‘দেশে হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি বড্ড বেশি'
১০ এপ্রিল ২০১৮ডয়চে ভেলে: খালেদা জিয়া তো এখন কারাগারে৷ বিএনপির রাজনীতিতে এর প্রভাবটা কেমন?
অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ: আমি বিষয়টাকে এভাবে দেখি, যখন খালেদা জিয়া কারাগারে গেলেন তার আগে থেকেই ক্ষমতাসীনরা মনে করছিল, খালেদা জিয়া কারাগারে গেলে দলটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে৷ কয়েকভাগে ভাগ হয়ে যাবে৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিএনপি এখন ভয়ংকরভাবে ঐক্যবদ্ধ৷ সেটা খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার আগে যতটা না ঐক্যবদ্ধ ছিল, এখন তার চেয়েও অনেক বেশি৷ বিভক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না৷ আর দ্বিতীয় হলো, যেহেতু খালেদা জিয়া ভয়ংকর জনপ্রিয় নেত্রী, ফলে তাঁর অনুসারী কিন্তু সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবি পর্যন্ত প্রচুর, যা হিসেব করে বলা যাবে না৷
সরকার বলছে, খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের ভুলে তিনি এখনও কারাগারে, আর তাঁর আইনজীবীরা বলছেন, সরকারের এখানে হস্তক্ষেপ করছে৷ আপনি কী মনে করেন?
আমি মনে করার কিছু নেই৷ এটা প্রমানিত হয়েছে বিভিন্নভাবে যে, বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে সবকিছু৷ প্রশাসন থেকে শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, এমনকি নিম্ন আদালতও৷ এখানে খালেদা জিয়ার পক্ষে যাঁরা আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন, তাঁদের কোথাও ছোটখাট ভুল হতে পারে, সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ না৷ এখন এসব কথা বলে বাইরে একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে যে, তাঁরা একত্রিত না, বা তাঁরা বিভ্রান্ত৷
আদালতের উপর কি তাহলে সরকারের হস্তক্ষেপ আছে বলে মনে করেন?
নিম্ন আদালতে সরকারের ভয়ংকরভাবে নিয়ন্ত্রণ আছে৷ আর হাইকোর্ট নিয়ে আমরা সারা জীবনই গর্ব করে এসেছি৷ এখানে তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা আমার জানা নেই৷ এটাকে মোটামুটি স্বাধীন বলতে পারি, তবে নিচের দিকটায় যে তাদের নিয়ন্ত্রণ আছে সেটা নিয়ে সন্দেহ নেই৷
আপনার কি মনে হয় প্রতিহিংসার রাজনীতি এখানে কাজ করছে?
বড্ড বেশি৷ এখানে তো হিংসা আর প্রতিসিংসার রাজনীতিই চলছে৷ এখানে যদি জনকল্যাণমূলক কাজের খতিয়ান নিতে যান, তাহলে কোথায় পাবেন আপনি? রাজনীতি হলো জনগণের মঙ্গলজনক কাজের যৌথ কর্মকাণ্ড৷ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতির উৎস হলো জনগণ৷ কয়েকদিন আগে তো জার্মানি থেকেই একটা গবেষণা এলো৷ আমি অত্যন্ত দুঃখিত বোধ করি যে, আমাদের উগান্ডার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে৷ নিকারাগুয়ার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে৷ এটা কত দুঃখজনক, কত অপমানজনক! অথচ বাংলাদেশের জন্মলগ্ন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আর্শীবাদ মাথায় নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল৷ এর আড়াই তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে গণতন্ত্র নির্বাসিত হয়ে গিয়েছিল৷ পরে এটাকে আবার ফিরিয়ে আনা হয়৷ আবার তা-ও করেছিলেন খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালে৷ উগান্ডা, মোজাম্বিক বা নিকারাগুয়ার সঙ্গে তুলনা হতে বড্ড দুঃখ ও লজ্জা লাগে৷
কিন্তু কেন এই প্রতিহিংসা?
