ইইউর প্রতিবেদন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যা বলছে
১০ মার্চ ২০২৪তারা মনে করে এই নির্বাচনকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন(ইসি)।
তাদের প্রতিবেদনে, একপাক্ষিক নির্বাচন, গণগ্রেপ্তার, বিচারিক কার্যক্রম, বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেয়া, ভোটারদেও পছন্দের প্রার্থী বাছাইয়ের সুযোগ না থাকা, ভোটার উপস্থিতি কম, প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকাসহ আরো অনেক বিষয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ জানিয়েছে।
তবে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান এই প্রতিবেদনকে তেমন আমলে নিচ্ছেন না। তার কথায়," আমাদেরও তারা প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। এখনো দেখার সুযোগ পাইনি। আগে দেখি তারপর আমাদের কিছু বলার থাকলে বলব।”
আর সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেছেন." ইইউ যা বলেছে তা তো সবই ঠিক। কিন্তু তাতে আমাদের কী হবে। রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো ব্যাখ্যা দেবে।”
এদিকে বিএনপি নেতারা বলেছেন," আন্তর্জাতিক কেন, কোনো মানদণ্ডেই এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। ইইউর প্রতিবেদন আরো শক্ত হতে পারত।”
আর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন," ইইউ এই প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির উসকানি দিতে।”
গত জুলাই মাসে সার্বিক পরিবেশ নিয়ে ইইউ প্রাক-নির্বাচনী মিশন বাংলাদেশ সফরে প্রায় শতাধিক বৈঠক করে। বৈঠকগুলো থেকে ইইউ সিদ্ধান্ত নেয়, বাংলাদেশের নির্বাচনে কোনো পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। তবে নির্বাচন নিয়ে চার সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে পাঠায় সংস্থাটি। নির্বাচনের আগে ও পরে এ বিশেষজ্ঞ দলটি বিভিন্ন বৈঠক ও পরিবেশ-পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছে।
ইইউ প্রতিবেদনে যা বলেছে:
ইইউ ৭ মার্চ এনিয়ে ৩৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন ইউরোপীয় কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করায় ভোটাররা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার পুরোপুরি সুযোগ পায়নি। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নিজেদের প্রার্থী এবং একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্র্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হওয়ার কারণে ভোটারদের সত্যিকার অর্থে তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নেয়ার সুযোগ ছিলোনা।
তারা বলছে, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। গণগ্রেপ্তারের কারণে বিরোধীরা ব্যস্ত ছিল আদালতপাড়ায়। ফলে ছিল না আন্দোলন-সংগ্রামের স্বাধীনতা। বিচারিক কার্যক্রম এবং গণগ্রেপ্তারে মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়ে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতার মতো নাগরিক ও রাজনৈতি অধিকার যা প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের জন্য অপরিহার্য বাংলাদেশের নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা সীমাবদ্ধ ছিল। গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজও বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সহায়ক ছিল না। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সমালোচনামূলক বিতর্কও ছিল সীমিত।
ইসি প্রাথমিকভাবে বলেছিল, ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে। স্বচ্ছতা ও শক্তিশালী নিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের অভাব, সব দলের এজেন্ট না থাকায় ইসি ছাড়া ভোটের তথ্য যাচাইয়ের অন্য কোনো সুযোগ ছিল না।
সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিলো। নির্বাচন একটি খুবই একপাক্ষিক রাজনৈতিক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিরোধীরা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচন পরিচালনায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছিল, যা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
নির্বাচনের আগে বিরোধী দলের ধারাবাহিক বিক্ষোভ ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে গুরুতর সহিসংতায় রূপ নেয়। এর পর থেকে বিএনপি নেতাদের গণগ্রেপ্তার ও আটকের ফলে দেশের নাগরিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটে। নির্বাচনের পুরো সময়ে বিরোধী দলগুলোর সমাবেশ, সমিতি, আন্দোলন এবং বক্তৃতার স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত করা হয়।
নির্বাচনে ২৯৯ আসনের বিপরীতে (একটি আসনের নির্বাচন পওে হয়) এক হাজার ৯৭০ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ৭৪ শতাংশ প্রার্থী ন্যূনতম ভোট না পাওয়ায় জামানত হারিয়েছেন। আর মাত্র ১১ শতাংশ আসনে প্রতিযোগিতা দেখা গেছে। নির্বাচনে কোনো স্বাধীন আন্তর্জাতিক নির্বাচনী পর্যবেক্ষক পর্যবেক্ষণে আসেনি। কমনওয়েলথ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইআরআই ও এনডিআই একটি যৌথ মিশন ছোট বিশেষজ্ঞ দল পাঠিয়েছে। তবে ইসি খরচ দিয়ে কিছু একক বিদেশি পর্যবেক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল, যা নির্বাচনী পর্যবেক্ষণের আন্তর্জাতিক যে নীতিমালা রয়েছে, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
