এতদিন সন্দেহের মধ্যেই ছিল৷ ইন্টারপোল থেকে বার বার জানানো হচ্ছিল বাংলাদেশ পুলিশকে৷ কিন্তু এবার শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে সরাসরি জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বাংলাদেশে৷ আর ইতিমধ্যে তাদের নেয়া হয়েছে পুলিশ রিমান্ডে৷
বিজ্ঞাপন
সিআইডি যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে, তাঁদের প্রধান টিপু কিবরিয়া (৪৭) একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত৷ তবে তাঁর আসল নাম টিআইএম ফখরুজ্জামান৷ তাঁকে তাঁর মালিবাগের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ আটক অন্য দু'জন হলেন নুরল আমিন ওরফে নুরু এবং শাহারুল ইসলাম খান ওরফে মজু৷
সিআইডি-র বিশেষ পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল-এর তথ্যের ভিত্তিতে এই তিনজনকে আটক করা হয়েছে৷ তবে তাঁদের জঙ্গে জড়িত আরো একজনকে এখানো আটক করা যায়নি৷ তবে আটকের চেষ্টা চলছে৷
তিনি জানান, টিপু কিবরিয়া শিশুদের, বিশেষ করে ছেলে শিশুদের দিয়ে পর্নো ছবি তৈরি এবং তা দেশের বাইরে বিক্রি করে আসছিলেন৷ এ সব পর্নো ছবি দেশের বাইরে তাঁরা পাঠাতেন ইন্টানেটের মাধ্যমে৷ ঢাকার মুগদায় তাঁদের একটি স্টুডিও আছে৷ সেখানেই এ সব পর্নো ছবি তৈরি হতো৷ শুধু তাই নয়, দরিদ্র শিশুদের নানা প্রলোভন আর কৌশলে কাজে লাগানো হতো৷
সিআইডি মুগদায় তাঁদের স্টুডিও থেকে কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, সিপিইউ, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও শতাধিক পর্নো সিডি উদ্ধার করা করেছে৷ এছাড়া সেখান থেকে ১২ বছরের এক ছেলেকেও উদ্ধার করা হয় বলে জানান পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম৷ উদ্ধার করা শিশুটিকে নাকি সোমবার কমলাপুর থেকে ছবি তোলার কথা বলে নিয়ে এসেছিলেন টিপু৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷
ছবি: Getty Images/A. Joyce
9 ছবি1 | 9
সিআইডি-র অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, আটক চক্রটি জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ডে শিশুদের পর্নোগ্রাফি বিক্রি করত৷ পর্নোগ্রাফি বিক্রির জন্য যোগাযোগ ও টাকা লেনদেনের কাজ করতেন শাহারুল৷ এক জার্মান ও এক সৌদি নাগরিকের সঙ্গে তাঁর আর্থিক লেনদেনের প্রমাণ পেয়েছে সিআইডি৷
সিআইডি-র এই কর্মকর্তা জানান, ইন্টারপোল তাদের জানিয়ে আসছিল যে বাংলাদেশ থেকে শিশুদের পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচার হচ্ছে৷ ইন্টারপোল ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু পর্নোগ্রাফি বিদেশে পাচারের প্রমাণ পায়৷ তারা দীর্ঘদিন ধরে এ বিষয়ে নজরদারি করছিল৷ চলতি বছর ইন্টারপোল নিশ্চিত হয় যে, এগুলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে পাচার হচ্ছে এবং সেই ভিডিও দেখেই টিপু কিবরিয়াকে শনাক্ত করা হয়৷ ১৫ দিন আগে ইন্টারপোল সিআইডি-কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিলে, সিআইডি টিপু কিবরিয়ার অবস্থান করতে সমক্ষম হয়৷ এরপর তাঁকে গ্রেপ্তার করে বাকি দু'জনকে তাঁর দেয়া তথ্যমতে আটক করা হয়৷ টিপু কিবরিয়া শিশুদের নিয়ে ৫০টির ওপরে বই লিখেছেন৷ তিনি একজন ‘ফ্রিল্যান্স' আলোকচিত্রী৷
অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম জানান, ঐ চক্রের আরেক সহযোগিকে এখনো গ্রেপ্তার করা যায়নি৷ তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলে বাংলাদেশে শিশু পর্নোগ্রাফির ব্যাপারে আরো তথ্য পাওয়া যাবে৷ পলাতক এই ব্যক্তি মূলত শিশু জোগাড়ের কাজ করত৷ আর টিপু কিবরিয়া শিশু সাহিত্যিক এবং ফ্রিল্যান্স আলোকচিত্রী হওয়ার সুবাদে নিম্নবিত্ত শিশু এবং শিশু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সহজেই যোগাযোগ তৈরি করতে পারতেন৷
তিনি জানান, বাংলাদেশে এ ধরনের পর্নোগ্রাফির সঙ্গে আরো কোনো চক্র জড়িত থাকতে পারে৷ এই চক্রের সঙ্গে জড়িত আন্তর্জাতিক চক্রের পরিচয় তারা জানতে পেরেছেন এবং ইন্টারপোল-কে এ ব্যাপারে এরই মধ্যে তথ্য দেয়া হয়েছে৷
আটক তিনজনকে চার দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে ইতিমধ্যেই৷ তার মধ্যে নুরুল শিশু পর্নোগ্রাফিতে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে৷ বাকি দু'জনকে জিজ্ঞাসবাদ করা এখনও অব্যাহত৷ উদ্ধার করা শিশুটিও আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে৷ তাছাড়া আটক তিনজনের বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি আইনে মুগদা থানায় একটি মামলা করা হয়েছে৷