আটক হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন ওরফে ইবনে হামদান সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর হয়ে লড়াইয়ের জন্য ‘জিহাদি’ পাঠাতে বাংলাদেশে আসে৷ শুরু করে জিহাদি ‘রিক্রুট’, যাতে সাহায্য করে নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে এই তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘‘লন্ডন থেকে ঢাকায় আসা সামিউন আটক হওয়ার আগে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে জিহাদি রিক্রুটের জন্য একাধিক বৈঠক করেছে৷ তাঁর কাছ থেকে যেসব তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তাতে নিশ্চিত যে সে নিজে জঙ্গি সংগঠন আইএস বা আইসিস-এর সদস্য এবং ঢাকায় আসার আগে এক বছর আইএস-এর হয়ে সিরিয়ায় লড়াই করেছে৷''
তিনি জানান, ‘‘গ্রেপ্তারের পর তাকে প্রথম দফায় রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে৷ এছাড়া তার সম্পর্কে আরো তথ্য-সংগ্রহ করা হচ্ছে৷ কারণ এরপর তাকে আবারো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নেয়া হবে৷ প্রথম দফার রিমান্ডে সামিউন স্বীকার করে যে, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ থেকে অন্তত ১০০ জন জিহাদি সিরিয়ায় পাঠানোর টার্গেট ছিল তার৷''
বাংলাদেশের গোয়েন্দা সূত্রগুলোর সন্দেহ, এরই মধ্যে হয়ত বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু জিহাদি সিরিয়ায় গেছে৷ মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘আমরা অনুসন্ধান করে দেখছি বাংলাদেশ থেকে কোনো জঙ্গি সিরিয়ায় আদৌ গেছে কিনা৷ তবে এখনও পর্যন্ত কেউ গেছে বলে আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই৷''
তিনি বলেন, ‘‘ইরাক ও সিরিয়া ভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএস বাংলাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করার চেষ্টা করছে৷ আর এই নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে তারা পুরনো জঙ্গি সংগঠন, বিশেষ করে জেএমবি-র সহায়তা নিচ্ছে৷'' তবে গোয়েন্দারা দাবি করছেন যে, তাঁরা আইএস-এর প্রাথমিক চেষ্টা ভণ্ডুল করে দিতে পেরেছেন৷
আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বা যোগাযোগ তৈরির চেষ্টা করছে এ রকম সন্দেহে গত দেড় মাসে বাংলাদেশে অন্তত ১৪ জন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এদের মধ্যে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি-র শীর্ষ পর্যায়ের নেতাও আছে৷
গত ২৮শে অক্টোবর বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন ওরফে ইবনে হামদানকে ঢাকায় গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আইএস-এর সরাসরি তত্পরতা স্পষ্ট হয়৷ সামিউনকে আটকের পর তাঁর ব্রিটিশ পাসপোর্ট এবং ছয়টি মোবাইল ফোন থেকে আইএস-এর বাংলাদেশে তত্পরতার তথ্য পাওয়া যায়৷
মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সামিউনের মোবাইল ফোন, অর্থাৎ তার করা এসএমএস থেকে বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে৷ জানা গেছে, বাংলাদেশে আইএস নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রাথমিক পরিকল্পনার তথ্য৷''
সামিউনের মূল বাড়ি বাংলাদেশের হবিগঞ্জে৷ তবে সেখানে তার পরিবারের কেউ থাকেন না৷ তার বাবা-মাসহ সবাই লন্ডনে আছেন দীর্ঘদিন ধরে৷ সামিউন ঢাকায় আসার পর গুলশানের আজাদ মসজিদ ও সিলেটের হযরত শাহজালাল মাজার মসজিদে বৈঠক করে৷ বৈঠকে জেএমবি ও আনসারউল্লাহ ‘বাংলা টিম'-সহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরাও উপস্থিত ছিল৷
আইএস বিরোধী লড়াইয়ের আঁচ জার্মানিতে
গত জুন মাসে ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস)৷ চরমপন্থি ইসলামি সংগঠনটির লক্ষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এদিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে জার্মানিতেও৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
জার্মানিতে সংঘর্ষ
সুদূর ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতার আঁচ জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে৷ উত্তরের হামবুর্গ ও সেলে শহরে মঙ্গলবার (০৭.১০.১৪) কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে উগ্রপন্থি মুসলমানদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus Scholz
গনসচেতনতার উদ্যোগে বাধা
