বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বড় ক্ষতি করেছে হাথুরুসিংহে
১৮ নভেম্বর ২০২৩কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে বিভাজিত করছেন বলেও মনে করেন তিনি৷ ‘ডয়েচে ভেলে'কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ব্যর্থতার কারণ খোঁজার পাশাপাশি উত্তরণের পথও দেখিয়েছেন তিনি৷ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাহেনুর ইসলাম।
ডয়েচে ভেলে : এবারের বিশ্বকাপে কেবল দুই ম্যাচ জিতেছে বাংলাদেশ৷ অথচ লক্ষ্য ছিল সেমিফাইনাল খেলা৷ অধিনায়ক সাকিব আল হাসানও বলেছেন বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যর্থ বিশ্বকাপ এটি৷ এই ব্যর্থতার কারণটা কি?
রকিবুল হাসান: আমরা আগে তিনটা করে ম্যাচ জিতেছি, এবার দুইটা জিতলাম৷ এই হিসাবে দলের উন্নতি বা অবনতির মূল্যায়ন করা যাবে না৷ আমি যদি উন্নতিই বলি, দেখা গেল আমি তিন ম্যাচ থেকে চার ম্যাচ জেতার মত অবস্থা করলাম, সেটা পাঁচ বা দশ শতাংশ৷ কিন্তু আমার প্রতিপক্ষরা তো বসে নাই৷ তারা তো উন্নতি করছে৷ তো সেই মাপকাঠিটাও আমাকে জানতে হবে, যে তারা কতদূর এগিয়েছে আর আমি তাদের পেছন পেছন কতদূর এগিয়েছি৷ এবার আমাদের খারাপ করার অন্যতম বড় কারণ, আমাদের প্রস্তুতিটা ঠিক হয়নি৷ আমাদের এই টিমটা কিন্তু ভালো ছিল৷ হঠাৎ করে দেখলাম বিশ্বকাপের তিন-চার মাস আগে থেকে দলটার মধ্যে একটা হযবরল অবস্থা৷
এই দায়টা কার?
তামিমকে দিয়ে শুরু হলো একটা বিতর্ক৷ তামিমকে রাখবে কি রাখবে না, এটা নিয়ে জলঘোলা হল৷ আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, ভবিষ্যতেও বলব-বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনেক বড় ক্ষতি করেছে কোচ চান্ডিকা হাথুরুসিংহেকে৷ এবং সামনেও কি কিরবে আমি জানি না৷ ও একবার আমাদের কোচ হিসাবে ছিল, আবার মাঝপথে চলে গিয়েছিল৷ তারপর আবার তাকে আনলাম৷ কোচ পাওয়া যায় না বিশ্বক্রিকেটে আর আমাদের দেশে কোচরা আসতেও চায় না৷ এ পর্যন্ত ইতিহাস নাই যে কোন কোচ সম্মানের সঙ্গে বিদায় হয়েছে বাংলাদেশ থেকে৷ তবু বলব. হাতুরাসিংহে এমন কোন উঁচু মানের কোচ নয়৷ আগের বারও দেখেছি, এবারও দেখছি তার একটা পলিসি যে, সিনিয়র খেলোয়াড়দের সে সরিয়ে দিতে চায়৷ এটা ভুল৷
বিশ্বকাপের উত্তাপটা অন্যরকম৷ এটা খুবই উঁচু মানের প্রতিযোগিতা৷ এখানে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়রা খেলবে এবং খেলে৷
বিশ্বকাপটা ভারতে হওয়ায় অনেক আশাবাদী ছিল বাংলাদেশ৷ কন্ডিশনটা সাকিবরা কাজে লাগাতে পারলেন না কেন?
ভারতের কন্ডিশন কিন্তু দশ বছর আগের মত নেই৷ এখন ভারতের পিচ বলি, খেলোয়াড় বলি বা আবহাওয়া বলি-এতগুলো স্টেডিয়াম তারা করে ফেলেছে৷ এত বড় দেশ৷ এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে খেলতে গেলে পরিবেশ বদলে যায়৷ ধর্মশালায় খেলতে গেলে ঠান্ডা পরিবেশ৷ চেন্নাইয়ে আবার গরম৷ এই যে সুইচ ওভার, সুইচ অফ-এই জিনিসগুলো আমরা ধাতস্থ করতে পারিনি৷ আমাদের ব্যাটাররা পারেনি বিশেষ করে৷ আর ক্রিকেট তো ব্যাটারদেরই খেলা৷ আমাদের বোলারদেরও সমস্যা হয়েছে৷ একই সঙ্গে কিন্তু অন্য দলগুলোও স্ট্রাগল করেছে প্রথম দিকে, শুধু ভারত ছাড়া৷ অস্ট্রেলিয়ার মত দল ধারাশায়ী হয়েছে ভারতের সঙ্গে৷ শ্রীলঙ্কা ৫০ রানে গুটিয়ে গেছে৷
তামিম ইকবালকে যেভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে সেটা কতটা প্রভাব রেখেছে দলের ওপর?
