বাংলাদেশে সংবাদপত্র ও ছায়ানটে হামলায় পশ্চিমবঙ্গে উদ্বেগ
২০ ডিসেম্বর ২০২৫
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর পরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে৷ আক্রমণের শিকার হয় সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান- ছায়ানট৷
‘হামলার ঘটনা নির্বুদ্ধিতার প্রকাশ’
এপার বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টজনেরা বাংলাদেশের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন৷ সাহিত্য-সংস্কৃতি থেকে সাংবাদিকতার উপরে আক্রমণ নেমে আসায় তারা চিন্তিত৷
রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ছায়ানট দুই বাংলার অগ্রণী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান৷ ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে এটি গড়ে ওঠে৷ বৃহস্পতিবার রাতে এখানে হামলা চালিয়ে উন্মত্ত জনতা নষ্ট করে ফেলে অমূল্য কিছু সম্পদ৷ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র ভেঙে ফেলা হয়৷ নষ্ট করা হয়েছে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাতা, প্রয়াত শিল্পী সনজীদা খাতুনের পোর্ট্রেট৷
এই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় সঙ্গীতশিল্পী কবীর সুমন সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘যা ঘটেছে তা একেবারেই নিষ্ঠুর৷ বারবারই দেখা যাচ্ছে নির্বুদ্ধিতার আর মূর্খতার প্রকাশ৷ আরো চিন্তার বিষয়, কিছু মানুষ এই ধরনের আচরণকেই নিজেদের সর্বস্ব বানিয়ে নিচ্ছে৷ এই পরিস্থিতি সত্যিই লজ্জার এবং খুব ভয়ঙ্কর৷''
দুই বাংলার বিশিষ্ট নজরুল বিশেষজ্ঞ বাঁধন সেনগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এটা খুব জঘন্য এবং নিন্দনীয় কাজ৷ পৃথিবীতে চিরকালই এই জাতীয় কাজ যারা করেছে তারা হুলিগানস৷ প্রতিষ্ঠাতা সনজীদা খাতুনকে আমি চিনতাম৷ ওকে প্রথম দেখি বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ হাইকমিশনে৷ উনি গান গাইতে এসেছিলেন৷ তারপর ঢাকাতে বহুবার আমি গিয়েছি, অন্তত ২৭ বার৷ তার মধ্যে বছর ৫-৭ আগে ঢাকাতে ওরা আমাকে একটা সম্মান দিয়েছিলেন৷ আমি আশা করি, খুব শীঘ্রই ওখানকার যারা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ আছেন, তারা প্রতিষ্ঠানকে আবার এগিয়ে নিয়ে যাবেন৷''
পশ্চিমবঙ্গের অগ্রণী নজরুলগীতি শিল্পী ইন্দ্রাণী সেন ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যেকোনো রকমের রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকা এত বড় সঙ্গীত শিক্ষায়তন এভাবে তছনছ করে দেয়া, হারমোনিয়াম ভেঙে ফেলা, এটা ভাবা যায় না৷ খুব জঘন্য কাজ হয়েছে, আমি এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি৷''
সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘এটা আমি ভাবতে পারছি না৷ কল্পনারও অতীত৷ সনজীদা খাতুনের স্বপ্নের এই বাগান যেন কোনো দৈত্যের দল তছনছ করে দিল৷ ওখানে ছিল দুই বাংলার সংস্কৃতির বহু নিদর্শন৷ গত বছরেই গিয়েছিলাম৷ ওখানে দুই বাংলার সেতু গড়েছিলেন সনজীদা৷ এই ধ্বংসলীলায় যে বা যারা জড়িত, তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত৷''
দুই বাংলা একাকার হয়ে গিয়েছে সাহিত্যিক অমর মিত্রের লেখায়৷ তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এটা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার৷ আমার পূর্বপুরুষের আবাসস্থান ছিল৷ এখন সেই বাংলাদেশের পরিণতি দেখে শুধুই ভাবছি আমাদের দেশে যেন এরকম কিছু না হয়৷''
নাট্যকার বিভাস চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার চেষ্টা হচ্ছে৷ সংস্কৃতি যদি বেঁচে থাকে তাহলে তা দেশকে রক্ষা করে৷ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল সংস্কৃতির জন্যই৷ সাংস্কৃতিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রয়েছে৷ তার একটা নিজস্ব আইডেন্টিটি পাওয়ার জন্য সেই লড়াই চলেছিল৷ সেই আইডেন্টিটিটা যদি ধ্বংস হয়ে যায়, সেটা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷’’
শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের মধ্যেও বেদনা ও উদ্বেগ৷ কবিগুরুর পরিবারের সদস্য সুপ্রিয় ঠাকুর সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কতবার গিয়েছি, থেকেছি৷ কত মানুষের সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু এখন কী যে হচ্ছে! সনজীদাদির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল৷ তার বহু পরিশ্রম ও কষ্টে তৈরি ছায়ানটকে যদি এভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়, এর থেকে দুঃখের আর কিছু হয় না৷''
