বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে ছড়াচ্ছে ভারতে পাওয়া করোনার ধরন
হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৯ মে ২০২১
বাংলাদেশে কোভিড আক্রান্ত ২৩ জনের নমুনায় এখন পর্যন্ত ভারতে পাওয়া বি.১.৬১৭ ধরনটি শনাক্ত হয়েছে৷ তাদের মধ্যে মারা গেছেন দুই জন৷ স্থানীয়ভাবেও ভ্যারিয়েন্টটি ছড়াতে শুরু করেছে৷
সীমান্তের ১৫ জেলার মধ্যে এখন করোনারসর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ৷ সেখানে চলছে লকডাউন৷ যদিও সংক্রমণ কিছুটা কমে আসছে৷
আইইডিসিআর-এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এপর্যন্ত মোট ১৮০ জন করোনা রোগীর জেনম সিকোয়েন্স করা হয়েছে তারমধ্যে ২৩ জনের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিশ্চিত হওয়া গেছে৷ তাদের সাতজন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাঁচজন যশোর এবং বাকিরা ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের৷” একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত ২৩ জনের মধ্যে দুইজন মারা গেছেন৷ আর ১৬ জনই সাম্প্রতিক সময়ে ভারত সফর করেছেন৷ ভারত সফর করেননি সাত জন৷''
‘‘ভারত সফর করেননি সাত জন’’: তাহমিনা শিরিন
This browser does not support the audio element.
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. জাহিদ নজরুল চৌধুরী জানান, ১৯ তারিখে ওই জেলা থেকে আরো ৪২ জনের জেনোম সিকোয়েন্স পাঠানো হয়৷ তাদের মধ্যে সাতজন ভারতে শনাক্ত ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছেন৷
এই জেলায় ২৪ মে রাত ১২ টার পর থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে৷ চলবে ৩১ তারিখ রাত ১২ট পর্যন্ত৷ সিভিল সার্জন জানান, ‘‘লকডাউন চলাকালে সরকারি হিসেবে দুইজন ভারত থেকে এসেছেন৷ কিন্তু এখানে চোরাচালানসহ ক্রসবর্ডার কার্যক্রম অনেক বেশি৷ ফলে অনেকেই এখনও ভারতে আসা যাওয়া করছেন অবৈধভাবে৷ আমরা চেষ্টা চেষ্টা করছি, প্রশাসন চেষ্টা করছে৷ আর লকডাউন মানুষ মেনে নিয়েছে৷''
চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২২, ২৩ ও ২৪ মে এই তিনদিনে ২১২ টি নমুনার বিপরীতে করোনা শনাক্ত হয় ১৩১ জনের৷ হার শতকরা ৬২ ভাগ৷ ২৭ মে ৫৬টি নমুনার বিপরীতে ৩৩ জন শনাক্ত হন৷ হার ৫৯ শতাংশ৷ ২৮ মে ১১৩টি নমুনার বিপরীতে শনাক্ত হয়েছেন ২৮ জন৷ ২৯ মে ২২৯টি নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে৷ সেখানে শুক্রবার সর্বোচ্চ চারজনের মৃত্যু হয়েছে৷
করোনার ভারতীয় রূপ কতটা ভয়ংকর?
প্রায় প্রতিদিনই করোনা শনাক্তের রেকর্ড হচ্ছে ভারতে৷ ধারণা করা হচ্ছে এর পেছনে দেশটিতে শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন রূপের ভূমিকা থাকতে পারে৷ এ নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া কিছু তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DesignIt/Zoonar/picture alliance
বি.১.৬১৭
এমন নামেই পরিচিত করোনার নতুন ভারতীয় ধরনটি৷ দেশটিতে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ এটি কীনা সেটি অবশ্য এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না৷ তবে সম্ভাব্য একটি কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্টকে৷
ছবি: DesignIt/Zoonar/picture alliance
কখন থেকে?
গত মার্চে ভারতের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টের কথা জানায়৷ ভাইরাসের এই ধরনটি দুইবার রূপ বদলেছে বলে সেসময় জানিয়েছেন কর্মকর্তারা৷ তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা সেটি এখন তৃতীয়বারের মতো রূপ বদলেছে৷ জিনগত উপাত্তের উন্মুক্ত তথ্য ভাণ্ডার জিআইএসএইড-এর (GISAID) তথ্য অনুযায়ী ভারতে বিদ্যমান করোনা ভ্যারিয়েন্টের ৬৩ ভাগই এখন বি.১.৬১৭৷
ছবি: Adnan Abidi/REUTERS
কতটা উদ্বেগের?
প্রথম রূপটি (E484Q) অনেকটা ব্রাজিলে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুত সংক্রমণ ঘটানো ভ্যারিয়েন্টের মতো৷ দ্বিতীয়টি (L452R), এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় পাওয়া গেছে৷ এই ধরনটি টিকার রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম এবং বেশি মারাত্মক বলে মনে করা হচ্ছে৷ আর তৃতীয় রূপটি (P681R) উচ্চ সংক্রমণপ্রবণ যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটির কাছাকাছি৷
ছবি: picture-alliance/M. Schönherr
কতটা ছড়িয়েছে?
