বাংলাদেশকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা প্রভাবশালী প্রতিবেশি ভারতের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে একটা আবেগের সম্পর্ক রয়েছে আমাদের৷ কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সব আবেগই একসময় ফিকে হয়ে আসে, বাস্তবতার নিরিখে শুরু হয় হিসেব নিকেশ৷
বিজ্ঞাপন
আর সেজন্যই হয়তো ‘‘ফারাক্কায় বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশের সব পানি নিয়ে গেছে ভারত'', শৈশব থেকে এমন কথা শুনে শুনেই বড় হয়েছি আমরা৷ প্রতিবেশি যদি ভালই হয়, তবে সে আমাদের কষ্টে রেখে সব পানি নিয়ে যাবে কেনো? একবারো ভাববে না, অন্য প্রতিবেশির ভাল-মন্দ? এমন প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনের মধ্যে জেগেছে সে সময়৷
পরে ১৯৯৬ সালে আমরা যখন তারুণ্যে তখন দুই দেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগির একটা চুক্তি হয়, যাতে বাংলাদেশের শুকিয়ে যাওয়া পদ্মা তার প্রয়োজনীয় পানি প্রবাহ ফিরে পাবে বলে জানতে পারি আমরা৷ সেও তো ২৩ বছর পেরিয়ে গেল, কিন্তু বাস্তবে শীর্ণ পদ্মা আর আগের মত প্রমত্তা হলো কই? সরকারি লোকজনই মাপ-জোখ করে বলছেন, ‘‘চুক্তি অনুযায়ী পানি পায়নি বাংলাদেশ৷''
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷
ছবি: S. Rahman/Getty Images
12 ছবি1 | 12
৩০ বছরের গঙ্গা চুক্তি বহাল থাকবে আরো সাত বছর, বাকি দিনগুলিতে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পানি পাওয়া যাবে কিনা তাও নিশ্চিত নয়৷ প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়নের মধ্যে এই সমন্বয়হীনতার দাম দিতে হচ্ছে পদ্মা পাড়ের সাধারণ মানুষকে৷ তাদের জীবন-জীবিকা বদলে গেছে, নদীর মতই শুকিয়ে গেছে প্রাণ প্রবাহ৷
পানি নিয়ে বাংলাদেশের আরো এক দুশ্চিন্তার নাম তিস্তা, ভারতের জলপাইগুড়িতে ব্যারাজ বানিয়ে অপরিমিতভাবে পানি প্রত্যাহার করে নেয়ায় কমে গেছে বাংলাদেশের তিস্তার পানি প্রবাহ৷ সেখানে এখন পলি পড়ে জেগেছে বিস্তীর্ণ চর, বেড়েছে নদী তীরের মানুষের হাহাকার৷ বর্ষাকালে এই অঞ্চলের মানুষের প্রধান দুঃখ উজান থেকে ছেড়ে দেয়া তিস্তার পানি, আবার শুকনা মৌসুমেও তাদের দুঃখের নাম একটিই- তিস্তা, তবে সেটি পানিহীন তিস্তা৷ বেশ কয়েকবার এই বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকারের সাথে বাংলাদেশের আলোচনা হয়েছে, কিন্তু সবাই জানেন পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনীহায় এখনো তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে কোন চুক্তি করা সম্ভব হয়নি৷
এরই মধ্যে ভারতের ত্রিপুরার মানুষের খাবার পানির সংকট মেটাতে আমাদের ফেনি নদী থেকে ১.৮২ কিউসেক পানি নিতে ভারতকে অনুমতি দিয়ে দেয়া হয়েছে৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং বলেছেন, ‘‘কেউ যদি পানি পান করতে চায়, আর তা যদি না দিই কেমন দেখায়?'' প্রতিবেশীর প্রতি বাংলাদেশের এই মহানুভবতা নিঃসন্দেহে প্রচলিত দেনা-পাওনার হিসেবের উর্ধ্বে৷ কঠোর বাস্তববাদিরা হয়তো বলবেন, ‘গিভ এন্ড টেক'-এর এই দুনিয়ায় বাংলাদেশ ভারতকে দেয়ার ক্ষেত্রে যতটা উদার নেয়ার ক্ষেত্রে ততটা পারদর্শী নয়৷
অনেকেই বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশ ভারতের স্বার্থকে যতটা প্রাধান্য দিচ্ছে, ভারত বাংলাদেশের স্বার্থকে ততখানি মূল্যায়ন করেনি৷ অথচ যে কোন সম্পর্ক টেকসই হতে হলে, দুই পক্ষই নিজেদের ‘উইন-উইন' অবস্থানে ভাবতে পারাটা জরুরী৷
কিছুদিন আগে এডভোকেট সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘‘ভারত আমাদের পাশে না থাকলে স্বাধীনতা যুদ্ধ যেভাবে শেষ হয়েছে সেভাবে হতো না, কিন্তু কথা হলো, তার পরিবর্তে আজকে বাংলাদেশকে নিজেদের বাজারের জায়গা বানিয়েছে ভারত৷''
আসা যাওয়ার মাঝে আটক রোহিঙ্গারা
২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে দাঙ্গার পর নতুন করে অনিশ্চিত হতে শুরু করে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত৷ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়ে বর্তমানে আবার অনিশ্চিত বাংলাদেশের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জীবন৷