জার্মানিতে বসবাসরত কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে গত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করেছে৷ কখন উগ্রপন্থিরা তাদের বাধা দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Alexander Koerner
কোবানিতে তীব্র লড়াই
এদিকে সিরিয়ার কোবানি বা আইন আল-আরব শহরে আইএস জঙ্গিদের ব্যাপক হামলা চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে এক লাখেরও বেশি সিরীয় কুর্দি এলাকা ছেড়েছে৷ অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ তুরস্কে৷ আইএস জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিদের আধা সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/SEDAT SUNA
আপাতত রক্ষা
কুর্দি এই নারী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে আইন আল-আরব থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহরটিতে আইএস-এর হামলা তীব্র হওয়ার পরপরই তাঁরা তুরস্কে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/Alice Martins
আতঙ্ক
তখনও আইন আল আরব সীমান্তে চলছে তীব্র লড়াই৷ এই কুর্দি পরিবার আইন আল-আরব থেকে এসে তুরস্কের সীমান্তে অপেক্ষা করছে৷ ইরাকে কুর্দি নারীদের আইএস যেভাবে তুলে নিয়ে বিক্রি করেছে, তাড়াতাড়ি পালাতে না পারলে তাঁদেরও একই পরিণতি হতে পারে এই আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁদের৷
ছবি: DW/Alice Martins
অসহায়ত্ব
তুরস্কেও ভালো নেই আইন আল-আরব ছেড়ে আসা কুর্দিরা৷ খাবারদাবার, এমনকি খাওয়ার পানিও ঠিকমতো জোটে না৷ একটি সংগঠন তাই চাঁদা তুলে পানির বোতল কিনে এনে বিতরণ করছে শরণার্থীদের মাঝে৷
ছবি: DW/Alice Martins
দীর্ঘ অপেক্ষা
প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন একজন৷ আইন আল-আরব ছেড়ে আসা সিরীয়দের সে খাবারগুলো দিতে চান৷ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে্ তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে৷ ওদিকে খাবারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শরণার্থীরা৷
ছবি: DW/Alice Martins
যাত্রী চাই
সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুর্কি সরকার৷ এক মিনিবাস চালক তাই যাত্রীর অপেক্ষায়৷ শরণার্থীদের কেউ যদি তাঁর মিনিবাসে ওঠেন, তাতে নিজের তো সামান্য কিছু আয় হবেই, শরণার্থীদেরও উপকার হবে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: DW/Alice Martins
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইএস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইএস বা আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইএস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আর ইরাকে নুরি আল-মালিকির সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট বিদ্রোহীদেরই পাশে ছিল৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে৷ তবে ওবামা সরকার এখন আইএস-এর বিরুদ্ধে৷ জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Matthew Bruch
এবার আইন আল-আরব?
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আইন আল-আরব সাধারণের কাছে ‘কোবানি’ নামেই পরিচিত৷ তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের এ শহরের একটা অংশ এখন আইএস-এর দখলে৷ এবার কি তবে আইন আল-আরবও দখল করে নেবে আইএস? তারপর?
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
গত ১৮ই সেপ্টেম্বর আশুলিয়া থেকে গ্রেপ্তার করা হয় জেএমবি-র আমির আবদুল্লাহ আল তাসনীম ওরফে নাহিদসহ সাতজনকে৷ তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মো. আসিফ আদনান ও মো. ফজলে এলাহি তানজিলকে৷ এরা সবাই আইএস-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল এবং তুরস্ক হয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত পরিকল্পনা করছিল৷ আসিফ এবং তানজিল ব্রিটিশ নাগরিক সামিউনের সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ স্থাপন করে৷ ফেসবুকে প্রথম তার পরিচয় হয় আসিফের সঙ্গে৷ এরপর তানজিল আসিফের মাধ্যমে তার সঙ্গে পরিচিত হয়৷ এরপর সামিউন ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেয় বলে খবর৷
মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘বাংলাদেশে আইএস-এর অনুসারীদের তত্পরতা আমাদের নজরদারিতে আছে৷ কোণঠাসা হয়ে যাওয়া জঙ্গি সংগঠনগুলোর সদস্যরা ইরাক এবং সিরিয়ার ঘটনায় এখন নতুন করে আইএস-এর দিকে ঝুঁকছে৷ তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে৷''