এর পেছনে দীর্ঘ ইতিহাস আছে৷ তবে সংক্ষেপে বলি৷ আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করেছি৷ তখন থেকে আমরা এখানকার মানুষ দ্বারা শাসিত হচ্ছি৷ এর আগে ৪ হাজার বছরের ইতিহাস আছে৷ তখন কখনোই এই এলাকা বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হয়নি৷ এলাকার মানুষের দ্বারা শাসিত হয়নি, শোষিত হয়েছে৷ ফলে আমরা মাথা উঁচু করে চলবার শিক্ষাটা এখনো পাইনি৷ ব্রিটিশ আমলেও বা পরে পাকিস্তান আমলেও আমরা নিজেরা শাসন করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি৷ কিন্তু নিজেরা কীভাবে শাসন করব বা করতে হয়, তা আমরা কখনও ভাবিনি৷ আমরা আত্মসমালোচনা, পারষ্পরিক শ্রদ্ধাবোধ – এ সব নিয়ে কখনোই ভাবিনি৷ একটি গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এটা খুবই প্রয়োজন৷ পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে আমরা আলোচনা করে সমাধান করতে পারি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই মনোভাব তৈরি হয়নি৷ এবং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এসব বিষয় আসার পর্যায়েও আমরা উন্নীত হইনি৷ এ কারণে আজকে আমাদের এই অবস্থা৷
বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময়ও তো আমরা এমন প্রতিহিংসার রাজনীতি দেখেছি...
ছিল৷ ওই যে কারণ বললাম, আমাদের পারস্পরিকসহযোগিতার মাত্রা আরো উচু হওয়া দরকার, বৃদ্ধি করা দরকার, সেটা তো আমরা শিখিনি৷ শেখার সুযোগ পাইনি৷ এই ৪৭ বছর বাদ দিলে এর পেছনে যে হাজার হাজার বছরের ইতিহাস, সেখানে আমরা কোনোভাবে টিকে থেকেছি আরকি৷ হিংসা-প্রতিহিংসার রাজনীতি বিএনপির আমলে ছিল না তা বলব না, তবে এখন একটু বেশি হয়েছে বলে মনে হয়৷
বর্তমানে কী হচ্ছে সেটা তো সবাই দেখছেন৷ বিএনপি আমলে ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলা, কিবরিয়া- আহসানউল্লাহ মাস্টারসহ আওয়ামী লীগের বেশ কিছু নেতা-কর্মী হত্যার কথা তো এখনো আলোচনায় আছে?
আমি পুরোপুরি একমত৷ আমরা কিন্তু তখনও লিখেছি৷ আপনি যদি ওই সময় কাগজগুলো দেখার সুযোগ পান, তাহলে দেখবেন, আমরা কিন্তু চুপচাপ ছিলাম না৷ একজন শিক্ষক হিসেবে আমরা এটা নিয়ে প্রতিবাদ করেছি৷ আমরা লিখেছি, কেন এটা হচ্ছে? এটা হওয়া উচিত না৷
২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের উপর হামলা-নির্যাতনের কথাও নিশ্চয় আপনার স্মরণ আছে?
এগুলো অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্খিত৷ এটা রাজনীতির ব্যাপার না৷ সোজা কথা অরাজনৈতিক, হিংসা-প্রতিহিংসা এবং কোনোভাবে ক্ষমতায় যাওয়া৷ ক্ষমতায় যাওয়ার পর ভেতরে ভেতরে আক্রোশ যেটা, সেটা মেটানোর সুযোগ গ্রহণ করা৷
খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাতে কি আওয়ামী লীগের কোনো লাভ হচ্ছে?
কোনো লাভ হচ্ছে না৷ বরং ক্ষতি হচ্ছে৷ যেভাবেই বলুন – খালেদা জিয়া অপরিচিত মহিলা না৷ তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণকারী৷ এখানকার চিফ অব আর্মি স্টাফের বেগম তিনি৷ যে সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা বলছি, এখনকার যে ব্যবস্থা, যেটা উপড়ে ফেলা হয়েছে প্রায়, সেটাকে তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ১৯৯১ সালে৷ এর ফলে তাঁর জনপ্রিয়তা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে৷ দু'দিন আগে জিয়ার মাজারে ছোট্ট একটা সমাবেশ করার অনুমতি দেয়নি সরকার এই কারণে৷ ভয়ঙ্করভাবে না আবার জনসাধারণ উপচে পড়ে৷ এতে তাঁর জনপ্রিয়তা আরো বেড়েছে৷
এই প্রতিহিংসার রাজনীতি বাংলাদেশের জন্য কতটা ক্ষতি করছে বলে আপনি মনে করেন?
অর্থনৈতিক দিক থেকে আমরা আরো এগিয়ে যেতে পারতাম৷ রাজনীতিতেও যোগ্যতার আরো উন্নতি করতে পারতাম৷ এখন যে অবস্থা তাতে যারা বিত্তবান, তারা আরো বেশি বিত্তবান হয়েছে৷ চুরি-দুর্নীতির মাধ্যমে৷ বাংলাদেশে এখন অন্য রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা লক্ষ্য করি৷ এটা হয়ত তখন থাকতো না৷ জনগণের কল্যানমূলক কাজগুলো অনেক বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেত৷
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সম্পর্ক কীভাবে তৈরি করা যায়? লিখুন নীচের ঘরে৷