1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জীবন

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭

জাতিসংঘের মতে, এ মুহূর্তে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী৷ এই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করছে কয়েক দশক ধরে৷ কেমন আছেন তাঁরা বাংলাদেশে?

Bangladesch Rohingya Flüchtlinge in Kutupalong Flüchtlingslager
ছবি: picture-alliance/NurPhoto/T. Chowdhury

মিয়ানমারে রাখাইন প্রদেশে এই রোহিঙ্গাদের বসবাস৷ তাঁদের অধিকাংশই মুসলিম৷ ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়রিতে মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সেখানকার পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল৷ সরকারের উচ্চ পদেও তাঁদের দেখা গেছে৷ কিন্তু ১৯৬২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল নে উইন ক্ষমতা দখল করার পর থেকে নিজ দেশে পরবাসী হয়ে পড়ে রোহিঙ্গারা৷ সামরিক সরকার তাঁদের ‘বিদেশি' হিসেবে অভিহিত করে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়৷ শুরু হয় তাঁদের উচ্ছেদ এবং নির্মূল করার প্রক্রিয়া৷ নে উইন তাঁদেরকে দমনের জন্য দুই দশকব্যাপী সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন৷

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ১৯৭৮ সালে নাগামান ( ড্রাগন রাজা) নামে এক অভিযান চালায় রাখাইন প্রদেশে৷ সেনাবাহিনীর অত্যাচার নির্যাতনের ফলে তখন মুসলিম রোহিঙ্গারা সেখান থেকে পালাতে শুরু করে৷ তখন প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে৷

কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং অনিবনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পের চেয়ারম্যান আবু সিদ্দিক ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘নে উইন ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই আমাদের ওপর দুর্যোগ নেমে আসে৷ নাগরিকত্ব বাতিলের পর বিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়, যাতে রোহিঙ্গারা সংখ্যায় বাড়তে না পারে৷ আমাদের জাতিপরিচয় মুছে ফেলার তৎপরতা ছিল সার্বক্ষণিক৷ আমরা রোহিঙ্গা৷ কিন্তু আমাদের কখনো নাম দেয়া হয়েছে ‘কোলা ব্যাঙ', কখনো রোহাং আর কখনো রাখাইন৷ মিয়ানমার স্বাধীন হওয়ার পর সংসদে আমাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল৷''

দুদু মিয়া

This browser does not support the audio element.

১৯৭৮ সালে মিয়ানমারে অবৈধভাবে বসবাসরত ‘বিদেশি' নাগরিকদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়৷ কিন্তু মূল টার্গেট ছিল মুসলিম রোহিঙ্গা বিতাড়ন৷ এরপর ১৯৯১-৯২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ধর্মীয় দাঙ্গার শিকার হন রোহিঙ্গা মুসলমানরা৷ এরপর ২০১২ সালে আবারও দাঙ্গার শিকার হন রোহিঙ্গারা ৷ আর সর্বশেষ গতবছরের অক্টোবর মাস  থেকে চলছে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন৷

কক্সবাজারের অনিবন্ধিত লেদা ক্যাম্পের চেয়ারম্যান দুদু মিয়া রাখাইনের মংডু জেলা থেকে বাংলাদেশে আসেন ২০০৩ সালে৷ তিনি তাঁর পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলেকে দুদু মিয়া বলেন, ‘‘আমরা অংসান-এর শাসনামল পর্যন্ত ভালো ছিলাম৷ এরপর নে উইনের সময় আমাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়৷ আমাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র ছিল৷ পরে তা কেড়ে নিয়ে সাদা রংয়ের এক ধরণের পরিচয়পত্র দেয়া হয়৷ আর তাতে আমাদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে উল্লেখ করা হয়৷''

তিনি আরো জানান, ‘‘১৯৯২ সালের পর থেকে অন্তত ৬ বার আমাদের ওপর প্রকাশ্যে অভিযান চালানো হয়৷ প্রতিবারই শত শত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়৷ নানা সময়ে আমাদের ভূমির অধিকার কেড়ে নেয়া হয়৷ ঘর-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়৷''

‘রোহিঙ্গা ও নগারিকত্ব' বিষয়ক গবেষক এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রেজাউর রহমান লেনিন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তিনশ' বছরেরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গরা মিয়ানমারের আরাকান অঞ্চলের বাসিন্দা৷ যে আরাকান এখন রাখাইন রাজ্য নামে পরিচিত৷ ব্রিটিশ কলোনির সময় রোহিঙ্গারা ওই এলাকায় ছিলেন৷ ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিতর্কিত সিটিজেনশিপ আইনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে পুরোপুরি অস্বীকার করে৷''

রেজাউর রহমান লেনিন আরো বলেন, ‘‘রোহিঙ্গাদের ভাষা এবং সংস্কৃতি আলাদা বলেই মনে হয়৷ মিয়ানমারে ১৩৫টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী আছে৷ কিন্তু রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয়া হয় না৷''

রেজাউর রহমান

This browser does not support the audio element.

