গত মে মাসে সাইক্লোন রাওনু যখন সমুদ্র উপকূলের দিকে ধেয়ে আসছিল, দশ বছর বয়সি মোহাম্মদ হোসেন তখন বাবার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে৷ সমুদ্রে মাছ শিকারে যাওয়া বাবাকে সাইক্লোনের কথা জানিয়ে এসএমএস পাঠায় সে৷
বিজ্ঞাপন
জেলে রমজান আলী তখনও উপকূল থেকে এসএমএস পাওয়ার মতো দূরত্বে ছিলেন৷ ছেলের বার্তা তিনি দ্রুত অন্যান্য জেলেদের কাছেও পৌঁছে দেন৷ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দ্রুত ডাঙার দিকে ফিরে আসেন তাঁরা৷ ওদিকে কুতুবদিয়ার ছেলে হোসেন শুধু বাবাকে এসএমএস করেই ক্ষান্ত ছিল না৷ বরং সমুদ্র উপকূল থেকে মাত্র একশ মিটার দূরত্বে থাকা তার গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাইক্লোন ধেয়ে আসার কথা জানায় সে৷ আর তারপর নিজের পরিবার এবং এক শারীরিক প্রতিবন্ধীকে নিয়ে ছয় কিলোমিটার দূরের সাইক্লোন শেল্টারে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷
পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র হোসেন স্কুলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে শিখেছে৷ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতির মাত্রা কমাতে ‘সেইভ দ্য চিলড্রেন' এবং মানবিক সহায়তা বিষয়ক ইউরোপীয় কমিশন ইসিএইচও-র সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার শিশুদের বিশেষ এই শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে৷ ফলে এগারো বছর বয়সি তাসফিয়া সুলতানার মতো শিক্ষার্থীরা এখন স্কুল, মসজিদ বা অন্যত্র লাল পতাকা প্রদর্শনের মানে জানে৷ উপকূলীয় এলাকায় লাল পতাকা প্রদর্শনের অর্থ হচ্ছে একটি সাইক্লোন এগিয়ে আসছে৷ তবে কখনো একটি, কখনো একসঙ্গে দু'টি বা তিনটি পতাকা দেখানো হয়৷ সেসবেরও আলাদা আলাদা অর্থ এখন বোঝে শিক্ষার্থীরা৷
সাইক্লোনে ব্যাপক প্রাণহানি রোধে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ
সমুদ্র উপকূলের লাখ লাখ বাসিন্দা সোমবার তাদের এলাকায় ফিরে গেছেন৷ যদিও ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু অনেক ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও এবার প্রাণ হারিয়েছেন মাত্র ২৬ ব্যক্তি, যা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেশ কম৷
ছবি: Imago/Zuma Press
সপ্তাহান্তে হানা দেয় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু
শনিবার বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হানে সাইক্লোন রোয়ানু৷ তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ঘূর্ণিঝড়ের আগেই প্রায় বিশ লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে৷ কেউ কেউ কর্তৃপক্ষের আহ্বান সত্ত্বেও এলাকা ছাড়তে অপারগতা প্রকাশ করেন৷
ছবি: Imago/Xinhua
আশ্রয় কেন্দ্রে...
ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে নতুন নয়৷ তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে, বেড়েছে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগ৷ শনিবার রোয়ানুর সময় উপকূলের অনেক মানুষ তাই আশ্রয় নিয়েছেন সাইক্লোন শেল্টারে৷ উপকূলীয় অঞ্চল এবং দ্বীপগুলোতে পর্যাপ্ত না হলেও এরকম শেল্টারের সংখ্যা অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dp/K. Sumon
প্রয়োজন খাদ্য এবং অন্যান্য সহায়তা
রোয়ানুর আঘাতে প্রাণহানি কমানো গেলেও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রচুর৷ বিশেষ করে ঘরবাড়ি হারানো মানুষদের এখন প্রয়োজন জরুরী ত্রাণ সহায়তা৷ মহেশখালি দ্বীপের কাউন্সিল প্রধান মোহাম্মেদ উল্লাহ জানান, লক্ষাধিক লোক সোমবার তাদের ভিটেবাড়িতে ফিরেছেন৷ অনেকেই এখন খাদ্য সঙ্কটে রয়েছেন৷
ছবি: Getty Images/AFP
কমেছে প্রাণহানি
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে কয়েক লক্ষ মানুষ বাস করেন৷ ১৯৭০ সালে সাইক্লোনে প্রাণ হারিয়েছিল তিন লাখের মতো মানুষ৷ আর সর্বশেষ ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডরের আঘাতে তিন হাজারের মতো মানুষের প্রাণ যায়৷ সরকারি এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নেয়া বিভিন্ন কর্মকাণ্ড প্রাণহানি রোধে সহায়তা করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷
ছবি: Imago/Zuma Press
প্রয়োজন আরো উদ্যোগ
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবিলায় আরো উদ্যোগ প্রয়োজন, কেননা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝূর্ণিঝড়সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমান ভবিষ্যতে বাড়তে পারে৷ পাশাপাশি সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেলে উপকূলীয় এলাকা তলিয়েও যেতে পারে৷
ছবি: Imago/Zuma Press
5 ছবি1 | 5
একটি লাল পতাকার অর্থ হচ্ছে গ্রামের মানুষদের সাইক্লোনের কথা জানাতে হবে, দু'টি পতাকা দেখানোর অর্থ হচ্ছে সবাইকে নিজেদের বাড়ির মধ্যে আশ্রয় নিতে হবে আর তিনটি পাতাকার অর্থ হচ্ছে সাইক্লোন শেল্টার বা মজবুত অন্য কোনো আশ্রয়ে যেতে হবে, জানায় সুলতানা৷ সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের শিক্ষা পরিচালক জুলফিকার বুশরা জানান, বাংলাদেশের ৬৫,০০০ প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৩৫,০০০ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ আরো কয়েকহাজার অন্যান্য বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিতে চান তারা৷
উল্লেখ্য, ১৯৭০ সালে এক সাইক্লোনে বাংলাদেশে তিন লাখের বেশি মানুষ মারা যায়৷ ১৯৯১ সালে আরেক সাইক্লোনে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল এক লাখের বেশি৷ তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে সাইক্লোনে মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশ কমে এসেছে৷ ২০০৭ সালে সাইক্লোন সিডর আকারে বড় হলেও প্রাণহানির সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন হাজারের মতো৷ আর ২০০৯ সালে সাইক্লোন আইলায় প্রাণ হারায় চারশ'রও কম মানুষ৷
এআই/ডিজি (থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশন)
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ রোধে সরকারের তরফ থেকে কী করণীয়? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপে দ্বীপরাজ্য
প্রশান্ত মহাসাগরে ভানুয়াটুর মতো ছোট দ্বীপরাজ্যগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রকোপে, ঠিক যেমন বাংলাদেশ৷ সাগরের পানির উচ্চতা বাড়া আর আবহাওয়ার দুর্যোগের ফলে এই ধরনের দ্বীপরাজ্যগুলির অস্তিত্ব নিয়ে টান পড়েছে৷
ছবি: John Corcoran
