৎ সরকারি নথিতে নাম অন্তর্ভুক্ত না করিয়ে গ্রামে-গঞ্জে থাকছে৷ সরকার সম্প্রতি যে ‘স্ট্র্যাটেজি পেপার' প্রকাশ করেছে সেখানে এভাবে অবৈধভাবে গ্রামে-গঞ্জে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৩ থেকে ৫ লক্ষ হতে পারে বলে বলা হয়েছে৷
শহিদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার সন্তান মেঘনা গুহঠাকুরতা জানান, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগই থাকছেন বৃহত্তর কক্সবাজারের দুটি উপজেলা টেকনাফ আর উখিয়ায়৷
ইন্দোনেশিয়ায় রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশিদের জীবন
সাগরে মানব পাচারকারীদের অত্যাচার সহ্য করে, দীর্ঘদিন অনাহারে, অর্ধাহারে থেকে, অবশেষে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছেন তাঁরা৷ আচেহ রাজ্যে পৌঁছানো রোহিঙ্গা এবং দরিদ্র বাংলাদেশিদের জীবন কীভাবে কাটছে সেখানে? দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Reuters/Beawiharta
নাম, পরিচয় লেখানো
ইন্দোনেশিয়ার জুলক গ্রামে পৌঁছানোর পরই তাঁদের লাইনে দাঁড়াতে হলো৷ নাম, ঠিকানা সব লিখিয়ে তবেই নিস্তার৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
রোগযন্ত্রণা
কুটা বিনজের জুলোক গ্রামে অনেকে এসেছেন হাঁটাচলার শক্তি হারিয়ে৷ এতদিন সাগরে ভেসেছেন নামমাত্র খেয়ে আর মানব পাচারকারীদের অকথ্য নির্যাতন সহ্য করে৷ স্থলে পৌঁছানোর আগেই নানা ধরণের অসুখে আক্রান্ত তাঁরা৷ শয্যাশায়ী একজনকে কোলে নিয়েছেন একজন, পাশেই আরেকজন তৃষ্ণা মেটাচ্ছেন গলায় একটু পানি ঢেলে৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
শান্তি
নৌযানে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে এতদিন৷ ভালো করে বসে একটু বিশ্রাম নেয়ারই উপায় ছিল না, আরাম করে নাওয়া-খাওয়া তো দূরের কথা৷ ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশে একটা বাথটাবের দেখা পেতেই তাই গোসল শুরু করলেন কয়েকজন৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
ক্ষুধার্ত শিশু
এক শিশুর হাতে বিস্কুট তুলে দিচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার এক স্বেচ্ছাসেবী৷ খুব কাছ থেকে বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে আছে আরেক শিশু৷ চোখই বলছে, অনেকদিন পর ভালো খাবারের দেখা পেয়েছে শিশুটি!
ছবি: Reuters/Beawiharta
শান্তির বারি
তৃষ্ণার্ত সন্তানের মুখে মায়ের হাতের পানি৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা
কোলের শিশুকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন এক নারী৷ ইন্দোনেশিয়ায় শুরু হলো দুজনের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা৷
ছবি: Reuters/Beawiharta
6 ছবি1 | 6
কিন্তু বাংলাদেশ সরকার কি মিয়ানমার ছেড়ে আসতে বাধ্য হওয়া রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে? মেঘনা গুহঠাকুরতা জানালেন, এ বিষয়ে আগের চেয়ে অনেক উদ্যোগী ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ সরকার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘বাংলাদেশ সরকার এতদিন এক অর্থে তাদের (রোহিঙ্গা) কোনো স্বীকৃতিই দিত না, কিন্তু ইদানীং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে যে টাস্কফোর্স গঠিত হয়েছে, সেই টাস্কফোর্স রোহিঙ্গাদের গণনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এখন গণনা পর্যায়ের প্রথম অংশটা শেষ হয়েছে, দ্বিতীয় অংশটাও শেষ হবে৷''
গণনা করে কী হবে? তাদের কি সাহায্য-সহযোগিতা করা হবে? মেঘনা গুহঠাকুরতা বললেন, ‘‘মুশকিল হলো, রোহিঙ্গারা একেবারে নিরূপায় অবস্থায় থাকবে তা যেমন হয় না, আবার খুব বেশি সাহায্য দিলেও এক ধরণের সমস্যা দেখা দাতি পারে, তখন আরো বেশি রোহিঙ্গা আসতে পারে মিয়ানমার থেকে৷ এমন একটা ভয়ও আছে৷ সে কারণে শুধু পয়ঃনিষ্কাশন, পানির সরবরাহ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার মতো মৌলিক ও জরুরি কিছু সহায়তা দেয়া হবে৷''
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর কথা
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক মানবাধিকার সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, বিশ্বে এ মুহূর্তে অন্তত ৫ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ কোনো-না-কোনো কারণে দেশছাড়া, অর্থাৎ শরণার্থী৷ তাঁদের নিয়েই আজকের ছবিঘর৷
ছবি: Reuters/D. Whiteside
শরণার্থী কারা?
