বাংলাদেশ: ভুয়া মামলা থেকে মুক্তি মিলবে কবে?
৯ নভেম্বর ২০২৫
ফলে ভুয়া মামলার হয়রানি কবে শেষ হবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছে না৷ আইন বিশেষজ্ঞ এবং মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, মামলা ও অভিযোগ থেকে অব্যহতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও নানা ধরনের কারসাজি রয়েছে৷ আর এর ফলে প্রকৃতই যারা নির্দোষ তারা আদৌ রেহাই পাচ্ছেন কী না সেই প্রশ্ন উঠেছে৷
গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে ছাত্রলীগের ইডেন কলেজ শাখার সভাপতি তামান্না জেসমিন রিভার জামিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আদালতকে জানায়, এখন পর্যন্ত জুলাই আন্দোলনের ভুয়া মামলা থেকে ৩৭২ জনকে অব্যাহতি দিয়েছে পুলিশ৷ আরো ২৫১ জনেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে৷ এনিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন পুলিশের পক্ষ থেকে আদালতে পেশ করা হয়৷ তাদের মধ্যে ১০৯ জনকে অব্যাহতি দেয়ার সুপারিশ আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ৷
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, তারা জুলাই-আগস্টের ভুয়া মামলা এবং দায়ী নয় এমন ব্যক্তিদের মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন আরো পাচ্ছে৷ বর্তমানে আরো ২৩৬টি আবেন তাদের বিবেচনার অপেক্ষায় রয়েছে৷ এর বাইরে ১৬ হাজার ৪২৯টি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা প্রত্যাহার করা হচ্ছে বলে প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে ১৮ আগস্ট এক বিবৃতিতে জানানে হয়৷ তার মধ্যে ১২ হাজার মামলা প্রত্যাহারের জন্য এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্দেশ দিয়েছে৷ তবে এই মামলাগুলো ক্ষমতাচ্যূত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিরোধী রাজনৈতিক নেতা কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা৷
জুলাই-আগস্টের ভুয়া মামলার হয়রানি থেকে ভুক্তভোগীদের রেহাই দিতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭৩ ধারাকে সংযোজিত করে ১৭৩-এর ‘এ' নামে আরেকটি ধারা প্রণয়ন করেছে সরকার৷
এই ধারা অনুযায়ী, যারা নিজেকে নির্দোষ-নিরীহ মনে করেন, তারা সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারের মাধ্যমে নির্দোষ হিসেবে আদালতে প্রতিবেদন পাঠাতে পারেন৷ আদালত সেটি গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন৷ চার্জশিট দেয়ার আগেই মামলার তদন্ত পর্যায়ে দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়া যাবে৷ তবে পরে অপরাধের প্রমাণ পেলে তাদেরকে আবার আইনের আওতায় আনা যাবে৷
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, গত বছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মোট মামলার সংখ্যা এক হাজার ৭৬০টি৷ এরমধ্যে ৮৩৭টি হত্যা মামলা৷ ওই সব মামলার ৫৫টিতে পুলিশ এখন পর্যন্ত চার্জশিট দিতে পেরেছে৷ এর মধ্যে হত্যা মামলা ১৮টি, অন্যান্য মামলা ৩৭টি৷ হত্যা মামলায় এক হাজার ৯৪১ জনের বিরুদ্ধে এবং অন্যান্য ধারায় ৩৭টি মামলায় দুই হাজার ১৮৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হয়েছে৷
অধিকাংশ মামলাই এখন পর্যন্ত তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে৷ ৪৫টি মামলার বিচারকাজ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চলছে৷
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি(মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘প্রতিদিনই এখন মামলা থেকে অব্যাহতি পেতে আবেদন আসছে৷ আর অব্যাহতি পাওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে৷ আমরা চেষ্টা করছি এই প্রক্রিয়াগুলো দ্রুত করতে৷ পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মনিটরিং করা হচ্ছে৷ তবে মামলা থেকে অব্যাহতির সুপারিশের এখতিয়ার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পুলিশ সুপারের এবং মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশ কমিশনারের৷ তারা সুপারিশ করলে, আদালতের মাধ্যমে চার্জশিটের আগেই তদন্ত পর্যায়ে অব্যাহতি দেয়া হচ্ছে, যদি তারা নির্দোষ হন৷''