ছবি: picture-alliance/abaca/O. Elif Kizil
নাগরিকত্বের প্রশ্ন
ধর্মীয় সংখ্যালঘুত্ব, ক্রমাগত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অস্পষ্ট নাগরিকত্ব- মূলত এই তিন কারণেই চাপের মুখে দেশ ছাড়তে শুরু করেন মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর মানুষ৷ ২০১২ সালে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে দাঙ্গা বাধে, ফলে চাপ আরো ঘনীভূত হয়৷ ১৯৯০র দশক থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা দেশছাড়া, বলছে জাতিসংঘ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Qadri
বিশ্বের নজরে রোহিঙ্গা নৌকা
২০১৫ সালে ঘরছাড়া রোহিঙ্গারা সমুদ্রপথে আশ্রয়ের খোঁজে বের হয়৷ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের দাবি তোলে৷ একই সময়, ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ পত্রিকা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতির তালিকায় স্থান দেয় রোহিঙ্গাদের৷ আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ছেয়ে যায় সমুদ্রে ভাসন্ত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌকার ছবিতে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Pruksarak
বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি
জাতিসংঘের শরণার্থী কমিশন (ইউএনএইচসিআর) জানাচ্ছে, ২০১২ থেকে রোহিঙ্গারা ছোট ছোট দলে বাংলাদেশে আসলেও, ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে তাদের আগমনের হার বেড়ে যায়৷ এখন পর্যন্ত, মোট সাত লাখ ৪৫ হাজার জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারে অবস্থান করছে বলে জানাচ্ছে তারা৷ টেকনাফ ও উখিয়া উপজিলাতে ৩৪টি ক্যাম্পে এদের বসবাস৷
ছবি: DW/A. Islam
এছাড়াও যেখানে...
বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে৷ এছাড়াও রোহিঙ্গারা রয়েছে ভারত, ফিলিপাইনস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশেও৷
ছবি: Getty Images/Afp/C. Archambault
স্থানান্তর শুরু
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পাঠানো হবে রোহিঙ্গাদের, শুরু হবে তাদের স্থানান্তর, জানায় বাংলাদেশ সরকার৷ নথিভুক্ত রোহিঙ্গাদের মধ্যে থেকে প্রাথমিকভাবে ৩২ হাজার শরণার্থী স্থানান্তরের কথা বলা হয় সেখানে৷ নথিভুক্ত করার প্রক্রিয়ায় সরকার বায়োমেট্রিক ডেটা ব্যবহার করা শুরু করে৷
ছবি: DW/M. Mostqfigur Rahman
প্রত্যাবাসনের আলোচনা
২০১৭ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সরকার আলোচনায় বসলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়৷ ২০১৮ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, আগামী দুই বছরের মধ্যে প্রত্যাবাসনের কাজ সম্পন্ন করার কথা নিশ্চিত করেছে মিয়ানমার৷ ২০১৯ সালের আগস্ট মাস থেকে শুরু হয়েছে ‘স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের’ প্রক্রিয়া৷
ছবি: DW/A. Islam
টেকনাফ থেকে
বর্তমানে টেকনাফে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া চলাকালীন সেখানে রয়েছেন ডয়চে ভেলের সাংবাদিকেরা৷ সেখানে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে তারা জানিয়েছেন যে, সরকারী সাহায্য থাকা সত্ত্বেও, এখনই কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী ফিরে যেতে অনিচ্ছুক৷ শুধু তাই নয়, নাগরিকত্ব, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ের মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের পক্ষে নিশ্চয়তার অভাবে রোহিঙ্গারা এখনই ফিরে যেতে চাইছেন না৷ ফলে, প্রশ্নের মুখে প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ সাফল্য৷
ছবি: picture-alliance/abaca/O. Elif Kizil
7 ছবি1 | 7
