বাংলাদেশ আর যেন একটুও না হারে
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০তাই জয়ের মরিয়া চেষ্টা থাকে, প্রচারের প্রতিযোগিতা থাকে, আবেগ-উত্তেজনাও থাকে; এবং এসবের একটাও মাত্রা ছাড়ালে আসল মজাটা আর থাকে না৷
টাকার খেলা এবং আমজনতার বিনোদন
একটা সময় পর্যন্ত ক্রিকেট ছিল শুধু ভদ্রলোকের, সাদা পোশাকের আর লাল বলের খেলা৷ কয়েকটি দেশের মধ্যে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হতো টেস্ট সিরিজ৷ দ্বিপাক্ষিক ওই সিরিজগুলো আর ঘরোয়া ক্রিকেটে আভিজাত্য ছিল, ছিল রোমান্টিকতাও৷ কিন্তু প্রতিযোগিতায় কাউকে তো জিততে হয়, অথচ চার-পাঁচ দিন শেষেও ড্র হয়ে যেতো অধিকাংশ ম্যাচ৷ফলে গ্যালারি থাকতো ফাঁকা৷
টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল অ্যাশেজ সিরিজ৷ সেখানেও যা দর্শক হতো, বৃষ্টি হলে তারাও ঘরে ফিরতেন রাজ্যের হতাশা নিয়ে৷
১৯৭১ সাল৷ মেলবোর্ন টেস্টের প্রথম তিন দিনই ধুয়ে গেল বৃষ্টিতে৷ বাকি দু'দিনে দু' দলের তিন ইনিংসও শেষ হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং ম্যাড়ম্যাড়ে ড্র অনিবার্য৷ তাই ঠিক হলো, একটা এক দিনের ম্যাচ হবে৷ দু' দল ব্যাট করবে ৪০ ওভার করে৷ প্রত্যেক ওভার হবে আট বলের৷সেই ম্যাচ ৫ উইকেটে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া৷ সেই থেকে ওয়ানডে ক্রিকেট শুরু৷ টেস্ট ক্রিকেট যাদের টানতো না, তারাও আসতে লাগলেন মাঠে৷ বাণিজ্য টুপ করে ঢুকে পড়ল ক্রিকেটে৷ তবে একদিনের ক্রিকেট শুরু হলেও খেলোয়াড়দের পোশাক ছিল সাদা, বলও ছিল লাল৷
রঙিন পোশাকের ক্রিকেটের শুরুও অস্ট্রেলিয়ায়৷১৯৭৭ সালে এই নতুনত্ব নিয়ে আসেন মিডিয়া টাইকুন কেরি প্যাকার৷তখনই প্রথমবারের মতো দেখা যায় দিন-রাতের খেলা৷ লাল বলের বদলে প্রথম হলুদ বলের খেলাও দেখা যায় সেখানে৷ পাঁচ দিনের খেলাই, তবে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডের স্বীকৃতি ছিল না বলে, ম্যাচগুলোর নাম দেয়া হয়েছিল ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট'৷ ম্যাচগুলোকে ‘সুপারটেস্ট'ও বলা হয়েছে, কারণ খেলা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া আর বিশ্ব একাদশের মধ্যে৷
দেশের হয়ে খেলা সবার জন্যই গর্বের৷ সেই গর্ব থেকে কেউ সহজে বঞ্চিত হতে চায় না৷ তাই বড় অঙ্কের টোপ ফেললেন প্যাকার৷
ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস, অ্যান্ডি রবার্টস-সহ ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের প্রায় সবাই দেখলেন সারা জীবন দেশের হয়ে খেলে যা আয় করবেন, এক সিরিজে মিলছে তার চেয়ে ঢের বেশি আয়ের সুযোগ৷ সুযোগটা লুফে নিলেন তারা৷ইংল্যান্ডের টনি গ্রেগ, পাকিস্তানের ইমরান খান, ভারতের সুনীল গাভাস্কার, বিষান সিং বেদী, দক্ষিণ আফ্রিকার এডি বারলোসহ বিশ্বের আরো অনেক তারকা ক্রিকেটারই যোগ দিয়েছিলেন প্যাকারের সেই বিতর্কিত আয়োজনে৷
সেখানে যোগ দেয়ার কারণে অনেক ক্রিকেটার একটা সময় পর্যন্ত নিজের দেশের হয়ে খেলার সুযোগ পাননি৷
কেরি প্যাকার সিরিজ চলেছিল দু' বছর ৷ ওই দুই বছরে ক্রিকেটে বাড়তি রঙ লেগেছে, বাণিজ্যের ঢেউ আরো প্রবল হওয়ায় সময় যত গড়িয়েছে সেই ঢেউ ক্রমে সর্বগ্রাসী হয়েছে৷
ওয়ানডের পর সিক্স-এ সাইড ক্রিকেট এসেছে, এসেছে টি-টোয়েন্টি, টি-টেন ইত্যাদি৷ পরিসরে যত ছোট, কম সময়ে উত্তেজনা তত বেশি৷ দর্শকের ভিড় বেশি, বাণিজ্যের সুযোগ বেশি, বিজ্ঞাপন বেশি, ক্রিকেটারদের আয়ের সুযোগও বেশি৷
প্রচারের এই দুনিয়ায় এখন খেলোয়াড়রা তো তারকাই, কোনো কোনো সমর্থকও তারকা৷ তারকা না হলে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সমর্থক শোয়েব বা ভারতের সমর্থক সুধীর গৌতমকে ক্রিকেট-বিশ্ব কখনো চিনতো!
