বাংলাদেশের ১১টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা বিপন্ন৷ তাই তাদের ভাষা ও জাতিসত্তা নিয়ে কাজ করছে ঢাকার ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট’৷ চেষ্টা চলছে এইসব ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার৷
বিজ্ঞাপন
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনষ্টিটিউট'র মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. জীনাত ইমতিয়াজ আলী জানান, গত বছরের নভেম্বরে ‘নৃ-ভাষাবৈজ্ঞানিক সমীক্ষা' শীর্ষক গবেষণা শুরু হয়েছে৷ এ গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের নৃ-জনগোষ্ঠীর ভাষা ও জাতি বিষয়ক তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে৷ এছাড়া তাদের ভাষা সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেয়া হবে এ কর্মসূচির আওতায়৷
চলতি বছরেই ইনষ্টিটিউটের নৃ-ভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা কার্যক্রম শেষ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তিনি বলেন, ‘‘এ গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশের নৃ-গোষ্ঠীর অবস্থানই শুধু চিহ্নিত হবে না৷ পাশাপাশি তাদের ভাষা পরিস্থিতির বাস্তব পরিচয়ও উদ্ধার করা সম্ভব হবে৷ যা ভাষা পরিকল্পনার মাধ্যমে মাতৃভাষায় শিক্ষা দানের জন্যে পাঠ্যপুস্তক রচনার কাজে সহায়তা করবে৷''
আ-মরি বাংলা ভাষা
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবিতে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হয় বাংলার মাটি৷ মায়ের ভাষার জন্য শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরো অনেকে৷ তাঁদের আত্মদানে বাংলা আজ আমাদের রাষ্ট্রভাষা৷
ছবি: DW/M. Mamun
ইতিহাসের শুরু
১৯৪৮ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী উর্দু ভাষাকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে৷ জেগে ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সমাজ৷ ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পুলিশ ছাত্রজনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ করে৷ শহীদ হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও আরো অনেকে৷
ছবি: DW
শ্রদ্ধাঞ্জলি
প্রতি বছর একুশের প্রথম প্রহর থেকেই শুরু হয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন৷ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নামে হাজারো মানুষের ঢল৷ ভোরে খালি পায়ে প্রভাত ফেরিতে অংশ নেন সব শ্রেণির মানুষ৷ সব পথ গিয়ে মেলে এক পথে – কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে৷ জাতি শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় স্মরণ করছে শহীদদের৷
ছবি: picture-alliance/AP
প্রভাত ফেরির গান
২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার অন্যতম সাক্ষী আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী৷ রাজনৈতিক এই বিশ্লেষক তখন ছিলেন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী৷ তিনি শহীদ রফিকের মরদেহ দেখার পরই এই গানটির প্রথম লাইন তাঁর মাথায় এসেছিল – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’৷ যেটি এখন প্রভাত ফেরির গান হয়ে গেছে৷ এ গানের সুরকার ছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ৷
ছবি: DW
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’
২১শে ফেব্রুয়ারির সেই ঘটনায় বাঙালি বুঝতে পেরেছিল, তারা আসল স্বাধীনতা পায়নি৷ তাই ভাষা স্বাধীনতা, তথা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি তখন ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র৷ যার প্রতিধ্বনি শোনা যায় আব্দুল লতিফের গানে, ‘‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়''৷ অতুল প্রসাদ সেন লেখেন ‘মোদের গরব মোদের আশা’৷
ছবি: picture-alliance/AP
বাংলাদেশের জন্ম
বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একুশের ভাষা আন্দোলনের সংগ্রাম পূর্ণতা পায় একাত্তরের স্বাধিকারের লড়াইয়ে৷ বিশ্ব মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ৷
ছবি: AP
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো-র প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা’ দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়৷ ২০০০ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর অনেকেই যথাযথ মর্যাদায় পালন করছে৷
ছবি: AP
বাংলা ভাষায় পরিবর্তন
সেই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর – এর যুগ থেকে শুরু করে বা বঙ্কিমের ভাষা যেরকম প্রমথ চৌধুরীর আমলে পরিবর্তিত হয়ে অনেকটা কথ্য ভাষায় রূপ নিয়েছিল, তেমনি আজকের বাংলা ভাষা অনেকটাই গণভাষায় পরিণত হয়েছে৷ নব প্রযুক্তির যেসব শব্দ রয়েছে, তা বাংলা ভাষা খুব দ্রুত আহরণ করেছে৷ দ্রুত আহরণের ফলে ঢুকে পড়ছে অবাঞ্ছিত শব্দও৷
ছবি: DW/M. Mamun
অমর একুশে গ্রন্থমেলা
২১শে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা হয় বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গনে৷ এবার অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও আয়োজন করা হয়েছে মেলার৷ এবারের মেলা উত্সর্গ করা হয়েছে প্রয়াত ভাষা সৈনিক সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে৷
ছবি: DW/M. Mamun
8 ছবি1 | 8
ইউনেস্কোর তথ্য মতে, বাংলাদেশে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া – এই ৩টি নৃগোষ্ঠীর ভাষা ভয়াবহ বিপন্ন অবস্থার অবস্থায় আছে৷ এগুলো যে কোনো সময় হারিয়ে যেতে পারে৷
আর বিপন্ন ভাষা রয়েছে ৮টি৷ এগুলো হলো: বম, চাক, আসো চিন, খাসি, ম্রু, কুরুক্স, প্নার ও সৌরিয়া পাহাড়িয়া৷ এখনই সংরক্ষণের প্রচেষ্টা না নেয়া হলে অচিরেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে এইসব ভাষা৷ জীনাত ইমতিয়াজ আলী বলেন, তাঁরা চেষ্টা করছেন এই ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে৷
আর বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান জানান, এ জন্য তাঁরাও কাজ করছেন৷ তাঁরাও চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ থেকে কোনো নৃ-গোষ্ঠীর ভাষা যেন হারিয়ে না যায়৷ তিনি মনে করেন, নৃ-গোষ্ঠীর ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার মাধ্যমে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা জানান সম্ভব৷
১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর অমর একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে ইউনেস্কো৷ ২০১১ সালের ২৭শে জানুয়ারি আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের৷ এই প্রতিষ্ঠানটি আরো নানা ধরনের কাজ হাতে নিচ্ছে ভাষা নিয়ে৷