প্যাম ঘূর্ণিঝড়ে ভানুয়াটু বিপর্যস্ত
ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার অবধি গতির ঝোড়ো বাতাস রাজধানী পোর্ট ভিলার বাড়িঘরের টিনের ছাদ উড়িয়ে দিয়েছিল এবং উপড়ে ফেলেছিল গাছ৷ প্যাম নামের ক্যাটেগরি ফাইভ সাইক্লোনটি এক সপ্তাহ আগে ভানুয়াটুর উপর আছড়ে পড়ে৷ দ্বীপরাজ্যের প্রেসিডেন্ট বল্ডউইন লন্সডেল-এর মতে, এ ধরনের ঘূর্ণিঝড়ের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যোগ আছে: ‘‘আমরা দেখছি, সাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে, আবহাওয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে৷’’
ছবি: Reuters/K. Paras
‘উন্নয়ন নিশ্চিহ্ন’
প্যাম ঘূর্ণিঝড় ছিল একটি ‘‘দানব’’, যা তাঁর দেশকে ধ্বংস করেছে – বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট লন্সডেল৷ ‘‘এটা ভানুয়াটুর সরকার ও জনসাধারণের জন্য একটি বিপর্যয়৷ এত সব উন্নয়ন ঘটার পর, তার সব কিছু নিশ্চিহ্ন হয়েছে’’, বলেন লন্সডেল৷ রাজধানীর ৯০ শতাংশ বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে৷ নিহতের সংখ্যা এ যাবৎ, সরকারিভাবে – ছয়, আহত ত্রিশের বেশি৷
ছবি: Reuters/K. Paras
প্যামের আঘাত
প্যাম ঘূর্ণিঝড় দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বহু দেশকে বিধ্বস্ত করেছে৷ জাতিসংঘের বিবৃতি অনুযায়ী, কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে আছে ভানুয়াটু, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, কিরিবাতি, ফিজি, তুভালু এবং পাপুয়া নিউ গিনি৷
ছবি: John Corcoran
শিশুরাই শিকার
অন্তত ৬০ হাজার শিশু এই ঘূর্ণিঝড়ে নিরাশ্রয় অথবা উদ্বাস্তু হয়েছে বলে ইউনিসেফ-এর ধারণা৷ পোর্ট ভিলায় যখন প্যাম এসে আঘাত হানে, ‘‘তখন যেন প্রলয় এসেছে বলে মনে হচ্ছিল’’, বলেছেন ইউনিসেফ-এর অ্যালিস ক্লিমেন্টস, যিনি সেই সময় অকুস্থলে ছিলেন৷
ছবি: Reuters/K. Paras
অশনি সংকেত?
বহু বছর ধরে (যেমন এই ছবিতে) কিরিবাতি-র মতো ছোট দ্বীপরাজ্যগুলি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুঝছে৷ সেশেল-এর প্রেসিডেন্ট জেমস মিশেল প্যাম ঘূর্ণিঝড়কে ‘‘জলবায়ু পরিবর্তনের স্পষ্ট আভাস’’ বলে বর্ণনা করেন এবং আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রসমাজকে উষ্ণায়ন সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে বলেন৷
ছবি: John Corcoran
জমি বাঁচানোর আকুল প্রচেষ্টা
সবচেয়ে বিপন্ন দ্বীপরাজ্যগুলির বাসিন্দারা উপকূলবর্তী এলাকাগুলিকে রক্ষা করার চেষ্টা করে আসছে, যা-তে জোয়ারে তীরের মাটি ধুয়ে না যায়৷ এই সব স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপে কিছু কাজ হলেও, ক্ষয়ের মূল কারণ – সাগরের পানির উচ্চতা বাড়া – থেকেই যাচ্ছে৷
ছবি: John Corcoran
‘প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিধ্বংসিতা বেড়েছে’
‘‘জলবায়ুর পরিবর্তন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটার মাত্রা ও তীব্রতা বাড়িয়েছে, বিভিন্ন দেশের মানুষদের উপর যার প্রভাব পড়ছে’’, বলেন কিরিবাতি দ্বীপরাজ্যের প্রেসিডেন্ট আনোটে টং৷ বিজ্ঞানীরা অবশ্য বলেন যে, প্যাম ঘূর্ণিঝড়ের মতো একক প্রাকৃতিক ঘটনাকে পুরোপুরি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলশ্রুতি বলা চলে না৷
ছবি: John Corcoran
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কর্মসূচি
‘‘আমাদের বিশেষ করে সবচেয়ে দরিদ্র, বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করতে হবে’’, প্যাম ঘূর্ণিঝড়ের পর এ কথা বলেন জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি-মুন৷ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করাটা গোটা বিশ্বের কর্তব্য – তাই এ বছর একটি নতুন জলবায়ু চুক্তি সম্পাদিত হতে চলেছে৷