1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘শিক্ষকের মর্যাদা’, মর্যাদাহানির ‘লজ্জা’

হারুন উর রশীদ স্বপন, ঢাকা৬ জুন ২০১৬

বাংলাদেশে শিক্ষকদের মর্যাদাহানির কিছু ঘটনা ঘটেছে৷ শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় কি এমন ত্রুটি আছে যা এমন ঘটনার জন্য দায়ী? পরিবর্তিত সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক্ষেত্রে শিক্ষকদেরই বা দায় কতটুকু?

Imtaz Rahman Inu Bangladesch Aktivist Arbeit mit Drogensüchtigen
ছবি: I.Rahman Inu

গত বছরের শেষ দিকে সরকার যখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নতুন বেতন স্কেল ঘোষণা করে,বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তখন আন্দোলনে নামতে হলো৷ মূল সমস্যা বেতন স্কেল নিয়ে হলেও শিক্ষক নেতারা তখন বলেছেন, ‘‘এটা যতনা বেতন বৈষম্যের প্রশ্ন, তার চেয়ে বড় হলো মর্যাদার প্রশ্ন৷'' এমনটি বলার কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তখন বেতন স্কেলে সচিবদের নীচে রাখা হয়েছিল৷ শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই ‘মর্যাদা বিষয়ক' জটিলতার অবসান ঘটে৷ ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫ ভাগ অধ্যাপক সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার হবেন' – বলে নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়৷ তবে এখনো সিনিয়র সচিব মর্যদায় শিক্ষকদের কোনো অবস্থান নির্ণয় করা হয়নি৷ এ বিষয়টি নিয়ে এখনো হতাশা আছে৷

গত ১৩ মে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির গুজব ছড়িয়ে প্রকাশ্যে কান ধরে উঠবস করার শাস্তি দেয়া হয়৷ স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান নিজে উপস্থিত থেকে এই শাস্তি কার্যকর করেন৷ শুধু তাই নয়, ওই শিক্ষক হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তাঁকে সাময়িক বরখাস্তও করা হয়৷

ড. নজরুল ইসলাম

This browser does not support the audio element.

এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলে তদনন্তের ভিত্তিতে শিক্ষককে তার পদে পুনর্বহাল করা হয়৷ শিক্ষামন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ধর্ম নিয়ে অবমননাকর বক্তব্যের অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি৷ তারপরও শিক্ষককে কান ধরে উঠবস যারা করিয়েছেন, তাদের এখনো শাস্তির আওতায় আনা হয়নি৷

এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ধামরাইয়ে লাঞ্চিত হন এক প্রধান শিক্ষিকা৷ শিক্ষিকাকে মারধর করায় স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতাকে অবশ্য ঘটনার পরপরই গ্রেপ্তার করা হয়৷

তারপর ৩০ মে ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে লেখায় লাইক দেয়ার অভিযোগে বগুড়ার শেরপুরে সুঘাটা ইউনিয়নের কল্যাণী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিপ্লব কুমার রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়৷ এরপর থেকে তিনি এলাকাছাড়া৷ ফেসবুকের কথিত ওই স্ট্যাটাসে তিনি আদৌ ‘লাইক' দিয়েছেন কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়েই উত্তেজিত স্থানীয়দের শান্ত করার কথা বলে বরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷

শিক্ষক অবমাননার ঘটনাগুলোর পেছনে তিনটি বিষয়ের ভূমিকা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়৷ এক, শিক্ষকদের আর্থিক অস্বচ্ছলতা, দুই, ব্যবস্থাপনা কমিটিতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব এবং তিন, রাজনৈতিক ও সামাজিক অসহিষ্ণুতা৷

বাংলাদেশে প্রধানত চারধাপে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় ৷ প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা৷ সাধারণভাবে শিক্ষার ধারা আবার তিনটি – মাদ্রাসা শিক্ষা, সাধারণ শিক্ষা এবং ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা৷ ব্যবস্থাপনার দিক থেকেও সরকারি এবং বেসরকারি, অর্থাৎ দু’রকমের শ্রেণিকরণ৷

শিক্ষকদের বেতন কাঠামোও একরকম নয়৷ প্রতিবেদনের শুরুতেই পাবালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনকাঠামো নিয়ে কথা হয়েছে৷ দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুনির্দিষ্ট কোনো বেতন কাঠামো নেই৷ কেউ উচ্চ বেতনভোগী, আবার কেউ কম বেতনে কায়ক্লেশে জীবন যাপনে বাধ্য৷ বিষয়টি মূলত নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক অবস্থার ওপর৷

কলেজ পর্যায়েও সরকারি এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষদের বেতনে পার্থক্য রয়েছে৷ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুওলোর শিক্ষকদেরও একই অবস্থা৷

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৫২০০ টাকা আর প্রশিক্ষণবিহীনদের ৪৯০০ টাকা৷ এমপিওভুক্ত এবং এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও আলাদা হিসাব৷ যাঁরা এমপিওভুক্ত নন, তাঁরা বেতনই পান না৷

আগে আশ্বাস দেয়া হলেও এবারের প্রস্তাবিত বাজেটেও এমপিওভুক্ত নন এমন শিক্ষকদের জন্য কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি৷ এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে আছেন৷

বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল ও কলেজ পরিচালিত হয় ব্যবস্থাপনা কমিটি'র মাধ্যমে৷ তাদের হাতেই থাকে শিক্ষকা নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা৷ আর ব্যবস্থাপনা কমিটিতে এখন আর কোনো শিক্ষানুরাগী থাকেননা৷ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সব পদ দখল করে আছেন সংসদ সদস্য বা অন্য কোনো প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা এবং ব্যবসায়ীরা৷ নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে ব্যবস্থাপনা কমিটিই সাময়িকভাবে বরখাসস্ত করেছিল৷ কমিটির চেয়ারম্যান চাইছিলেন তার এক আত্মীয়কে প্রধান শিক্ষক করতে৷ জানা যায়, এ নিয়েই কমিটির সঙ্গে বিরোধ আর সে কারণেই ধর্ম অবমাননার গুজবের সুযোগে শ্যামল কান্তিকে কান ধরে উঠবস করানো হয়

বাংলাদেশে এ মুহূর্তে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয় মোট ৮২ হাজার ৯৮২টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৫৩ হাজার ৫৮৯টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৪ হাজার ৪৯৪টি, মাদ্রাসা ৯০ হাজার ১০৫টি এবং ২ হাজার ৩০০টি কলেজ রয়েছে৷ এর বাইরে আছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷

প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য ভোটের মাধ্যমে ব্যস্থাপনা কমিটি নির্বাচনের বিধান রয়েছে৷ ফলে নির্বাচনের নামে প্রভাবশালীরাই কমিটিগুলোর নানা পদ দখল করে আছেন৷ ভর্তি এবং ‘উন্নয়নমূলক কাজ' তাদের নিয়ন্ত্রণেই হয়৷ ফলে কমিটির প্রধান বা সদস্য হওয়া লাভজনক ব্যবসা৷ তবে গত সপ্তাহে হাইকোর্ট কলেজগুলোর ব্যবস্থপনা কমিটির প্রধান হিসেবে স্থানীয় সংসদ সদস্য থাকার বিধানটি বাতিল করেছে৷

ব্যবস্থাপনা কমিটি বা গভর্নিং কমিটির নির্বাচনে প্রার্থীরা কোটি টাকাও খরচ করেন৷ পেস্টার ছাপেন৷ প্রচুর টাকা খরচ করে চালান প্রচারণা৷ কারণ নির্বাচিত হতে পারলেই অনেক টাকার হাতছানি৷ তাদের হাতেই এখন শিক্ষকরা জিম্মি৷ আর এই কারণেই শিক্ষকরা এখন স্থানীয় প্রভাবশালীদের করুণার পাত্রে পরিণত হয়েছেন৷ তাদের মর্যাদা নির্ভর করে ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং তাদের স্বার্থ রক্ষার ওপর৷ তাছাড়া ব্যবস্থাপনা কমিটির নেতারা যেহেতু স্থানীয় রজনীতির সঙ্গে জড়িত তাই তারা শিক্ষকের মর্যাদার চেয়ে ভোটারদের অনেক ক্ষেত্রে ভোটারদের মতামতকেই প্রাধান্য দেন নৈতিকতা বা সত্য-মিথ্যা যাচাইয়ের বিষয়টি আমলে না নিয়ে৷ তাই শিক্ষককে বরখাস্ত করার ঘটনাও ঘটে কথিত উত্তেজিত লোকজনের চাপের কারণে৷

একেএম মাকসুদুল কামাল

This browser does not support the audio element.

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান, শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা এক ধরণের সামাজিক সঙ্কটের মধ্যে আছি৷ শিক্ষকের মর্যাদার ঐতিহ্যবাহী ধারণা বদলে গেছে৷ এর প্রধান কারণ শিক্ষার নিয়ন্ত্রক এখন আর শিক্ষাবিদরা নন৷ এর নিয়ন্ত্রণ এখন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের হাতে৷ দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেও শিক্ষকদের অপমানজনক কথা বলা হয়, যার প্রভাব পড়ে সার্বিকভাবে৷''

তিনি আরো বলেন, ‘‘শিক্ষকের মর্যাদা শুধু সামাজিক মর্যাদার ওপর নির্ভরশীল নয়, আর্থিক বিষয়টিও গুররুত্বপুর্ণ৷ এখন দুই দিক থেকেই তাঁরা অমর্যাদার শিকার৷''

শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি আবার শিক্ষকদের গ্রহণযোগ্যতার ওপর, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ওপরও নির্ভর করে বলে তিনি মনে করেন৷

তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এ-ও বলেছেন যে, ‘‘যারা শিক্ষকদের অমর্যাদা করেন তারা প্রভাবশালী, সাধারণ মানুষ নয়৷ আর এখন প্রভাশালীরা শিক্ষা ও শিক্ষক বান্ধব নয়৷''

বাংলাদেশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব অধ্যাপক ড. একেএম মাকসুদ কামালের সঙ্গে শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রব্যবস্থায় শিক্ষকদের মর্যাদার বিষয়টি স্পষ্ট নয়৷ শিক্ষানীতিতেও অস্পষ্ট৷''

তাঁর মতে, ‘‘শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি৷ এটাকে আলাদাভাবে বিচেনায় নেয়া হয়নি৷ তাই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