তামিমকে দলে না রাখাটা একটা বিরাট ভুল আমি মনে করি আমি৷ তামিম ফিট ছিল৷ মেডিক্যাল টিম, ফিজিও ওকে ক্লিয়ারেন্স দিয়েছিল৷ সে যাবে, খেলবে৷ কিন্তু অধিনায়ক সাকিবও তাকে রাখতে চায় না৷ এটা একেবারে প্রকাশ পেয়ে গেছে৷ কেন রাখতে চায় না, কোচও কেন রাখতে চায় না, এটা তদন্ত করলেই জানা যাবে৷ কিন্তু দেশের ক্ষতি যেটা হওয়ার সেটা হয়ে গেছে৷ তামিম খেললেই যে আমরা আরেকটা ম্যাচ জিতে যেতাম সেটা বলব না৷ তবে দলের ভারসাম্যটা ঠিক থাকত, শক্তিমত্তাটা আরও একটু বেশি থাকত৷ এগুলো প্রভাব ফেলেছে দলের মধ্যে৷
তরুণরা পারফর্ম করতে পারেনি এবার৷ তারাও কি তামিমের ঘটনায় অনিশ্চয়তায় ভুগেছিল?
আমাদের এই দলে কিছু তরুণ খেলোয়াড় ছিল৷ তিন-চার জনের মত৷ তারা আগামী দিনের খেলোয়াড়৷ এরকম ঘটনা যখন ঘটে (সাকিব-তামিমের দ্বন্দ্ব) তখন এগুলো প্রভাব ফেলে৷ সাকিব আবার অধিনায়ক হয়ে টিভিতে যেয়ে বলে দিলেন যে তামিম ভালো টিমমেট না৷ যেটা আরও বেশি ক্ষতি করেছে৷ তাহলে সাকিব নিজে কি ভালো টিমম্যান৷ উনি তো এশিয়া কাপ থেকে দেশে ফিরে এসে বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় গেলেন৷ এটা কোন দেশে হয় না৷ এটা পরিবারের কারও অসুখ হলে অন্য ব্যাপার৷ কাজেই আমি বলব, এখানে ম্যানেজমেন্টেরও সমস্যা আছে৷ আমরা বিশ্বকাপের দল ঘোষণা করলাম একেবারে শেষ দিনে৷ সেটাই প্রমাণ করে আমাদের প্রস্তুতিটা ঠিক ছিল না৷ আমাদের শৃংখলাও ঠিক ছিল না৷
ব্যাটিং অর্ডার বদলে দেওয়া নিয়েও বিতর্ক হয়েছে যথেষ্ট৷
ব্যাটিং অর্ডার আমরা অনেক বেশি পরিবর্তন করেছি৷ একজন তিন নম্বরে ভালো করলো, অথচ পরের দিন তাকে খেলানো হচ্ছে অন্য পজিশনে৷ হ্যাঁ, ব্যাটিং অর্ডারে পরিবর্তন হয়, সেটা প্রয়োজনে৷ পাঁচ-ছয়টা দ্রুত আউট হয়ে গেলে কোন একজন ব্যাটসম্যানকে প্রটেক্ট করাটা পুরনো রীতি৷ তাই বলে ধারাবাহিকভাবে তো এটা করা যায় না৷
আর আমরা একটা জিনিস ভুলে গেছি, প্রথম থেকে আমাদের স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, খেলোয়াড়রা দেখিয়েছে, অফিসিয়ালরা দেখিয়েছে, সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারা দেখিয়েছেন, যে আমরা সেমিফাইনাল খেলব৷ আমরা একেবারে সেমিফাইনাল খেলতে যাচ্ছি! অথচ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই জায়গা করতে পারছিলাম না৷ শ্রীলঙ্কা যদি ওভাবে ক্লোজ ম্যাচে না হারত, তাহলে হয়ত আমরা বাইরে থাকতাম৷ এই সমস্যাগুলো থাকলে একটা দল ভালো খেলতে পারে না৷
বাংলাদেশ প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানকে হারিয়েছে৷ সেই ধাক্কা কাটিয়ে আফগানরা আশা জাগিয়েছিল সেমিফাইনালের৷ আর বাংলাদেশ পিছিয়ে গেছে ক্রমাগত৷ এর কারণটা কি?
