‘বাংলাদেশে সেবার মান এখনো অনেক খারাপ’
৫ মার্চ ২০১৮ডয়চে ভেলে: সংখ্যার দিক দিয়ে মোবাইল ফোনের বাজার বাংলাদেশে অনেক বড়ই মনে হয়৷ কিন্তু সেবার মানের দিক দিয়ে আমরা সেই পর্যায়ে কি আসতে পেরেছি? বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিটিআরসি-ই বা তার দায়িত্ব কতটা পালন করতে পেরেছে?
ড. শাহজাহান মাহমুদ: আমাদের সেবার মান বিটিআরসি যেভাবে আশা করে, সেভাবে এসে পৌঁছায়নি৷ নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আমরা সেবার মান বাড়ানোর জন্য বরাবরই জোর দিয়ে এসেছি৷ কোয়ালিটি অফ সার্ভিস মাপার জন্য অতি সম্প্রতি আমরা কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছি৷ আমরা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সেটা মেপে দেখতে পারব৷ তবে সেবার মান খারাপ হওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে৷ তার মধ্যে একটা হলো স্পেকট্রামের স্বল্পতা৷ অন্যান্য দেশে এক মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম দিয়ে যে পরিমাণ লোককে সেবা দেয়া হয়, আমাদের দেশে এক মেগাহার্টজ স্পেকট্রাম দিয়ে অনেক বেশি মানুষকে সেবা দেয়া হচ্ছে৷ ট্রান্সমিশন লাইনের বিষয়ও আছে৷ এ সব কারণে আমাদের দেশে সেবার মান অনেক খারাপ৷ তবে আমরা চেষ্টা করছি এটা বাড়ানোর৷ কোয়ালিটি অফ সার্ভিসের জন্য আমাদের একটা গাইডলাইন ইতিমধ্যে তৈরি হয়েছে৷ সেটা আমরা বাস্তবায়ন করব৷
সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসি-র নজর যতটা না গুণগত সেবা নিশ্চিত করার দিকে, তার চেয়েও বেশি আয়ের অঙ্ক বৃদ্ধির দিকে৷ এটা কেন?
এটা সত্য নয়৷ গুণগত সেবার দিকে আমরা যেভাবে নজর রাখি, আয়ের দিকেও আমাদের নজর রাখতে হয় কিছুটা৷ সরকার আমাদের এখানে শুধু রাজস্ব আদায়ের জন্য বসায়নি, অপারেটররা গ্রাহকদের কাছ থেকে যেভাবে টাকা নিচ্ছে, সেভাবে যেন আমাদের সঙ্গেও রেভিনিউ শেয়ার করে সেটি দেখতে হয়৷ এটা আদৌ সত্য না যে, আমরা টাকা আয়ের দিকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছি৷
গুণগত সেবা নিশ্চিত করতে বিটিআরসি-র সামনের পরিকল্পনা কী?
ফোরজি দেয়ার ফলে থ্রিজিতে যেসব দুর্বলতা ছিল, তার অনেকগুলোই কেটে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস৷ নেটওয়ার্ক যদি আমরা ভালোভাবে বিস্তার করতে পারি, তাহলে সেবার মান অনেকটাই ভালো হয়ে যাবে৷ সম্প্রতি স্পেকট্রাম নিলাম হওয়ার পরও আমরা মনে করি, অপারেটরদের যে পরিমাণ স্পেকট্রাম কেনা উচিত ছিল তারা সেটা কেনেনি৷ তাদের আরো স্পেকট্রাম কেনা উচিত৷ আমরা তাদের সে ব্যাপারে অনুরোধ করব৷
অপারেটররা বলছে, তাদের সামর্থ্যের মধ্যে যতটুকু স্পেকট্রাম কেনা সম্ভব, তারা সেটা কিনেছে৷ এখন বিটিআরসি-র কাছে পড়ে থাকা স্পেকট্রাম যদি তাদের সহনশীল দামে দেয়া হয়, তাহলে রাতারাতি সেবার মান বাড়ানো সম্ভব৷ এ কথা কি ঠিক?
এই স্পেকট্রামের মালিক তো আর বিটিআরসি না৷ জনগণ এটার মালিক৷ সরকার যদি সিদ্ধান্ত নেয় অপারেটরদের বিনা পয়সায় স্পেকট্রাম দিয়ে দেবে, তাহলে দিতে পারে৷ আমাদের কোনো আপত্তি নেই৷ স্পেকট্রামের যে বাজার মূল্য সেটা নির্ণয় করেই আমরা সরকরের কাছে প্রস্তাব পাঠাব৷ সেটা সরকার মানতেও পারে, নাও মানতে পারে৷ আমরা সরকারের কাছে সুপারিশ করি, সরকার সেটা বাস্তবায়ন করে৷
এখনো ৪৫ ভাগ স্পেকট্রাম অবিক্রিত রয়ে গেছে, এটা নিয়ে বিটিআরসি-র পরিকল্পনা কী?