এটা ঠিক, দুইদেশের মধ্যে স্থল ও সমুদ্রসীমা নির্ধারণ এবং ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে৷ তবুও অর্থনীতিবিদরা বরাবরই কথা বলেন, বাংলাদেশ ভারতের অব্যাহত বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে৷ যদিও গত অর্থবছরে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানির পরিমাণ ১০০ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, আর সেটা হয়েছে মূলত তৈরি পোষাক রফতানি থেকে৷ অর্থনীতিবিদদের মতে, শুধু এরকম একটা দুটো পণ্য নিয়ে বাণিজ্যে বাংলাদেশ হয়তো ভারতের বাজারে তেমন সুবিধা করতে পারবে না৷ কারণ এখনো আমরা রপ্তানির চাইতে ভারত থেকে আটগুণ বেশি আমদানি করি৷ বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, দুই দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৭৫ কোটি ডলার৷ অনেকেই মনে করেন, বিনিয়োগ সুবিধা ও সেবা বিক্রির ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতের সাথে দেন দরবার করে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারে৷
তবে বাণিজ্যের চাইতে অভিন্ন নদীগুলির পানি প্রবাহ সচল রাখার ক্ষেত্রে দ্রুত সমঝোতায় আসাটাই দুই দেশের দেনা-পাওনার সম্পর্কটা শক্ত করতে সবচেয়ে জরুরি বলে মনে করেন তারা৷ দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক প্রাণবন্ত রাখতে হলে অর্থনৈতিক জায়গার পাশাপাশি পানি বণ্টনের বিষয়টির সুস্পষ্ট সুরাহা হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মত তাদের৷
বাংলাদেশের আরেক গলার কাঁটা রোহিঙ্গা সংকট৷ এই সংকট সমাধানে বড় লোক প্রতিবেশি ভারতের কোনো আন্তরিক উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না, বরং আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ যেমন আশা করেছিল তেমন জোরালো কোন ভূমিকাই রাখেনি ভারত৷ উল্টো, এ বছরের শুরুর দিকে ভারত তাদের দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়ে সংকট আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে৷
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় সামাজিক সাংস্কৃতিক বিষয়গুলিকে যতটা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, অর্থনৈতিক ও পরিবশগত বিষয়গুলিকে ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷ অথচ কৌশলগতভাবে অর্থনৈতিক অংশীদারিত্বের বিষয়টিতে জোর দেয়াই আমাদের জন্য বেশি জরুরি ছিল৷ জরুরি ছিল নদীর পানি, রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে ভারতের জোরালো প্রতিশ্রুতি আদায় করা৷
ভাল সম্পর্ক কখনোই একপাক্ষিক হতে পারে না, সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত করতে হলে ‘দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'- এই আপ্ত বাক্যের চর্চা ও প্রয়োগ করতে হয়৷ এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়লে চলবে না৷ ভারত যেভাবে নিজেদের জাতীয় স্বার্থ দেখে চলছে, বাংলাদেশকেও সেভাবেই নিজের স্বার্থ বুঝে নিতে হবে৷
কিছুদিন আগে, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে সবচেয়ে মজাদার মন্তব্যটি করেছিলেন বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন৷ এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের একটা বাংলা দৈনিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘‘ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মতো, টুকটাক মতানৈক্য থাকলেও তা মিটে যায়৷''
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই রসালো মন্তব্য সমমর্যাদার স্বামী-স্ত্রীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও হতে পারে, কিন্তু ভারত যদি নিপীড়ক স্বার্থপর স্বামীর ভূমিকায় থাকে আর বাংলাদেশ থাকে নতজানু অনুগত স্ত্রীর ভূমিকায়, তাহলে সেই সম্পর্ক হবে অসম এবং ঠুনকো৷ এতে মতানৈক্য বাড়বে, তিক্ততাও বাড়বে৷
বাংলাদেশের জনমানুষের মনে একটু একটু করে ভারতের কর্তৃত্ববাদি, সুবিধাবাদি বড় ভাই সুলভ যে ইমেজ গড়ে উঠেছে তার পরিবর্তন করতে হলে, ভারতের একক সিদ্ধান্তের ফলে প্রত্যক্ষভাবে গণমানুষ যেসব সমস্যা ভোগ করছে তা দূর করতে হবে৷ হিসাব নিকাষ হতে হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে, সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে, আন্তরিকতার সঙ্গে৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