সোমবার পশ্চিমবঙ্গের নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করেন বাংলাদেশের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মহম্মদ রিয়াজ হামিদুল্লাহ।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠকছবি: Bangladesh High Commission
বিজ্ঞাপন
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব মনোজ পন্থও। তবে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা নিয়ে সাংবাদিকের সামনে কোনো মন্তব্য করতে চাননি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কূটনৈতিক প্রোটোকলের কথা উল্লেখ করে তিনি জানান, এবিষয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করবেন না।
তবে বাংলাদেশ হাই কমিশনের তরফে বৈঠক নিয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে এই বৈঠককে সৌজন্য সাক্ষাৎ হিসেবেই দেখানো হয়েছে। বিবৃতি বলা হয়েছে, 'পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আজ তাঁর কার্যালয়, নবান্ন-এ ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মু. রিয়াজ হামিদুল্লাহ এর কাছে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সাথে বাংলাদেশের জনগণের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক সুদৃঢ় করার দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন।' মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও বাংলাদেশের জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা বার্তা দিয়েছেন বলেও ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। তবে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, পুশ ইন, তিস্তা ইত্যাদি বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, তা নিয়ে ওই বিবৃতিতে কোনো কথা বলা হয়নি।
বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি
চীনের পরই বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করে ভারতের কাছ থেকে৷ ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সেই তুলনায় অনেক কম হলেও চলতি অর্থবছরে তা বাড়ার প্রবণতা দেখা গেছে৷ কিন্তু সাম্প্রতিক টানাপোড়েনে সেই ধারাবাহিকতা কি ধরে রাখা যাবে?
ছবি: Amlan Biswas/Pacific Press/picture alliance
ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ (জুলাই-জুন) অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে ১৫৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে৷ এটি আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় নয় শতাংশ কম৷ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৭১ কোটি ডলার৷ গত বছরের জুলাই থেকে এই বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে ১৫১.৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে৷ আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১৩১.৭ কোটি ডলার৷ ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি ১৫ শতাংশ৷
ছবি: BM Ahmed
বাংলাদেশে ভারতের রপ্তানি
বাংলাদেশ ভারত থেকে যে পরিমাণ রপ্তানি করে, তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি আমদানি করে৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৯০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৯৪৯ কোটি ডলার৷ বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে, এটি তার ১৪ দশমিক তিন শতাংশ৷ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) বাংলাদেশে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১০৬ কোটি ডলার৷
ছবি: BM Ahmed
বাংলাদেশের ১০১২টি, ভারতের ৫৬২০টি
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতির মতো বিশাল ব্যবধান রয়েছে পণ্যের পসরাতেও৷ বাণিজ্যে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের পণ্যের সম্ভার পাঁচগুণ বেশি৷ ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ইন্ডিয়া ব্র্যান্ড ইকুইটি ফাউন্ডেশন’ জানাচ্ছে ভারত বাংলাদেশ থেকে ২০২৪ অর্থবছরে ১০১২ ধরনের পণ্য আমদানি করেছে৷ অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারত রপ্তানি করেছে ৫ হাজার ৬২০ রকমের পণ্য৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাংলাদেশের পোশাক, ভারতের তুলা
বাংলাদেশের প্রধাণ রপ্তানিপণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, মাছ, হোম টেক্সটাইল, পাট ও পাটজাত পণ্য, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য৷ তবে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৪ কোটি ডলার৷ ভারত থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে তুলা৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তুলা আমদানির পরিমাণ ছিল ২৩৬.৮ কোটি ডলার, যা মোট আমদানির এক চতুর্থাংশ৷ এছাড়াও আছে খনিজ, পশুখাদ্য, পরমাণু রিয়্যাক্টর, বয়লার ও মেশিনারি, সবজি ইত্যাদিও৷
ছবি: Faisal Ahmed/DW
অভ্যুত্থানের পরের চিত্র
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের পরে দুই দেশের বাণিজ্য তেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি৷ গত বছরের আগস্ট থেকে এ বছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে ভারত বাংলাদেশে ৬৮২ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের একই সময়ে ছিল ৬৬৯ কোটি ডলার৷ অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে গত আগস্ট-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানির পরিমাণ ছিল ১২২ কোটি ডলার, যা আগের একই সময়ে ছিল ১০৫ কোটি ডলার৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দুই দেশের ট্রানজিট সুবিধা
দুই দেশের চুক্তি অনুযায়ী, এক দেশ আরেক দেশের মধ্য দিয়ে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা পাবে৷৷ ২০১৬ সালে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ভারতকে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে অনুমতি দেয়া হয়৷ ২০২০ সালে ভারতের সমুদ্র এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাংলাদেশকে বাণিজ্যের সুবিধা দেয় দিল্লি৷
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images
তৃতীয় দেশের সুবিধা বাতিল ভারতের
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল ভারত৷ বলা হয়েছিল, ভারতের সমুদ্র এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে বাংলাদেশ৷ গত ৮ এপ্রিল সেই সুযোগ বাতিল করে ভারত৷ তবে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে৷
ছবি: Satyajit Shaw/DW
দুই দেশের পাল্টাপাল্টি
দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ চারটি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি বন্ধের সিদ্ধান্ত জানায়৷ এরপর ভারত বাংলাদেশি গার্মেন্টস পণ্যের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করে৷ ১৭ মে ভারত স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ থেকে পোশাক, কৃষি-প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, আসবাবপত্র এবং অন্যান্য পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে৷ তবে বাংলাদেশ এই বিষয়ে পাল্টা কোনো পদক্ষেপ নেবে না বলে জানিয়েছে৷
ছবি: Amlan Biswas/Pacific Press/picture alliance
8 ছবি1 | 8
এদিন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারতের প্রাক্তন আমলা তথা রাজ্যসভার প্রাক্তন সাংসদ জহর সরকারের সঙ্গেও সৌজন্য বৈঠক করেছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত। ডয়চে ভেলেকে জহর সরকার জানিয়েছেন, ''মূলত সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। আমরা পূর্বপরিচিত। এমন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করিনি, যা উভয়পক্ষকে বিব্রত করতে পারে।''
জহর জানিয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের এই সাক্ষাৎ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তার মতে, ''পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অঙ্গরাজ্য হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই রাজ্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্ত আছে। এবং দুই অঞ্চলের মানুষই বাঙালি।'' জহর জানিয়েছেন, গত অগাস্ট মাসের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের সম্পর্কের উন্নতিতে পশ্চিমবঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। মনে করা হচ্ছে, আগামী কিছু মাসের মধ্যে বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর বাংলাদেশে স্থায়ী সরকার গঠিত হলে তার প্রভাব ভারতের তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতেও পড়বে।
জহরের মতে, ''আমরা এখনো জানি না সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশি কী চান? আমার মতে, বাংলাদেশের মানুষ মধ্যপন্থি সরকারের পক্ষে থাকবে। তা যদি হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে।'' বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলির সরাসরি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের উপর পড়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে চোখে পড়ে। এই সমস্ত কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মু. রিয়াজ হামিদুল্লাহের বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেন জহর সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক অভ্র ঘোষ মনে করেন, ''কোনো দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রমী। এখানে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব অনেকটা। ফলে এদিন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বৈঠক কূটনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।'' অভ্র ঘোষ মনে করেন, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে রাষ্ট্রদূতের বৈঠক যে কেবলমাত্র সৌজন্যমূলক ছিল না, তা মমতার বক্তব্যেই স্পষ্ট। কেবলমাত্র সৌজন্য বৈঠক হলে মুখ্যমন্ত্রী 'কূটনৈতিক প্রোটোকলে'র কথা বলতেন না।