তাঁরা বাংলাদেশের চা শ্রমিক৷ ১৭৫ বছর আগে তাঁদের পূর্ব পুরুষদের তখনকার ভারতবর্ষের বিহার, ওড়িষা এবং উত্তর প্রদেশ থেকে প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল৷ বলা হয়েছিল, কাজ করলে দারিদ্র্য ঘুচবে৷ জীবিকার প্রয়োজনে, সরল বিশ্বাসে পাহাড়ি এলাকায় এসে তখনই শুরু করেছিলেন বৃক্ষরোপণ, বৃক্ষ পরিচর্যার কাজ৷ তাঁদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের বিন্দু বিন্দু ঘাম আর রক্তেই গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশের চা শিল্প৷
প্রতিদিন অন্তত এক কাপ চা না হলে অনেকেরই জীবন যেন অপূর্ণ থেকে যায়৷ তা চা যাঁদের প্রিয় পানীয়, তাঁরা কি জানেন যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই চা, তাঁরা কেমন আছেন? জানতে হলে এই ভিডিওটি দেখুন...
ভিডিওতে দু'জন শ্রমিক শুধু নিজেদের জীবনের বঞ্চনার কথাই বলেছেন৷ ১৭৫ বছরের বঞ্চনার খুব সামান্যই বলতে পেরেছেন তাঁরা৷ যা বলেছেন তার সবই পুরোনো কথা৷ ১৭৫ বছর ধরে একই জায়গায় থাকা, অথচ জায়গার ওপর কোনো অধিকার নেই তাঁদের৷ হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর এক দিনে মজুরি পান মাত্র ৮৫ টাকা৷ কোনো কোনো শ্রমিকের পরিবারে আছে ১০ জন সদস্য৷ ৮৫ টাকায় কি সেই সংসার চালানো সম্ভব? এক শ্রমিক জানালেন, সবাই প্রতিদিন এক মুঠো করে ভাতও খেতে পারেন না৷ স্বাভাবিকভাবেই পরিবারের সবাই অপুষ্টিতে ভোগে৷ শিশুরা পায়না যথাযথ শিক্ষার সুযোগ৷ নারী পায় না পর্যাপ্ত মাতৃত্বকালীন ছুটি৷ ডেইলি স্টারের প্রতিবেদককে দেয়া সাক্ষাৎকারে চা শ্রমিকরা তথ্য দিয়েই জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পোশাক শিল্প থেকে শুরু করে অন্যান্য সব শিল্পের শ্রমিকের যেটুকু অধিকার আছে, চা শ্রমিকদের তা-ও নেই৷ বাংলাদেশেদের জীবন এখনো যেন আদি যুগের ক্রীতাদাসদের মতো৷
সস্তা পানীয় চা৷ সেই পানীয়ের তৃপ্তি দিতে সবচেয়ে সস্তায় শ্রম দেন তাঁরা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের প্রকৃত শিল্পী৷ তাঁদের দৈনন্দিন জীবনের কিছু ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Thaunaujamচা গাছের এমন দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি থেকেই আমরা পাই সুপেয় চা৷ বাংলাদেশে এক সময় শুধু বৃহত্তর সিলেট জেলাতেই চা বাগান ছিল৷ সিলেটের অন্য নাম তাই ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’৷ ধীরে ধীরে বাংলাদেশে চায়ের রাজ্য বেড়েছে৷ চা বোর্ডের হিসেব অনুযায়ী, এখন মোট ১৬২টি চা বাগান রয়েছে বাংলাদেশে৷ এর মধ্যে ৯০টি মৌলভীবাজার জেলায়, ২৩টি হবিগঞ্জ, ১৮টি সিলেট, ২১টি চট্টগ্রাম এবং বাকি ৯টি পঞ্চগড় জেলায়৷
ছবি: Khukon Singhaতাঁদের অক্লান্ত শ্রমেই গড়ে ওঠে চা বাগান, বাগান থেকে তাঁদের হাতই তুলে আনে ‘দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি’, তাঁদের শীর্ণ পিঠে চড়েই কারখানায় যায় সোঁদা গন্ধের পাতার বোঝা৷ তাঁরা চা শ্রমিক৷ চা শিল্পের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পীও তাঁরা৷ বাংলাদেশে এমন ‘শিল্পী’ এখন ১ লাখ ২২ হাজারের মতো৷