আমাদের উদ্দেশ্য এটা বিক্রি করা৷ সরকার আমাদের এখনো এমন কোনো নির্দেশনা দেয়নি যে স্বল্পমূল্যে বা কম দামে এটা বিক্রি করতে হবে৷
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবার আগে বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের লাইসেন্স দেওয়া হয়৷ কিন্তু থ্রিজি, ফোরজি বা এমএনপি সেবা চালুর দিক দিয়ে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি৷ এর কারণ কী?
গত দু'বছর ধরে সরকার ফোরজি দেয়ার জন্য চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু বিভিন্ন কারণে এটা হয়নি৷ চার-পাঁচ বছর ধরে সরকার চেষ্টা করছে যাতে এমএনপি চালু করা যায়৷ আমি কারো দিকে আঙুল তুলব না৷ তবে চেষ্টা করছি যেসব সেবা জনগণের পাওয়া উচিত সেগুলোতে যে স্লথ গতি ছিল, সেটা যাতে দ্রুত আমরা দিতে পারি৷
স্যাটেলাইট নিশ্চয়ই বিটিআরসি-র অন্যতম বড় সাফল্য৷ এখান থেকে কী কী সুবিধা পাওয়া সম্ভব হবে?
প্রথমত আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিদেশি যেসব স্যাটেলাইট আছে সেখান থেকে সার্ভিস কিনে তাদের বিদেশি দর্শকদের সেবা দেয়৷ এতে আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় হয়৷ আমি মনে করি, আমাদের স্যাটেলাইট চালু হলে তারা আমাদের কাছ থেকেই সেবাটা নেবে৷ এতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে৷ পাশাপাশি এই স্যাটেলাইট নির্মাণ করতে আমাদের যে খরচ হয়েছে, সেই টাকা স্যাটেলাইটের অর্ধেক মেয়াদের মধ্যেই উঠে আসবে৷ একটা স্যাটেলাইটের মেয়াদ ১৫ বছর হয়৷ ভালো হলে ১৮ বছরও চলতে পারে৷
স্যাটেলাইট দিয়ে দেশের বাইরে কোনো ব্যবসা হতে পারে?
অবশ্যই হতে পারে৷ এই স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্যান্সপন্ডার আছে৷ এর মধ্যে ২০টি রেখেছি বাংলাদেশের টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সার্ভিস দেয়ার জন্য৷ বাকি ২০টা বাইরে বিক্রি করব৷
মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির ক্ষেত্রে লাইসেন্স দেওয়াও বিটিআরসি-র সাফল্যের আরেকটি দিক হতে পারে৷ ঠিক কত দিনে বাংলাদেশ মোবাইল হ্যান্ডসেট উৎপাদনে স্বনির্ভর হবে বলে আপনি আশা করেন?
স্বনির্ভর কথাটার উত্তর দেয়া কঠিন৷ কারণ এটা নির্ভর করছে আগামী দিনে আমাদের চাহিদা কী পরিমাণ বাড়বে৷ তবে সাপ্লাইয়ের ব্যাপারে আমি বলতে পারি, একটা কোম্পানিকে ইতিমধ্যে লাইসেন্স দেয়া হয়েছে৷ আরেকটা কোম্পানি আবেদন করেছে৷ আমাদের আশা আছে আগামী দু'মাসের মধ্যে আমরা আরো দু'টি কোম্পানিকে লাইসেন্স দিতে পারব৷ এতে শুধু বৈদেশিক মুদ্রারই সাশ্রয় হবে না, অনেক সস্তায় আমরা মোবাইল ফোন পাবো৷
নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধান হিসেবে আপনার কাছে প্রশ্ন – ফোরজি মোবাইল সেবাকে কোন উচ্চতায় নিতে পারে বলে মনে করছেন আপনি?
এখন আমাদের ট্রেন্ড হচ্ছে ডেটার দিকে যাওয়া৷ আগে যেমন মানুষ ভয়েস কল করত বেশি, এখন ডেটা ব্যবহার করছে বেশি৷ এই ফোরজি হলো ডেটা সার্ভিস দেয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো টেকনোলজি৷ যাঁরা ইন্টারনেট দিয়ে ব্যবসা করেন, যেমন আউটসোর্সিং বা কনসালটেন্সি – তাঁদের জন্য ফোরজি দারুণ কাজে দেবে৷ আর যাঁরা ডাউনলোড করেন বা আপলোড করেন, তাঁদের জন্য এই গতি অনেক বেড়ে যাবে৷ এখন যে থামা থামা ডেটা প্রবাহ, ফোরজিতে এটা থাকবে না৷
ডেটার ব্যবহার বাড়লে স্থানীয় কনটেন্ট খুব বেশি প্রয়োজন৷ এখানে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে?
যেসব কোম্পানি কনটেন্ট সাপ্লাই করে, আমরা যাদের বলি ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিস বা ভ্যাস – সেই গাইডলাইন প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পথে৷ এটা করার আগে আমরা সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলেছি, বিশেষ করে যারা কনটেন্ট সাপ্লাই করে, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি৷ আমরা অপারেটরদের সঙ্গেও কথা বলেছি৷ ভ্যাস থেকে যে উপার্জন হবে, সেখান থেকে দু'পক্ষই যাতে লাভবান হতে পারে, আমরা সেই চেষ্টাই করেছি৷
আপনার কি মনে হয়, বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন করতে পারছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