এ প্রসঙ্গে দুদু মিয়া বলেন, ‘‘আমাদের স্বীকৃতি দেয়া হয়না , কারণ, আমরা মুসলমান৷ সেখানে বৌদ্ধরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেছে৷''

২০১৫ সালের নির্বাচনে নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী নেত্রী অং সান সু চি ক্ষমতায় আসেন৷ আশা করা হয়েছিল রোহিঙ্গাদের প্রতি তাঁর সহানুভূতি থাকবে৷ কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি৷ তিনিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক মনে করেন না৷  তবে গত বছর ৯ সদস্যের রাখাইন কমিশন বা কফি আনান কমিশন গঠন করা হয়৷ তাঁরা এক বছর সময় নিয়ে কাজ করছেন৷ তাঁদের প্রতিবেদনের পর কী হয় তা দেখার অপেক্ষায় আছেন রোহিঙ্গারা৷

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের রেজিস্টার্ড ক্যাম্প দু'টি৷ কক্সবাজারের কুতুপালং ও নয়াপড়া ক্যাম্প৷ এই দু'টি ক্যাম্পে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করেন৷ এছাড়া লেদা ও কুতুপালং এলকায় আরো কয়েকটি আনরেজিষ্টার্ড ক্যাম্প আছে৷ রোহিঙ্গা শরণার্থী নেতা দুদু  মিয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন কমপক্ষে চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আছে৷ এক সময় আরাকানে ৪০ লাখ রোহিঙ্গা ছিল, এখন আছে আট লাখ৷ নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও উচ্ছেদের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছাড়াও সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও অষ্ট্রেলিয়াসহ পৃথিবীর আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পরেছে৷''

গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমার সীমান্ত চৌকিতে আক্রমনে মিয়ানমারের ৯ পুলিশ নিহত হয়৷ এই ঘটনায় সাত হামলাকারীও নিহত হয়৷ এরপর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী নিরীহ রোহিঙ্গাদের ওপর আক্রমণ চালায়৷ ৯ অক্টোবরের পর মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী রাখাইন প্রদেশে মুসলিম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর হামলা শুরুর পর থেকে শতাধিক নিহত ও হাজার হাজার রোহিঙ্গা গৃহহারা হয়েছে৷ এর মধ্যে প্রায় ৭০,০০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘বিচ্ছিন্নতাবদী ও সন্ত্রাসী' কার্যকলাপের অভিযোগ আছে মিয়ানমারের৷ ৯ অক্টোবরের হামলার জন্য মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের দায়ী করছে৷ অন্যদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ‘আকামুল মুজাহিদীন (এএমএম)' নামে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার খবরও পাওয়া যাচ্ছে৷ এছাড়া সেখানে রোহিঙ্গা সলিডাটিরি অর্গানাইজেশন, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স, আরাকান রিপালিকান আর্মিসহ নানা সশস্ত্র সংগঠনের নাম শোনা যায়৷

কিন্তু রোহিঙ্গাদের ওপর বছরের পর বছর ধরে যে নির্যাতন-নিপীড়ণ চলছে তা গণহত্যার মতো বলে মনে করে জাতিসংঘ৷ রোহিঙ্গারা রাখাইন রাজ্যে হত্যার শিকার হচ্ছেন৷ কেউ জঙ্গলে পালিয়ে আছেন৷ কেউবা পালাতে গিয়ে নদীতে ডুবে মারা যাচ্ছেন৷ আর যাঁরা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসেবে আছেন, তাঁদের মধ্যে রেজিষ্টার্ড রোহিঙ্গারা কিছু সহায়তা পান, বাকিরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন৷

সর্বশেষ নির্যাতনের শিকার হয়ে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের কেউ কেউ ভিক্ষা করতেও বাধ্য হচ্ছেন৷

আবু সিদ্দিক

This browser does not support the audio element.

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া কফি আনান কশিনের সদস্যরা বলেছেন, ‘‘মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আসা ৮০ শতাংশ নারী মিয়ানমারেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷''

বাংলাদেশ সরকার বরারই এখানে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিক রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার দাবি করে আসছে৷ আর ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত তাঁদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নোয়াখালীর ঠ্যাঙ্গার চরে রাখতে চাইছে৷  রোহিঙ্গা শরণার্থী আবু সিদ্দিক বলেন, ‘‘বাংলাদেশ আমাদের জন্য আর কত করবে? আমারা আমাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