বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল-কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটি নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন আছে৷ এ সব কমিটিতে শিক্ষানুরাগীদের ঠাঁই নেই৷ কমিটিগুলো পুরোপুরি স্থানীয় সংসদ সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের নেতা বা প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে৷
বিজ্ঞাপন
এর মূল কারণ, অনুদানের টাকা ভাগ-বাটোয়ারা ও ভর্তি বাণিজ্য৷ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে শিক্ষাবিদদের রাখা বাধ্যতামূলক করা উচিত৷ এ জন্য একটা নীতিমালা থাকা প্রয়োজন৷''
বাংলাদেশে সরকারি এবং বেসরকারি মিলিয়ে মোট প্রাথমিক বিদ্যালয় ৮২ হাজার ৯৮২টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৫৩ হাজার ৫৮৯টি, নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ৩৪ হাজার ৪৯৪টি, মাদ্রাসা ৯০ হাজার ১০৫টি এবং কলেজ ২,৩০০টি৷ এর বাইরে আছে মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য ব্যস্থাপনা কমিটি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনের বিধান রয়েছে৷ আর কলেজগুলোতে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা পদাধিকার বলে ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রধান৷
কিন্তু বিধানে কোথাও শিক্ষানুরাগীদের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রাখতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই৷ ফলে নির্বাচনের নামে প্রভাবশালীরা কমিটিগুলোর নানা পদ দখল করে আছেন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি মূলত সংসদ সদস্য, সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে৷ বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি এবং উন্নয়নমূলক কাজ তাদের নিয়ন্ত্রণেই হয়৷ ফলে এই কমিটির প্রধান বা সদস্য হওয়া লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়েছে৷
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
ব্যবস্থাপনা কমিটি বা গভর্নিং কমিটির নির্বাচনে প্রার্থীরা এখন লাখ লাখ টাকা খরচ করেন৷ পোস্টার ছাপেন৷ অনেক টাকা খরচ করে চালান প্রচারণা, কারণ, নির্বাচিত হতে পারলে অনেক লাভ৷
নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম অবমাননার অপবাদ দিয়ে কান ধরে উঠবস করানোর পেছনেও ছিল সেই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটি৷ স্কুলের অনুদান ৫০ লাখ টাকা ভাগ-বাটোয়ারায় বাধা দেয়ার কারণেই ব্যবস্থাপনা কমিটির লোকজন তার ওপর ক্ষুব্ধ হন৷ এর সঙ্গে যুক্ত হন কমিটির চেয়ারম্যান ফারুকুল ইসলাম৷ তিনি চাইছিলেন, তার এক আত্মীয়কে প্রধান শিক্ষক করতে৷ আর সবশেষে যোগ দেন সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান৷ তিনি ভোট আর রাজনীতির হিসেব মেলাতে শিক্ষকের অবমাননা করেন৷ জানা গেছে, ফারুকুল ইসলামসহ কমিটির কেউই শিক্ষানুরাগী নন৷ অবশ্য ওই কমিটি এখন বাতিল করা হয়েছে৷
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘বাংলাদেশের কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কামিটিতে এখন আর শিক্ষানুরাগী পাওয়া যাবে না, কারণ, শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তিবাণিজ্য আর উন্নয়নমূলক কাজে এখন অনেক টাকা৷ সেই টাকার লোভে কমিটিগুলো দখল করেছে রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা৷''
তিনি বলেন, ‘‘এ সব কমিটি শিক্ষার উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখে না৷ উল্টো তারা শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে অর্থ আয় করে৷''
তিনি বলেন, ‘‘এই অবস্থার অবসান হওয়া প্রয়োজন৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে যাতে শিক্ষানুরাগীরা থাকতে পারেন সেজন্য সরকারের নীতিমালা করে দেয়া উচিত৷ ভোট হতে পারে, তবে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা বেঁধে দিতে হবে৷''
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘‘আমরা শিক্ষক শ্যামল কান্তির ঘটনা হয়তো জানতে পেরেছি৷ কিন্তু অনেক ঘটনাই আমরা জানতে পারি না৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকরা ম্যানেজিং কমিটির হাতে জিম্মি৷ এমনকি কোনো কোনো ম্যানেজিং কমিটির বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, জমি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আছে৷''
শিশুদের নানা রকমের ক্লাসরুম
বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে শুরু হয় শিক্ষাজীবন৷ সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য শিশুদের শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই৷ চলুন দেখা যাক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রেণিকক্ষে শিশুদের কীভাবে লেখাপড়া শেখানো হয়৷
ছবি: picture-alliance/landov
বেশির ভাগ দেশের শ্রেণিকক্ষে যা থাকে...
বিশ্বের প্রায় সব দেশের শ্রেণিকক্ষেই চক আর ব্ল্যাক বোর্ড থাকে৷ শিক্ষক বা শিক্ষিকা সেই ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে শিক্ষার্থীদের বোঝান৷ শিক্ষার্থীরা বেঞ্চে বসে বসে শোনে৷ তবে অনেক দেশই এই সাবেকি ব্ল্যাকবোর্ড এবং চক ছেড়ে দিয়েছে৷ আবার এমন দেশও আছে, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই৷ মাটিতে বসেই লেখাপড়া করতে হয় তাদের৷
ছবি: AP
দক্ষিণ কোরিয়ায় ডিজিটাল বই...