তার কথা, ‘‘এমনও হয়েছে, মামলার ঘটনার সময় আসামী দেশের বাইরে ছিলেন৷ আবার যখন ঘটনা ঘটেছে, তখন তিনি ওই এলাকায়ই ছিলেন না৷ আবার একই ব্যক্তিকে একাধিক মামলা করেও হয়রানির অভিযোগ রয়েছে৷ ফলে নিরীহদের বাঁচাতেইা নতুন আইন করা হয়েছে৷''
মামলা ও হয়রানির অভিযোগ
ঢাকার উত্তরা এবং বিজয়নগর এলাকায় পত্রিকা বিক্রির ব্যবসা করেন মো. রুস্তুম আলী৷ তারা বিরুদ্ধে জুলাই আগস্টের ঘটনায় তিনটি হত্যাসহ সাতটি মামলা দেয়া হয়েছে৷ তিনি একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে ১০ মাস কারাগারেও ছিলেন৷ তিনি হকার সমিতির নেতা৷
তার অভিযোগ, তার ব্যবসা দখলে নিতেই ৫ আগস্টের পর তার এবং তার সঙ্গে থাকা আরো তিন জনের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘এরমধ্যে গত বছরের জুলাইয়ে ধানমন্ডি এলাকায় মিছিলে এক কিশোর নিহতের একই ঘটনায় দুইটি মামলা হয়েছে৷ কিশোরের বাবা ধানমন্ডি থানায় যে মামলা করেছেন সেখানে কাউকেই তিনি আসামী করেননি৷ কিন্তু পঞ্চগড়ের মাসুম বিল্লাহ নামে আরেক ব্যক্তি ওই একই ঘটনায় হাজারীবাগ থানায় আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন যেখানে আমাকে আসামি করা হয়েছে৷''
তিনি বলেন, ‘‘আসলে একটি চক্র ওই মামলাগুলো করেছে৷ তারা আমাদের ব্যবসা দখল করার জন্য এটি করেছে৷ তারা এরইমধ্যে আমাদের কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছে৷ আর ব্যবসা থেকে এখন প্রতিমাসে দুই লাখ টাকা দিতে হয়৷ তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী৷ আমরা অসহায়৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ প্রত্যাহারেরও আবেদন করেছি৷ কিন্তু কোনো সাড়া মিলছে না৷ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কিছু করার নাই৷''
কুঁড়িগ্রামের সাংবাদিক আব্দুল খালেক ফারুকসহ চারজন সাংবাদিককে দুইটি হত্যা মামলায় আসামী করা হয়েছে৷ তিনি বলেন, ‘‘জুলাই আন্দোলনে কুঁড়িগ্রামে আশিক নামে একজন আহত হন৷ পরে দুই মাস পর ঢাকার একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান৷ আমি ওই নিহতের জানাযায়ও অংশ নিই৷ আশিকের পরিবার কোনো মামলা না করলেও, একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের এক নেতা বাদি হয়ে মামলা করেন৷''
তার কথা, ‘‘ভেবেছিলাম, আমাদের ওই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হবে৷ কিন্তু আমাদের নামে চার্জশিটও দেয়া হয়েছে৷ আমরা আদেনও করেছিলাম৷ কিন্তু কোনো ফল পাইনি৷''
ফরিদপুরের কোটবাড়ি এলাকার জিয়াউল হক বাবলু নামে একজন দোকানদারের বিরুদ্ধে জুলাই হত্যা মামলা হয়েছে ঢাকার আশুলিয়া থানায়৷ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘আমি আমার জীবনে কখনো আশুলিয়া যাইনি৷ আমি এখনো জানিনা ওই মামলা কারা করেছে, কেন করেছে৷ কিন্তু আমাকে আমার বাড়ি থেকে ওই মামলায় আটক ও মারধর করে সাদাপোশাকের লোকজন৷ পরে আমরা মা অর্থের বিনিময়ে আমাকে ছাড়িয়ে আনে৷''
"আমি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি৷ আমাকে আবরো আটকের ভয় দেখাচ্ছে স্থানীয় কিছু লোক৷ গত সরকারের আমলে আবার বাবা ও ভাই ক্রসফায়ারে নিহত হয়৷ আমার কপালে কী আছে, জানি না,'' বলেন তিনি৷
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সিনিয়র সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘জুলাই-আগস্টের ঘটনায় আমরা এরকম আরো অনেক অভিযোগ পাচ্ছি যে, মিথ্যা অভিযোগে মামলা করা হয়েছে৷ আমরা অনেককে আইনগত সহয়তা দিচ্ছি৷ কিন্তু মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়া এক দীর্ঘ প্রক্রিয়া৷ অনেকে আটক হয়েছেন পরে আমরা জামিন করিয়েছি৷ অনেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷''
অব্যহতি দেয়ার প্রক্রিয়া