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী মোহন সিং খাঙ্গুরার বক্তব্য, ‘‘আমি বাংলাদেশে গিয়ে যখন এক মাস ছিলাম, তখন সে দেশের নানা প্রান্তে গান গেয়েছি৷ এমনকি ছায়ানটে বসে ছায়ানট রাগ গেয়েছি৷ অথচ এখন যা চলছে, তা শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি৷''
সংবাদমাধ্যমে হামলা ‘ন্যক্কারজনক’
বাংলাদেশের অগ্রণী পত্রিকা গোষ্ঠী প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ে হামলার সময়ে সাংবাদিকরা আটকা পড়েন৷ দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে অফিস৷
কলকাতা প্রেস ক্লাব এই ঘটনার নিন্দা করেছে৷ ক্লাবের সচিব, সাংবাদিক কিংশুক প্রামাণিক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘খুবই ন্যক্কারজনক ঘটনা৷ আমরা তীব্র ধিক্কার এবং নিন্দা জানাচ্ছি৷ সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকরা হচ্ছেন গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ৷ তাদের কাজে বাধা দেওয়া গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ৷ প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারে আমাদের পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষেরও সংবাদদাতা রয়েছেন৷ স্বভাবতই আমরা খুব উদ্বিগ্ন৷ আমরা লক্ষ্য করছি, বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যম আক্রান্ত হয়েই চলেছে৷ কলকাতা প্রেস ক্লাব আবেদন করছে ইউনুস সরকারের কাছে যে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, সংবাদ মাধ্যমের নিরাপত্তা আপনারা সুনিশ্চিত করুন৷''
সংবাদপত্রের দপ্তরে হামলার পাশাপাশি বাংলাদেশের খুলনায় সাংবাদিক ইমদাদুল হক মিলনকে হত্যার খবর সামনে এসেছে৷ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ, সাংবাদিক ও কবি মৃদুল দাশগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘সংস্কৃতির প্রতি যে ভক্তি, শ্রদ্ধা থাকা উচিত, তা তো দেখতে পাচ্ছি না৷ যে বয়সে বালকের মন সুস্থতার দিকে গড়ে ওঠে, শিক্ষা-সংস্কৃতির বোধ তৈরি হয়, সেই সময়ে তারা বেপথু হয়ে পড়ছে৷''
শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এটা অত্যন্ত বেদনার৷ দুটো খবরের কাগজের অফিস- প্রথম আলো এবং দ্য ডেইলি স্টার তো খুবই প্রতিষ্ঠিত৷ বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কাগজ৷ ফলে মিডিয়ার ওপর এই আক্রমণটা ধিক্কারযোগ্য নিঃসন্দেহে৷ আর ছায়ানট একটা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান যেটা বাংলাদেশের অহঙ্কার৷ সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ তারা নববর্ষে অনুষ্ঠান করেন, আবার রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন বলে একটা অনুষ্ঠান করেছেন, যাতে গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের শিল্পীদের শিক্ষা দেয়া হয় এবং তারা উঠে আসেন৷ বাংলাদেশে যে এত অসাধারণ রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাওয়া গেছে, তার মূলে অবদান ছায়ানটের৷ শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, আরও সব ধরনের বাংলা গানেরই ওরা চর্চা করে৷''
সিনিয়র সাংবাদিক সুদীপ্ত সেনগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘এটা অত্যন্তই উদ্বেগের বিষয়৷ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তেই যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন একজন সাংবাদিক হিসেবে, একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট হিসেবে আমি অত্যন্ত উদ্বেগ বোধ করি৷ বাংলাদেশে এমনিতেই একটা অস্থির অবস্থা চলছে৷ তার মধ্যে সংবাদমাধ্যমের যে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকার দরকার, সেরকম কোনো কিছুই ছিল না৷ পুলিশ-প্রশাসন খবর পাওয়ার পরেও যথেষ্ট দ্রুত ব্যবস্থা নেয়নি৷ যে গোষ্ঠী এই কাণ্ড ঘটিয়েছে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, তারা বাংলাদেশে ভাবনার দিক থেকে মোটেও সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, তারা সংখ্যালঘু৷ কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস সাধারণ মানুষের নেই৷ এটা খুব উদ্বেগের বিষয়৷ এখানেই স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের সব থেকে বিপদের জায়গা৷’’