রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে নিয়মিত হরতাল হচ্ছে বাংলাদেশে৷ বুধবার থেকে আবার শুরু হয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের দুই দিনব্যাপী হরতাল৷
বিজ্ঞাপন
রাজনৈতিক সহিংসতা আর হরতালের কারণে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে দেশের অর্থনৈতিক সেক্টর৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, হরতাল অর্থনীতির জন্য বড় আঘাত৷ বিদেশি বিনিয়োগকারী মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন৷ হরতালের কারণে বড় বড় ক্রেতারা সময় দিয়েও আসছেন না৷ অর্ডারের মালামাল ঠিকমতো শিপমেন্ট করা যাচ্ছে না৷ এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ঊর্ধ্বমুখী অর্থনৈতিক খাত চরম সংকটের মুখে পড়বে৷ চাকরি হারাবেন অনেকে৷
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি আতিকুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মূলত বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে৷ তিনি অভিযোগ করে বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে দলগুলো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না৷ এ কারণেই বিদেশি ক্রেতারা বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন৷ সহসাই পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শ্রীলঙ্কা থেকে গার্মেন্ট শিল্প যেভাবে বাংলাদেশে চলে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই গার্মেন্ট শিল্প বাংলাদেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাবে৷
আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন বিনিয়োগকারী ও তৈরি পোশাক ক্রেতা তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন৷ তৈরি পোশাকের ক্রয় আদেশ বাংলাদেশ থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ভারত, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে৷ এ অবস্থায় চরম উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন শিল্পোদ্যোক্তারা৷ সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন গার্মেন্ট মালিকরা৷ তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকলে রক্ষা করা যাবে না ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের খাত তৈরি পোশাক শিল্প৷
শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, গত দুই মাসে শুধু ভারতে চলে গেছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার মূল্যের ক্রয় আদেশ, স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা৷ অন্যদিকে বড় অঙ্কের বিনিয়োগে আগ্রহী দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং করপোরেশনের একটি প্রতিনিধি দল তাদের নির্ধারিত সফর বাতিল করেছে৷ এ অবস্থা চলতে থাকলে চরম সংকটে পড়বে অর্থনীতি৷
আতিকুল ইসলাম আরও বলেন, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পরিস্থিতি উন্নতির জন্য দাবি জানাচ্ছে৷ রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে কোনো সদিচ্ছা দেখাচ্ছে না৷ যার কারণে ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের অর্ডার বাতিল করছে৷ দেশের বৃহত্তর স্বার্থে এবং গার্মেন্ট শিল্পকে রক্ষার জন্য সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলকে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে৷
বিজিএমইএ'র সভাপতির মতে, গত প্রায় দুই মাস ধরে বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে, তা নিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক৷ বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের কাছে তাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে৷ তাদের ব্যবসা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোক তারা কোনোভাবেই তা চান না৷ এ কারণে তারা বাংলাদেশ থেকে গার্মেন্ট পণ্যের অর্ডার ফিরিয়ে নিচ্ছে৷
ইতোমধ্যে ওয়ালমার্টসহ বড় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে অর্ডার তুলে নিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে, যা এই শিল্পের জন্য বড় হুমকি৷ দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয়, তাহলে রপ্তানি আদেশ আরও বাতিল করবে ক্রেতারা৷ তখন এই সেক্টরটিকে আমরা রক্ষা করতে পারব না৷ গার্মেন্ট মালিকরা লাখ লাখ শ্রমিককে বেতন দিতে পারবে না৷ যাকে কেন্দ্র করে আগামীতে এ শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কাও তার৷