ইউএনএইচসিআর-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কেউ যদি জাতি, ধর্ম, গোষ্ঠী বা কোনো শ্রেণিগত বৈষম্য কিংবা কোনো মতপার্থক্যের কারণে ভীত হয়ে নিজের ঘর বা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন, তাহলে তিনি শরণার্থী৷ প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া মানুষদেরও শরণার্থী হিসেবে গণ্য করে ইউএনএইচসিআর৷ ছবির এই শিশু তুরস্কে আশ্রয় নেয়া সিরীয় শরণার্থী৷
ছবি: Getty Images/AFP/B. Kilic
সহিংসতার কারণে গৃহহারা
ইউএনএইচসিআর-এর প্রতিবেদন বলছে, এ মুহূর্তে বিশ্বের কমপক্ষে ৫ কোটি ১০ লাখ মানুষ সহিংসতার কারণে শরণার্থী৷ সহিংসতা বা বিরোধের কারণে ঘর ছেড়ে নিজের দেশেরই অন্য কোথাও আশ্রয় নেয়া মানুষদেরও রাখা হয়েছে এই হিসেবে৷ ওপরের ছবির মানুষগুলো আফ্রিকার দেশ ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর, সেনাবাহিনীর এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর রুৎশুরু শহরের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হন তাঁরা
ছবি: Getty Images/AFP/J. D. Kannah
রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী
অনেকেই অন্য দেশে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন৷ সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় তাদের বেশির ভাগই হয়ে যান শরণার্থী৷
ছবি: picture-alliance/dpa/H. Schmidt
সংখ্যাধিক্যই বড় সমস্যা
শরণার্থী সমস্যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই বড় সংকট হয়ে উঠছে৷ শরণার্থীদের সংখ্যা এত দ্রুত বাড়ছে যে সংকটের আশু নিরসন দুরূহ হয়ে পড়ছে৷ পরিসংখ্যান বলছে, এ মুহূর্তে মোট শরণার্থীর সংখ্যা স্পেন, ক্যানাডা বা দক্ষিণ কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি!
ছবি: Getty Images/AFP/A. Pizzoli
আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং সোমালিয়া
২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বের মোট শরণার্থীর শতকরা পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি ছিল আফগান, সিরীয় এবং সোমালীয়৷ অর্থাৎ এই তিন দেশের মোট শরণার্থী বিশ্বের মোট শরণার্থীর অর্ধেকেরও বেশি৷ ছবিতে পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া এক আফগান পরিবার৷
ছবি: Majeed/AFP/Getty Images
স্বদেশেই শরণার্থী
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, অন্য দেশে আশ্রয় নেয়া মানুষের চেয়ে নিজের দেশেই শরণার্থী হয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি৷ ২০১৩ সালে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন ১ কোটি ৬৭ লাখ মানুষ, অন্যদিকে নিজের দেশে গৃহহারার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৩৩ লাখ৷
আশ্রয় শিবিরের বাইরে...
সব শরণার্থী কিন্তু আশ্রয় শিবিরে থাকেন না৷ বরং বিশ্বের মোট শরণার্থীর তিন ভাগের দুইভাগই বাস করছেন আশ্রয় শিবিরের বাইরে৷ শহর বা গ্রামের কোনো ফাঁকা জায়গায়, কিংবা কোনো অ্যাপার্টমেন্টে গাদাগাদি করে থাকতে দেখা যায় তাঁদের৷
ছবি: Getty Images/AFP/Z. Abubeker
শিশুদের দুর্বিষহ জীবন
মোট শরণার্থীর শতকরা ৪৬ ভাগই শিশু৷ ঘরছাড়া এই শিশুদের জীবনে লেখাপড়া নেই, কোনো সাধ-আহ্লাদও নেই৷ ছবির এই মা, শিশু সিরিয়ার৷ গ্রিসের লেসবসে আশ্রয় নিয়েছে তারা৷
ছবি: Getty Images/AFP/L. Gouliamaki
নির্যাতনের শিকার
৫ কোটি ১০ লাখ শরণার্থীর অন্তত ৩৫ ভাগই কোনো-না-কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার৷ শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকারদের অনেকেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না৷ যু্দ্ধ আর নির্যাতনের আতঙ্ক অনুক্ষণ তাড়া করে তাঁদের!
ছবি: JAMES LAWLER DUGGAN/AFP/GettyImages
শেষ আশ্রয় যুক্তরাষ্ট্র!
সহিংসতা বা বিরোধের কারণে একবার দেশ ছাড়লে খুব কম মানুষই আবার নিজের দেশে ফিরতে চান৷ অথচ যে দেশে থাকতে চান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে দেশ তাঁদের দায়িত্ব নিতে চায় না৷ এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়প্রার্থীদের নতুন কোনো দেশে পাঠানোর চেষ্টা করে ইউএনএইচসিআর৷ তবে খুব কম শরণার্থীই সেই সুযোগ পায়৷ তবে এমন শরণার্থীদের সবচেয়ে বেশি আশ্রয় দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ সংখ্যাটা অবশ্য নগন্য, বিশ্বের মোট শরণার্থীর মাত্র ১ শতাংশ!