ছাত্র সংসদ নির্বাচন করতে কেন ব্যর্থ পশ্চিমবঙ্গ?
১১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
কোভিড অতিমারির আগে রাজ্যে ছাত্র নির্বাচন হয়েছিল। এরপরে একাধিক সাধারণ নির্বাচন হলেও কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদের ভোট হয়নি। প্রতিবেশী বাংলাদেশে ক্ষমতার হাতবদলের পরে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র নির্বাচন হচ্ছে। নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছেঢাকা ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা ডাকসুর নির্বাচন। বুধবার চলছে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি সেন্ট্রাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা জাকসুর নির্বাচন।
প্রতিবেশী দেশে ইউনিয়নের নির্বাচন করা গেলেওপশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে বাধা কোথায়, এই প্রশ্ন উঠছে বারবার।
রাজ্যে নেই ছাত্র সংসদ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও এই প্রতিষ্ঠানের অধীন কলেজগুলিতে ২০১৭ সালে শেষবার ভোট হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভোট নেয়া হয় ২০১৯ সালে। যাদবপুরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে ২০২০-তে। গত পাঁচ বছরে আর কোথাও ছাত্রভোট হয়নি।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করে সংগঠন। প্রতি বোঁচর কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নয়ন, নবীন বরণ, কলেজ ফেস্টসহ নানা প্রকল্প সফল করে ছাত্র সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। সাধারণভাবে, ছাত্র সংসদের খাতে প্রতি বছরেই নির্দিষ্ট তহবিল রাখা থাকে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে সেই তহবিল ব্যবহার করা হয়। বছরের পর বছর ছাত্র সংসদ গঠিত না হওয়ার ফলে ছাত্র সংসদের তহবিল সামলাবে কে, সেই নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
গত কয়েক বছর ধরে ছাত্রভোটের দাবি উঠছে। গত বছর আগস্টে আরজি কর হাসপাতালে চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের পরে এই দাবি জোরালো হয়। মেডিক্যাল কলেজে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে। বিরোধীদের অভিযোগ, ছাত্র সংসদ না থাকায় কর্তৃপক্ষ অবাধে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এর ফলে দুর্নীতি বাসা বাঁধছে।
বছর ঘোরার আগেই আরেকটি ঘটনায় আলোড়ন ওঠে শিক্ষা জগতে। গত ২৫ জুন সাউথ কলকাতা ল কলেজের ইউনিয়ন রুমে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে কলেজেরই সাবেক পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে মূল অভিযুক্ত মনোজিৎ মিশ্র-সহ তিনজনের নামে চার্জশিট পেশ করেছে পুলিশ। কলেজে ছাত্র সংসদ না থাকায় বহিরাগতদের দ্বারা নানা অনাচার চলছে, এই অভিযোগ উঠে আসে।
নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি
ছাত্রভোট কবে হবে এ নিয়ে বিস্তর জল্পনা চলছে। চলছে টালবাহানা। রাজ্য সরকার স্পষ্ট করে জানায়নি, কবে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হবে। যদিও একাধিকবার তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে নির্বাচন করানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি শোনা গিয়েছে।
২৮ অগাস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস। গত বছর এই অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, পুজোর পরে ছাত্র সংসদের নির্বাচন হবে। ২০২৪ সালের দুর্গোৎসব অতিক্রান্ত। এ বছরের পুজো আর সপ্তাহ দুয়েক বাকি। কিন্তু ছাত্র নির্বাচন নিয়ে কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাত্র নির্বাচনের কথা বলতে গিয়ে মহিলা সংরক্ষণের পক্ষে জোরালো সওয়াল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচনে ছাত্রীদের জন্য ৫৫ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। অর্থাৎ যে ছাত্র সংসদ গঠিত হবে সেখানে ছাত্রীরাই হবেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এক্ষেত্রে দেশকে পথ দেখাবে বাংলা। কিন্তু নির্বাচনই হয়নি।
এর মধ্যে একটিই ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে, যদিও সেটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। গত জুনে নির্বাচন হয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ভোটে একতরফা জয় পায় মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বা এমসিডিএসএ। ২০ আসনের মধ্যে ১৭টিতে তারা জেতে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের কোনো প্রার্থী নির্বাচনে লড়েননি। তাদের দাবি, স্বাস্থ্য ভবন এই নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেয়নি। একতরফাভাবে নির্বাচন করা হয়েছে।
কেন হচ্ছে না ভোট
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক আধিপত্য এখন অনস্বীকার্য। স্থানীয় প্রশাসন থেকে সংসদের স্তরে রাজ্যের শাসক দল বিরোধীদের অনেক পিছনে ফেলেছে। প্রেসিডেন্সির মতো সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের তৎপরতা ও প্রভাব রয়েছে। কিন্তু কেন নির্বাচন করাতে রাজ্য সরকার গড়িমসি করছে, এই প্রশ্ন উঠেছে।