দর্শক অহংকার, তবে উগ্র দর্শক লজ্জার
একটা জায়গায় ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশ শুরু থেকেই সেরা৷ বাংলাদেশের মতো ক্রিকেটপ্রেমী দর্শক আর কোনো দেশে নেই৷ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে কেউ যখন পাত্তাই দিতো না, তখনো ঢাকা, চট্টগ্রামের গ্যালারি উপচানো দর্শকের ভূয়শী প্রশংসা করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম; বিভিন্ন দেশের গ্রেট ক্রিকেটাররা বাংলাদেশ দলের দুরবস্থা নিয়ে একদিকে কথা বলেছেন, অন্যদিকে টাইগার-ভক্তদের প্রশংসায় যোগ করেছেন নতুন নতুন উপমা৷
গ্যালারির দর্শক এখনো বাংলাদেশের অহঙ্কার৷ তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন ভক্তেরও অভাব নেই যাদের আচরণ, কথাবার্তা খুব উগ্র এবং বিদ্বেষপূর্ণ৷এমন ভক্ত সব দেশেরই আছে৷ তবে তাদের নিয়ে কোনো দেশ অহঙ্কার করে না৷
ভারতে ক্রিকেট নাকি ‘দ্বিতীয় ধর্ম'৷সে দেশে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি হয়, ধর্মের রাজনীতি করে ক্ষমতায় গিয়ে সংবিধানের ‘ধর্মনিরপেক্ষতা' শব্দটিকেই লজ্জায় ফেলা হয়৷ তারপরও তারা জোর গলায় বলে, ‘‘ক্রিকেট আমাদের দ্বিতীয় ধর্মের মতো, কারণ, টিম ইন্ডিয়া মাঠে থাকলে সব বিভেদ ভুলে যায় সারা দেশ, গ্যালারিতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়৷''
কথা ঠিক৷ তবে এটাও ঠিক যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ভারতীয় উগ্রতা ছড়ায় চরমভাবে৷বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের তারা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে সৌজন্যের সব সীমা ছাড়িয়ে৷
এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে মিডিয়ার একাংশের ক্রিকেটের চেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তুলে ধরার দৃষ্টিকটু প্রবণতা৷ বিজ্ঞাপনের নামে এক ধরনের উসকানিও অনেক সময় আগুনে ঘি ঢালে৷
এসবের প্রভাব পড়ে মাঠেও৷
অন্যায় আর প্রতিবাদকারী কি এক?