আওয়ামী লীগই ছিল একমাত্র রাজনৈতিক দল, যে বৃহৎ প্রচার মিছিলসহ যে কোনো উল্লেখযোগ্য জনসাধারণের কার্যক্রম সংগঠিত করতে পেরেছে। অন্যদের জন্য এই সুযোগ ছিলো নিয়ন্ত্রিত। নির্বাচনে প্রচারের সময় ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে সামাজিক সুরক্ষাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।
এবারের সংসদে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছে। আগের সংসদে এ সংখ্যা ১৮ থাকলেও, এবার ১৪-তে নেমেছে।
৩০০ আসনের মধ্যে চূড়ান্ত ফলাফলে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীরা ২২৩টি আসন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২টি, জাতীয় পার্টি পায় ১১টি আসন। জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি ও কল্যাণ পাটি একটি করে আসনে জিতেছে।
নির্বাচন কমিশনার যা বললেন:
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন," আমরা বৃহস্পতিবার প্রতিবেদনটি পেয়েছি, এখনো দেখতে পারিনি। পত্রিকায় যা লিখেছে তা একটু পড়েছি। আমরা কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। অন্যরা রিপোর্ট দেখেছে কী না আমি জানিনা।”
তার কথা," প্রতিবেদন দেখার পর আমাদেও কিছু বলার থাকলে বলব। যদি জানানোর থাকে জানাব। যদি জানানোর থাকে । তবে আমরা তো আগেই বলেছি। নির্বাচন নিয়ে আমরা তো আমাদের অবস্থানের কথা জানিয়েছি। এখন তারা তাদের প্রতিবেদন দিয়েছে। সেটা তাদের ব্যাপার। ”
তাকে প্রতিবেদনের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি পয়েন্ট বললেও তিনি বলেন," আগে প্রতিবেদন দেখি তার পর আমরা প্রয়োজন হলে কথা বলব।”
তবে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন," ইইউ যা বলেছে তার সবই তো ঠিক বলেছে। এখন এর ব্যাখ্যা সরকার একভাবে দেবে, বিএনপি একভাবে দেবে। সরকার বলবে বিএনপি নির্বাচনে না আসায় সবদলের অংশগ্রহণ প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। বিএনপি বলবে এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে গিয়ে কোনো লাভ ছিলোনা। গণগ্রেপ্তার, বিরোধী নেতাদের জেলে পাঠানো, একপাক্ষিক নির্বাচন এগুলো তো হয়েছে। কিন্তু সেখানে আমাদের কী করার আছে?”
তার কথায়," গণতন্ত্র তো শংকরায়ন হয়ে গেছে। এটা এখন না তামা, না লোহা, না অ্যালুমিনিয়াম। এ অবস্থা এখন সারা বিশ্বেই।”
ইইউর প্রতিবেদন আরো কড়া হওয়া দরকার ছিলো:
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন," দেরিতে হলেও ইইউ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে পর্যবেক্ষণ বা প্রতিবেদন দিয়েছে তা বাস্তব চিত্র। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যে এরকম হবে তা আমরা আগেই বলেছিলাম। এই কারণেই আমরা নির্বাচনে যায়নি। একমাত্র ভারত ছাড়া আর কারুর কাছেই এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।”
আর দলটির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন মনে করেন," ইইউ যে প্রতিবেদন দিয়েছে তা আরো জোরালো এবং শক্ত হওয়া দরকার ছিলো। কারণ এই নির্বাচন আন্তর্জাতিক কেন, কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য হয়নি।”
তার কথায়," এই সরকারের পদত্যাগ, সংসদ ভেঙে দেয়া এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অংশহণমূলক নির্বাচনই এর সমাধান। এই সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন তো দূরের কথা স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনও নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হয়না। সবখানেই তারা প্রভাব বিস্তার করে। পুলিশ ও প্রশাসনকে ব্যবহার করে।”
অস্থিতিশীলতার উসকানি দিতেই এই প্রতিবেদন:
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন," ইইউ প্রতিবেদন দিয়েছে আবার ওই সব দেশের সরকার ও রাষ্ট্র প্রধানরা প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই সরকারের সঙ্গে কাজ করার কথা বলেছেন। তাহলে তারা কী প্রতিবেদন দিলো! বিএনপি তো নির্বাচনে হেরে যাবে তাই নির্বাচনে আসেনি।”
আর দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদ মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন," বিএনপিকে তো নির্বাচনে আসতে কেউ বাধা দেয়নি। তাদের আন্দোলন ছিলো নির্বাচনের বিরুদ্ধে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। তারা সহিংসতা করেছে, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করেছে। তাই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ইউরোপে এই ধরনের অপরাধ করলে কি ছেড়ে দেয়া হতো?”
তার কথায়," নির্বাচন দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। বিএনপি না আসলে কি নির্বাচন হবেনা? ইইউ সব কিছু জেনেশুনেই এই প্রতিবেদন দিয়েছে বাংলাদেশে একটা অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির উসকানি দিতে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”