রকিবুল হাসান : কি খেলাটা না ওরা খেলেছে৷ এই বিশ্বকাপে বলা হচ্ছে আফগানিস্তান সবচেয়ে রেসপেক্টেড দল এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় দল৷ ওরা চারটা ম্যাচ জিতেছে এবং যেভাবে খেলেছে-মানে ওরা দেশের জন্য খেলেছে৷ জয়ের জন্য খেলেছে৷ জানবাজি ধরে খেলেছে৷ কিন্তু আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে এগুলোর ঘাটতি দেখা গেছে৷
এই ব্যর্থতা কাটাতে কি করতে হবে বাংলাদেশকে?
বিসিবিকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ শুনলাম ওরা এই ব্যর্থতার একটা পোস্টমর্টেম করবে৷ তবে এখানে নিরপেক্ষ ইনকোয়ারি কমিটি হওয়া উচিত৷ তবে মাথায় রাখতে হবে এটা চোর ডাকাত ধরার জন্য করব না৷ এখানে কি কি ভুল ছিল, কি ব্যত্যয় হয়েছে৷ এগুলো খুঁজে এখন কি করা উচিত সেটা ঠিক করতে হবে৷ বুঝতে হবে আমরা যে এখন ক্রিকেট খেলছি এটা সেই ৩০ বছর আগের ক্রিকেট না৷ এখন ক্রিকেট হয়ে গেছে একটা সায়েন্স৷ ক্রিকেট এমনিই একটা সায়েন্স, এখন সেটা আরও বেশি৷ একই সঙ্গে জিওমেট্রিক খেলা৷ ব্যাটিংয়ের অ্যাঙ্গেল আছে, বোলিংয়ের অ্যাঙ্গেল আছে৷ এগুলো টিম ম্যানেজমেন্টকে মাথায় নিতে হবে৷
টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদ বিশ্বকাপ চলার সময় বিস্ফোরক কথা বলেছিলেন সংবাদ মাধ্যমে৷
ভাই বিশ্বকাপে কোন দেশের টিম ডিরেক্টর আছে? একটা দেশেরও নাইা৷ উনি একজন বোর্ডের ডিরেক্টর৷ এবং উনি কি করলেন, উনি জানেনই না যে উনার কাজটা কি৷ উনি আবার এটা অভিযোগ করলেন, এটা ওখানে খেলোয়াড়রা দেখল, দেশের মিডিয়া-বাইরের মিডিয়া দেখল যে আমাকে দল নির্বাচনে ডাকা হচ্ছে না৷ আমি ওখানে আমার মতামত দিতে পারছি না৷ এখানে ক্যাপ্টেন আর কোচ দল করতেছে৷ আমি কেন আসলাম, আগে জানলে আসতাম না৷ আপনাকে আসতে বলছে কে? এক৷ দুই নম্বর কথা হচ্ছে টিম খেলা চলাকালীন কোন সময় অন্য কেউ ইনভলভ হবে না৷ একমাত্র ক্যাপ্টেন এবং কোচই সব করবে৷ এগুলো যখন আপনি পাবলিকলি বলতেছেন, তখন ব্যাপারটা এমন দাঁড়ায়-আমরা খেলায় হারছি একই সঙ্গে সম্মানহানিও হচ্ছে৷ ঘরের কথা আমরা পাবলিকলি বলতেছি৷ এটা ভেতরেই বলা উচিত ছিল৷ এসব টিম ডিরক্টরের মত পোস্ট কোনভাবে সৃষ্টি করা উচিত না৷ ছোট্ট একটা ম্যানেজমেন্ট নিয়ে চলে যাওয়া উচিত,সাপোর্ট স্টাফ নিয়ে৷
নির্বাচক কমিটি নিয়েও বিতর্ক হচ্ছে৷ বাংলাদেশের ব্যর্থতায় নির্বাচকদের ভূমিকা কতটা দেখছেন৷
১২ বছর ধরে এই সিলেকশন কমিটি আছে (প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদিন)৷ তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান সব ঠিক আছে৷ কিন্তু গোটা পৃথিবীতে তো ১৫ বছর ধরে এক সিলেকশন কমিটি থাকে না৷ কারণ নতুন লোক আসবে, নতুন চিন্তা ভাবনা চেতনা আসবে৷ নতুন আইডিয়া আসবে৷ নতুন এনার্জি আসবে৷ এই দিক থেকে আমি মনে করি পুরো সিলেকশন কমিটির পরিবর্তন হওয়া উচিত৷ নতুন কমিটি যেটা হবে সেটা যেন অভিজ্ঞদের দিয়ে করা হয়৷ এমন না যে কারও খাতিরের লোককে এনে বসিয়ে দেয়া হয়৷ অভিজ্ঞ এবং জানাশোনা লোক দিয়ে করতে হবে৷