পৃথিবীতে যুগে যুগে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে প্রতিবাদী মানুষ৷ প্রতিবাদ হয়েছে রাজনীতির ময়দানে, প্রতিবাদ হয়েছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, খেলার মাঠেও হয়েছে অনেক রকমের প্রতিবাদ৷ সব সময় প্রতিকার যে হয়েছে, অন্যায়কারীরা যে নির্মূল হয়েছে, তা নয়৷ তবে প্রতিবাদকারীরা সম্মানটা পেয়েছে আর অন্যায়কারীরা পেয়েছে অবজ্ঞা কিংবা ঘৃণা৷
কিন্তু অন্যায়ের জবাব একই ধরনের অন্যায়ই হলে অন্যায়ের নতুন রাজ্যের বিস্তারই হয় শুধু; ন্যায়-নীতি, শান্তি, সুন্দর হয় কোণঠাসা৷
অথচ এমন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতাই চলছে এখন৷ ‘‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন'' প্রশ্নটা নিজেকে করতে ভুলেই যান অনেকে৷
তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা কাম্য, কদর্য বৈরিতা কখনোই নয়
ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় দুটি রাইভালরির কথা বললে অস্ট্রেলিয়া বনাম ইংল্যান্ড আর ভারত বনাম পাকিস্তান ক্রিকেট-যুদ্ধের কথা আসবেই৷ ‘যুদ্ধ' শব্দটি খেলাধুলা বা কোনো ‘সুস্থ' প্রতিযোগিতার সঙ্গে একেবারেই যায় না৷ তবে এটাও ঠিক, ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচকে ঘিরে আকাশে-বাতাসে অদৃশ্য বারুদ নানাভাবে ছড়ায়৷
তবে এ উপমহাদেশের খেলোয়াড়রা মাঠের উত্তেজনা কখনোই বাইরে যেতে দেননি৷ অস্ট্রেলিয়া স্লেজিংকে শিল্পের উচ্চতায় তুলেছে৷ স্লেজিং করে না এমন দেশ তো এখন একটাও নেই৷ তবে স্লেজিংকে আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধ বা মারামারির পর্যায়ে অস্ট্রেলিয়া ছাড়া আর কোনো দল আগে কোনোদিন নেয়নি৷ জাভেদ মিয়াঁদাদকে উত্যক্ত করে ডেনিস লিলির প্রায় মারামারিতে নেমে পড়ার মতো দৃশ্য টেস্ট ক্রিকেট একবারই দেখেছে৷
ক্রিকেটকে সুস্থ প্রতিযোগিতার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রথম চেষ্টাটা করেছিল ইংল্যান্ড৷ করে সফলও হয়েছিল৷ প্রায় নয় দশক আগে স্যার ডনাল্ড ব্র্যাডম্যানের দাপটে অ্যাশেজে ইংলিশরা যখন গো-হারা হারছিল, তখন শরীর বরাবর বল করার অপকৌশলে একটা সিরিজ ৪-১-এ জিতেছিল ডগলাস জার্ডিনের ইংল্যান্ড৷ জিতলেও ইতিহাস সেই জয়ে কোনো বীরত্ব দেখেনি, ১৯৩২-৩৩ মৌসুমের সেই অ্যাসেজের নাম তাই কুখ্যাত ‘বডিলাইন সিরিজ'৷
ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথে কিন্তু মাঠে বা মাঠের বাইরে মারামারির পরিস্থিতি একবারও তৈরি হয়নি৷ তার মানে এই নয় যে কেউ কখনো কাউকে ছেড়ে কথা বলেছে৷ প্রতিপক্ষকে কেউ একচুলও ছাড় দেয়নি কোনোদিন৷ চোখে চোখ রেখেই লড়েছে দুই পক্ষ৷ কেউ জিতেছে, কেউ হেরেছে৷ হেরে যাওয়া দেশের উগ্র কিছু সমর্থক ক্রিকেটারদের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে, ক্রিকেটারদের বাড়ি-ঘরও পুড়িয়েছে কখনো কখনো৷ কিন্তু ক্রিকেটাররা কখনোই মাঠের উত্তেজনা বাইরে নিয়ে ক্রিকেটের চেতনাকে খাটো করেননি৷
এক সময় পাকিস্তানের সঙ্গে খেলা হলেই হারতো ভারত৷ এখন উল্টো সময়৷ বেশিরভাগ ম্যাচেই ভারত জেতে৷ ওয়ানডে বিশ্বকাপে তো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে একটাও জয়ের দেখা পায়নি পাকিস্তান৷ তবু পাকিস্তানের ক্রিকেটাররা কোনোদিন উত্তেজনাকে মাত্রা ছাড়াতে দেননি৷
জয়-পরাজয়ের হিসেবে পাকিস্তান এখনো ভারতের চেয়ে এগিয়ে৷ টেস্ট, ওয়ানডে দুই জায়গাতেই৷ তাই বলে ভারতীয় ক্রিকেটাররাও কোনোদিন পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়ানোর মতো কদর্য মানসিকতা দেখাননি৷
বাংলাদেশ যেন হেরে না যায়
ভারতকে হারিয়ে অনূর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ জিতেছে বাংলাদেশ৷ এই প্রথম বিশ্বসভায় সেরা হলো বাংলাদেশ৷ এ আনন্দের, এ গর্বের তুলনা হয় না৷ তবে ফাইনালের জয়ে লজ্জাও মিশেছে৷ মাত্রাছাড়া উগ্র আচরণের জন্য দু দলের পাঁচজন ক্রিকেটারকে শাস্তি দিয়েছে আইসিসি৷
এমন ঘটনা লজ্জার৷ সবার জন্যই লজ্জার৷ এ লজ্জায় যেন আর পড়তে না হয়৷ জিতেও যেন আর একটুও না হারে বাংলাদেশ৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