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যাচ্ছে৷ শুধু ভারত নয় এটি ছড়িয়ে পড়েছে অন্য দেশগুলোতেও৷ জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও দেশগুলোতে বি.১.৬১৭ শনাক্ত করেছে৷
ছবি: Xavier Galiana/AFP
মানবদেহে কী করছে?
একাধিক রূপ বদলের কারণে ভাইরাসটি শরীরে দ্রুত ছড়াতে পারে৷ বিশেষ করে এর পক্ষে শরীরে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়াও সহজ হতে পারে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি বা যারা টিকা নিয়েছেন তাদেরও এই ভ্যারিয়েন্টে নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: AFP/National Institutes of Health
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ তালিকায় রেখেছে৷ অর্থাৎ, তারা ভাইরাসটি নজরদারিতে রেখেছে, তবে এখনও সেটি বড় ধরনের উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেনি৷ উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছালে এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ ঘোষণা করা হতে পারে৷
ছবি: Fabrice Coffrini/AFP/Getty Images
বেশি সংক্রামক নয়?
ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই রয়েছে মতপার্থক্য৷ যুক্তরাজ্যের কোভিড-১৯ জেনোমিকস ইনিশিয়েটিভ এর পরিচালক ড. জেফারি ব্যারেট এর মতে গত কয়েক মাসে ভ্যারিয়েন্টটি বেশ ধীর গতিতে ছড়িয়েছে৷ আর এজন্য তিনি এটিকে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট বি.১.১.৭ এর মত সংক্রামক নয় বলে মনে করছেন৷
ছবি: PAWAN KUMAR/REUTERS
উপাত্ত কী বলে?
জিনগত বিশ্লেষণে মহারাষ্ট্রে ৬০ শতাংশের বেশি করোনা আক্রান্তের নমুণায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে৷ তবে কর্তৃপক্ষ বলছে তারা যত নমুনা পরীক্ষা করেছেন সেটি উপসংহারে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট নয়৷
ছবি: Pradeep Gaur/ZUMA Wire/imago images
টিকায় কি কাজ হচ্ছে?
অন্তত দুইটি গবেষণা বলছে ভ্যারিয়েন্টের এল৪৫২আর রূপটি অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়িয়ে যেতে পারে৷ তবে এর একটি এখনও অপ্রকাশিত এবং অ্যাকাডেমিকভাবে পিআর রিভিউ সম্পন্ন হয়নি৷
ছবি: Anindito Mukherjee/Getty Images
অতিরঞ্জন হচ্ছে?
অনেকে অবশ্য বলতে চাইছেন ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় যেসব তথ্য আসছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিয়োনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জেরেমি পি কামিল তাদের একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই যেখানে বলা হয়েছে এল৪৫২ রূপটি সব ধরনের ইমিউনিটি বা অ্যান্টিবডিকে এড়াতে পারে৷’’ সেটি সম্ভব নয় বলেও মত তার৷
শনিবার ৪৫৩টি নমুনার র্যাপিড টেস্ট করে ৪৫ জন পজিটিভ পাওয়া গেছে বলে সিভিল সার্জন জানান৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি খুশি যে সংক্রমণের হার কমছে৷''
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাশের জেলা নাটোরকে শনিবার হটস্পট হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে৷
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৭ মে থেকে ২৩ মে পর্যন্ত সাত দিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে৷ সেখানে ১৫টি সীমান্ত জেলায় করোনা পরিস্থিতির অবনতির কথা বলা হয়েছে৷
ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলো হলো: চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, লালমনিটরহাট, কুড়িগ্রাম, জয়পুরহাট, রাজশাহী, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, সাতক্ষীরা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, জামালপুর, রাঙামাটি ও বান্দরবান৷ সীমান্ত এলাকার বাইরে আছে নাটোর, গাইবান্ধা, খুলনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, কক্সবাজার ও নরসিংদী৷
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এটা এখন স্পষ্ট যে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশে স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে৷ যারা ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হচ্ছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা কখনোই ভারতে যাননি৷ এখন যদি এটা সামলানো না যায় তাহলে সারা দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে৷''
‘‘এখন যদি সামলানো না যায় তাহলে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে’’: কামরুল ইসলাম
This browser does not support the audio element.
তার মতে, করোনা পজিটিভ হলেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায় না৷ এর জন্য প্রয়োজন জেনম সিকোয়েন্স যা এখন সীমিত আকারে পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ পরীক্ষার হার বেশি হলে পরিস্থিতি আরো ভালো বোঝা যেত৷
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ আছে৷ বন্ধ সড়ক ও আকাশপথে যোগাযোগও৷ তবে অধ্যাপক কামরুল ইসলাম মনে করেন, এক্ষেত্রে আরো কঠোর হওয়া দরকার৷ চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনচললেও সেখান থেকে ১২ জন আক্রান্ত ঝিনাইদহ চলে যান৷ এমন পরিস্থিতি ঠেকাতে হবে৷
ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, ‘‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এখন স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে৷ এটা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে আমাদের সতর্ক হতে হবে৷ মাস্ক ব্যবহার করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে৷''
বাংলাদেশে করোনায় গত ২৪ ঘন্টায় আরো ৩৮ জন মারা গেছেন৷ সনাক্ত হয়েছেন এক হাজার ৪৩ জন৷