ছবি: DW/K. Thaunaujamচা শিল্পের সূচনালগ্নে ফিরে যাওয়ার দরকার নেই৷ তিন দশক আগের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেও চা শিল্পের বিস্তারের সঙ্গে শ্রমিকের অবস্থার উন্নতির দৃষ্টিকটু পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে৷ তিন দশক আগে একজন চা শ্রমিক পাহাড়ি বাগানের রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারাদিনের কাজ শেষে পেতেন সাত টাকা, এখন ‘হাজিরা’ বা মজুরি ৮৫ টাকা৷ এই দুর্মূল্যের বাজারে চা শ্রমিকের মাসিক আয় দু’হাজার টাকার চেয়ে সামান্য বেশি৷
ছবি: Khukon Thaunaujamচা বাগানেই চা শ্রমিকদের বাস৷ বাগানের ‘লেবারার’, অর্থাৎ শ্রমিকেরা এক পাড়ায় থাকেন বলে পাড়ার নাম হয়ে গেছে ‘লেবার লাইন’৷ ৮ হাত বাই ১২ হাতের এক টুকরো জমির ওপর গড়ে তোলা মাটির ঘরে গাদাগাদি করে থাকে শ্রমিক পরিবার৷ কোনো কোনো পরিবারে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য৷ ওই ৮ বাই ১০ বাই ১২ হাতের জায়গাটুকুই কিন্তু সম্বল!
ছবি: Khukon Thaunaujam২০০৭ সালেও চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র ৩৫ টাকা৷ এখন তা বেড়ে ৮৫ টাকা হয়েছে৷ এ আয়ে সংসারই চলে না, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাবেন কী! কোনো কোনো বাগানে প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে৷ অনেকগুলোরই ছাদ আছে তো, দেয়াল নেই৷ প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষকও অনেক কম৷
ছবি: Khukon Thaunaujamবেশির ভাগ বাগানে শ্রমিকের চিকিৎসার সুব্যবস্থাও নেই৷ জটিল রোগের চিকিৎসা তো দূরের কথা, সর্দি-জ্বারের চিকিৎসাও সময়মতো পাওয়া মুশকিল৷ হাসপাতালের বারান্দায় বসে ডাক্তারের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে গুণতেই বেলা বয়ে যায়৷
ছবি: Khukon Thaunaujamরিলে, হাজরা, হারাম, সাঁওতাল, সাধু, টগর, মুন্ডাসহ অনেকগুলো নৃগোষ্ঠীর মানুষ আছে চা শ্রমিকদের মাঝে৷ তাই ছোট-বড় নানা ধরণের উৎসব লেগেই থাকে সারা বছর৷
ছবি: Khukon Thaunaujamচা বাগানের মজুরিতে সংসার চলে না বলে বাড়তি উপার্জনের জন্য শ্রমিকদের অবসর সময়েও কিছু না কিছু করতে হয়৷ ঘরে তৈরি বিভিন্ন পণ্য বাজারে বিক্রি করেও দ্রব্যমূ্ল্যের ঊর্ধগতির সময়ে টিকে থাকছেন অনেকে৷
ছবি: Khukon Thaunaujamদেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চা-বাগান সংলগ্ন জমিকেই নিজের জমি মনে করে সেখানে বংশ পরম্পরায় চাষবাষ করে আসছে শ্রমিক৷ সেই জমিও হাতছাড়া হলে ৮৫ টাকা মজুরির শ্রমিক বাঁচবে কী করে? গত বছর তাই বাগানের লিজ নেয়া জমিতে সরকার বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করার পরিকল্পনা করায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল হবিগঞ্জের কয়েকটি বাগানের শ্রমিক৷ মৌলভীবাজার এবং সিলেটের অনেক শ্রমিকও যোগ দিয়েছিল ভূমি রক্ষার সে আন্দোলনে৷
ছবি: Khukon Singha এসিবি/ডিজি