এ জন্য দুর্নীতিকে দায়ী করছেন বিরোধী ছাত্র সংগঠনের নেতারা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএফআই আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক সৌগত তরফদার ডিডাব্লিউকে বলেন, "রাজ্য সরকার ছাত্রভোট করাতে চাইছে না বলে নির্বাচন হচ্ছে না। শিক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত স্তরে এই সরকার যে দুর্নীতি করেছে, তার ফল ভুগতে হচ্ছে ছাত্র সমাজকে। ছাত্ররাই এই সমাজের মূল প্রতিবাদী অংশ। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন হলে তারা শাসক দলের ছাত্র শাখার বিরুদ্ধে ভোট দেবে। এই হার এড়াতেই নির্বাচন করানো হচ্ছে না। এই সুযোগে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তৃণমূলের অনিয়ম চলছে।"
এআইডিএসও-র রাজ্য সভাপতি মণিশঙ্কর পট্টনায়ক ডিডাব্লিউকে বলেন, "বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে দুর্নীতি চলছে, সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সুযোগ তৈরি হয় ছাত্র সংসদের নির্বাচন হলে। ছাত্র-ছাত্রীরা এর বিরুদ্ধে তাদের মত জানাতে পারেন। এই গণতান্ত্রিক পরিসর তৈরি করতে রাজ্য সরকার রাজি নয়। একই সঙ্গে এটা বলতে হয়, রাজ্যজুড়ে শাসকের আধিপত্য থাকলেও তারা জানে, এর পিছনে রয়েছে অর্থ ও পেশিবল। তাই তারা ছাত্রদের সমর্থনের উপরে ভরসা করে ভোট করানোর সাহস পাচ্ছে না।"
উঠে আসছে তৃণমূলের গোষ্ঠী রাজনীতির কথাও। গেরুয়া শিবিরের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের দক্ষিণবঙ্গের রাজ্য সম্পাদক অনিরুদ্ধ সরকার ডিডব্লিউকে বলেন, "বিভিন্ন কলেজে তৃণমূল ছাত্র সংগঠনের একাধিক গোষ্ঠী রয়েছে। নির্বাচন ঘোষিত হলে এই গোষ্ঠীগুলির দ্বন্দ্ব চরম আকার নেবে বলে ভয় রয়েছে শাসক দলের। এছাড়া প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নামে যে বিপুল টাকা আদায় করা হয়, সেটা বন্ধ হয়ে যাবে নির্বাচিত সংসদ এলে। এই টাকার উৎসের কথা মাথায় রেখেও ভোট করাতে অনিচ্ছুক প্রশাসন। আমাদের দাবি, লিংডো কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী অবিলম্বে নির্বাচন করানো হোক। ভোট হলে শাসকদলের ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব থাকবে না।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সদস্য রনি ঘোষ অবশ্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "ছাত্র নির্বাচন হচ্ছে না, এটা ভুল কথা। এটা প্রচার চালানো হচ্ছে। ২০১৯ সালে যাদবপুরে ভোট হয়েছে। প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতীতে ভোট হয়েছে। কিছু সমস্যা থাকার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোট হয়নি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৪০ টার মতো কলেজ রয়েছে। সেখানে কিছু সমস্যা ছিল। কিছুদিন আগেই মেডিক্যাল কলেজে ভোট হয়েছে।"
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্য সেমেস্টার পদ্ধতির শিক্ষা ব্যবস্থার কথা একাধিকবার বলেছেন। এ বিষয়ে রনির ব্যাখ্যা, "আগে এক বছর পর পর পরীক্ষা হতো। এখন প্রত্যেক ছয় মাস অন্তর অন্তর পরীক্ষা। তার সঙ্গে রয়েছে অ্যাডমিশন। ভোটের জন্য আমাদের একটা তিন মাসের ফুরসত দরকার। সেই সময়টা পেয়ে ওঠা যাচ্ছে না। রাজ্য সরকার সব রকম চেষ্টা করছে যাতে ভোট করা যায়।"
উপাচার্য নিয়োগে রাজ্যপাল- রাজ্য সরকার বিরোধ
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে আচার্য তথা রাজ্যপালের বিরোধ চলছে মাসের পর মাস।
রনি বলেন, "রাজ্যপাল প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্বর্তী উপাচার্য নিয়োগ করেছেন, সেই উপাচার্যরা রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করার জন্যই ওই চেয়ারে বসে আছেন। তারা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছেন। তাদের একটাই লক্ষ্য, কীভাবে তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে আটকানো যায়। এই উপাচার্যদের সরিয়ে যতদিন না স্থায়ী উপাচার্য আনা যাচ্ছে, ততদিন ভোট করা কঠিন। রাজ্য সরকার স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের চেষ্টা করছে।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক রেজিস্ট্রার ডঃ রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, "তৃণমূলের মনোনীত প্রতিনিধিরা যদি সংসদে থাকেন, তাহলে তারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসা আর্থিক বরাদ্দ নিয়ে কী করা হবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে, সেই অনুযায়ী কাজকর্ম করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধি এলে, তারা শাসক দলের সংগঠনের হয়ে জিতলেও তাদের ভূমিকা পরে পাল্টে যেতে পারে। এর ফলে মনোনীত প্রতিনিধিরা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে নিজেদের মতো আচরণ করে, মনে করে এটা তাদের স্বাধীন এলাকা। এই ব্যবস্থা চলতে থাকুক, এটা সরকার চাইছে।"