দক্ষিণ কোরিয়ার স্কুলে এসে গেছে কম্পিউটার৷ ইন্টারনেট সংযোগও দেয়া হয়েছে প্রতিটি ক্লাসরুমে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের হাতে কোনো বই-খাতা থাকবে না৷ বইয়ের পরিবর্তে ‘ই-বুক’ দেয়া হবে তাদের৷ সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে সরকার৷ সবাইকে ডিজিটাল শিক্ষাদান পদ্ধতির আওতায় নিতে দরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে ‘ট্যাবলেট পিসি’ দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে৷
ছবি: AP
ঘানার শিশুদের অবস্থা
অনেক দেশের স্কুলে আবার কম্পিউটার তো দূরের কথা, ক্লাসরুমই নেই৷ আফ্রিকার দেশ ঘানার এই স্কুলটি দেখুন৷ ভবনই নেই! তাই গাছের ছায়াতেই নেয়া হচ্ছে ক্লাস৷ শিক্ষিকা পড়াচ্ছেন আর ছোটমনিরা বেঞ্চে বসে মন দিয়ে শুনছে তাঁর কথা৷
ছবি: Fotolia/Living Legend
জার্মানির অত্যাধুনিক ক্লাসরুম
জার্মানিতে কিন্তু ছোট ছোট বাচ্চারাও ক্লাসে পেন্সিল ব্যবহার করে না৷ নোট লেখার বইও নয়৷ টাচ প্যাড, স্মার্টবোর্ড, নেটবুক – এই সমস্ত আধুনিক জিনিসপত্র এ বয়সেই এসে গেছে তাদের হাতে৷
ছবি: AP
যুক্তরাষ্ট্রের স্কুল
শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শিশুদের শিক্ষা যেন বাড়তি চাপ৷ ছবির এই চার বছর বয়সি শিশুগুলোর মতো সব শিশুকেই বলতে গেলে মায়ের কোল থেকে নেমে ঢুকে পড়তে হয় স্কুলে৷ চাপ যে তখন থেকেই শুরু!
ছবি: AP
কেনিয়ার স্কুল এবং ক্লাসরুম
কেনিয়ায় শিক্ষাজীবনের প্রথম আট বছর শিক্ষার্থীদের কোনো বেতন দিতে হয় না৷ তারপরও লেখাপড়া করা সবার জন্য খুব সহজসাধ্য নয়৷ দরিদ্র পরিবারের বাবা-মায়েরা বই-খাতা, পেন্সিল, পোশাক, জুতো ইত্যাদির খরচ জোগাতে পারেন না বলে অনেক শিশুকেই লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়৷
ছবি: DW/J.Bruck
ব্রিটেনের স্কুলে ‘ইউনিফর্ম’ বাধ্যতামূলক
ইংল্যান্ডের প্রায় সব স্কুলেই শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত পোশাক পরতে হয়৷ সবাই এক রকম পোশাক পরলে শিক্ষার্থীদের চিনতে সুবিধা হয় এবং তাদের পড়াশোনাতেও মন বসে – এমন কিছু যুক্তিতেই শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট পোশাক পরার নিয়ম মানছে স্কুলগুলো৷ তবে ব্রিটেনে একটা সুবিধা আছে৷ দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ হিসেবে অনুদান দেয়া হয়৷ ফলে দরিদ্ররা চাইলেই ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
পাকিস্তিনে অবহেলিত শিক্ষাখাত
পাকিস্তানে গত কয়েক বছর ধরে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে৷ ফলে শিক্ষার হার আরো কমছে, কমছে স্কুলও৷ ওপরের ছবিতে একটি পার্কে লেখাপড়া করতে দেখা যাচ্ছে শিশুদের৷ পাকিস্তানে এমন দৃশ্য অপরিচিত নয়৷
ছবি: AP
দক্ষিণ সুদানে মেয়েরা বিপদে...
দক্ষিণ সুদানেও প্রায় একই অবস্থা৷ গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে রীতিমতো সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে৷ সে দেশের মাত্র ১৬ ভাগ নারী এখন কোনো রকমে পড়তে এবং লিখতে পারে৷ যুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে হাতে গোনা যে কয়েকটি স্কুল রক্ষা পেয়েছে, তার মধ্যে অনেকগুলোতে চেয়ার-টেবিল, বেঞ্চ নেই৷ বই-পত্রও নেই কিছু স্কুলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: dapd
উন্নতিশীল ব্রাজিলেরও করুণ অবস্থা
দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে ব্রাজিলে৷ কিন্তু তাতে দরিদ্রদের ভাগ্যের খুব একটা উন্নতি হচ্ছে না৷ গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলোতে তাই খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয় শিশুদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
এবং বাংলাদেশ...
২০১৩ সালের ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের সময় অসংখ্য স্কুলের ক্ষতি সাধন করা হয় বাংলাদেশ৷ এ বছর দীর্ঘদিন হরতাল, অবরোধ চলায় স্কুলগুলোও অনেক দিন বন্ধ ছিল৷ এক পর্যায়ে সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ক্লাস নিতে শুরু করে কিছু স্কুল৷ হরতাল-অবরোধের কারণে সপ্তাহের ৫-৬ দিন গৃহবন্দী, তারপর ছুটির দিনে স্কুলবন্দী৷ বাংলাদেশের শিশুদের অসহায়ত্ব ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন৷