ঢাকা মহানগর জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী জানান, ‘‘আগের আইন অনুযায়ী, মামলার তদন্ত শেষ হওয়ার আগে কোনো মামলার আসামীকে মামলার অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া যেতো না৷ ফলে, যাদের বিরুদ্ধে ভুয়া মামলা হতো তাদের মামলার চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো৷ কারাগারে থাকতে হতো বা হয়রানির শিকার হতে হতো৷ নতুন আইনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে যে, তিনি যদি কোনো আসামীকে নির্দোষ বলে মনে করেন, তাহলে মামলার তদন্ত চলাকালেই মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে পারেন৷''
এজন্য একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এটা আসামির আবেদেনের ভিত্তিতে হতে পারে৷ আবার তদন্ত কর্মকর্তা নিজেও সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷''
তিনি জানান, ‘‘এজন্য প্রত্যেক জেলায় ও মহানগরে কমিটিও করা হয়েছে৷ কমিটিতে পুলিশ সুপার, তদন্ত কর্মর্তা ও পাবলিক প্রসিকিউটর আছেন৷ তারা আবেদনগুলো দেখেন৷ কিন্তু মূল দায়িত্ব, তদন্ত কর্মকর্তার৷ অব্যাহতির সুপারিশ আদালতে পাঠানো হয়৷''
তার কথা, ‘‘অনেক মামলা, আবেদনও অনেক৷ প্রতিদিনই আবেদন জমা পড়ছে৷ ফলে নিস্পত্তি করতে অনেক সময় লাগবে৷''
আর ১৬ হাজার রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘‘এগুলো প্রত্যাহার করছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়৷ কিন্তু দুইভাবে মামলাগুলো আসছে৷ সরাসরি আইনমন্ত্রণালয় পাঠাচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে৷ আবার জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকেও পাঠানো হচ্ছে৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিচ্ছে৷ আইনে সরকার মামলা প্রত্যাহার করতে পারে আদালতের মাধ্যমে৷ এই মামলা প্রত্যাহারেও জেলায় জেলায় কমিটি আছে৷''
কত সময় লাগতে পারে?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মোট এক হাজার ৭৬০টি মামলার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৫৫টিতে পুলিশ চার্জশিট দিতে পেরেছে৷ যা মোট মামলার তিন শতাংশের কিছু বেশি৷ আর মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে মাত্র ৩৭২ জন৷
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘‘জুলাই আগস্টের ঘটনায় শত শত মামলা হয়েছে৷ আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার৷ যদি প্রথমেই সতর্ক হতো আদালত ও পুলিশ তাহলে এই পরিস্থিতি হতো না৷''
তার কখা, ‘‘এইসব মামলার বড় একটি অংশ হয়েছে অর্থ আদায় এবং রাজনৈকি কারণে৷ কতগুলো চক্র সারাদেশে মামলা করেছে৷ তারা মামলার কমন এজাহার তৈরি করেছে৷ এখানে মামলা প্রস্তুতকারী, দায়েরকারী, অর্থ আদায়কারীরা গ্রুপ, গ্রুপ করে কাজ করেছে৷ মামলা কিন্তু এখনো হচ্ছে৷ কোথাও কোথাও সরকারেরও ভূমিকাও আছে৷ সাংবাদিক মনজুরুল আলম পান্না, অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের মামলা হয়েছে৷ তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ ফলে, বিষয়টি বুঝতে হবে৷''
তার কথা, ‘‘সরকার ১৬ হাজার রাজনৈতিক হয়রানীমূলক মামলার ১২ হাজার এরইমধ্যে প্রত্যাহার করেছে সরকার৷ খুব দ্রুত গতিতে হচ্ছে৷ কারণ ওখানে রাজৗনৈতিক দলগুলোর স্বার্থ আছে৷ কিন্তু জুলাই আগষ্টের মামলা নিয়ে কাজ হচ্ছে খুবই ধীর গতিতে৷ নিরীহরা কবে রেহাই পাবে কেউ জানে না৷ আর এখানেও পুলিশ তার পছন্দ মতো কাজ করছে৷ এখানেও লেনদেনের অভিযোগ আছে৷ আমার কাছে কয়েকজন এসছেন যাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা হলেও তারা রেহাই পাচ্ছেন না৷''
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি(মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বিষয়গুলো একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হচ্ছে৷ আরা যাচাই বাছাইয়ের ব্যাপার আছে৷ আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত করতে৷ তার কথা, ‘‘আমরা যা করছি আইন মেনে নিরপেক্ষভাবে করছি৷''