বাংলাদেশ হাসপাতালের কমান্ডিং অফিসার ডা. সিতারা
৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২আগরতলায় যাওয়ার পথে বালাটে গিয়ে কয়েকদিনের জন্য আটকা পড়েন বীরপ্রতীক ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা৷ বালাটে থানায় সবার নাম তালিকাভুক্ত করার পর সেখানে তিন চারদিন অপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রাকে করে রওয়ানা দেন৷ এসময়ের ঘটনা স্মরণ করে ডা. সিতারা বলেন, ‘‘আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বহনকারী তিন-চারটি ট্রাকে করে প্রায় সারাদিন পথ চললাম৷ শিলঙ পৌঁছে সিলেটের এক ভদ্রলোকের বাসায় উঠি৷ সেখানে কয়েকদিন অপেক্ষা করে আমরা আসানসোল বিমানবন্দরে গেলাম৷ কিন্তু সেদিন আর কোন বিমান নেই৷ ফলে সেখান থেকে একদিন পর বিমানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়৷ কিন্তু আমার কাছে থাকা পিস্তল নিয়ে বিপত্তি বাধে৷ পিস্তল সাথে নিয়ে তো আমাকে বিমানে যাত্রা করতে দেবে না৷ ভাইয়া ইতিমধ্যে অবশ্য ভারতীয় এক ব্রিগেডিয়ারের কাছ থেকে একটা চিরকুট লিখে নিয়ে এসেছিলেন৷ সেটাতে লেখা ছিল যে, ‘তাদের অভিযান গোপনীয়৷ তাই এ ব্যাপারে তাদের কোন জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে না৷' এ চিরকুট দেখার পর কাস্টমস এর লোকজন কিছুটা নরম হলো৷ কিন্তু বিমানে ওঠার আগে আমার কাছ থেকে পিস্তলটা নিয়ে নিল এবং বলল যে, এটা বৈমানিকের কাছে থাকবে৷ বিমান থেকে নামার সময় সেটা আমি নিতে পারবো৷ সেভাবেই আমরা যাত্রা করতে রাজি হলাম৷ এরপর আমরা আগরতলা গিয়ে পৌঁছলাম৷ সেখানে পৌঁছে দুই নম্বর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সাথে সাক্ষাৎ হলো৷ তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বিশ্রামগঞ্জে স্থাপিত হাসপাতালের বিভিন্ন বিষয় আমাকে জানালেন৷''
বিশ্রামগঞ্জে স্থাপিত বাংলাদেশ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা শুরু করেন ডা. সিতারা রহমান৷ তাঁর সাথে যোগ দেন আরো বেশ কিছু সাহসী নারী৷ তবে বিজয় পর্যন্ত বাংলাদেশ হাসপাতালের সবকিছু দেখাশোনা ও পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ডা. সিতারার উপর৷ এসময়ের কাজের কথা বলতে গিয়ে ডা. সিতারা বলেন, ‘‘কিছুদিন পরই সেখানে পরিদর্শনে আসেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী৷ তিনি এসে আমার সাথে করমর্দন করে বললেন, হ্যালো, ক্যাপ্টেন সিতারা৷ কেমন আছেন? সেই থেকে আমি ক্যাপ্টেন হয়ে গেলাম৷ যাহোক, ৪০০ বিছানার হাসপাতাল গড়ে তোলা হয়েছিল৷ সেখানে ডা. জাফরুল্লাহ এবং ডা. মুবিন ছিলেন৷ এখন সাভারে যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র রয়েছে সেটা বাংলাদেশ হাসপাতালেরই অংশবিশেষ৷ আমরা সেই হাসপাতালের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে বহু সাহায্য পেয়েছি৷ আমার মনে আছে, আমি বহুবার আগরতলা গিয়েছি চিকিৎসকদের জন্য সরবরাহকৃত নমুনা ওষুধ সংগ্রহ করতে৷ ওষুধের দোকানগুলোতে ঘুরে ঘুরে ফিজিশিয়ান স্যাম্পল থাকলে সেগুলো নিয়ে আসতাম৷ তারপর হাসপাতালে যেতাম৷ হাসপাতাল থেকে কিছু অনুদান পেতাম৷ ডা. রায় চৌধুরী ছিলেন৷ তিনি আমাদের বেশ অনুদান দিয়েছেন৷''
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়৷ তবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেখানে ফেলে দেশে ছুটে আসেননি ডা. সিতারা৷ ডিসেম্বরের পরে তিনি দেশে ফিরেন৷ সেসময়ও চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ জন রোগী ছিলেন৷ তাদেরকেও কুমিল্লা নিয়ে আসা হয়৷ কুমিল্লা কলেজের ছাত্রীনিবাসে কয়েকদিন ছিলেন তাঁরা৷ এরপর ধীরে ধীরে ঢাকায় ইস্কাটনে স্থানান্তর করা হয় সবাইকে৷ কিন্তু এসময় রোগীদের ঢাকায় না এনে বরং লাখনৌ পাঠানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছিল৷ ডা. সিতারা তার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন৷ এ সম্পর্কে তিনি জানান, ‘‘আমরা কতো কষ্ট করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের কুমিল্লা নিয়ে আসলাম৷ আর সেখানে শুনি ভারতের লাখনৌতে তাদের পাঠানো হবে৷ আমি সকালে রোগীদের যখন দেখতে গিয়েছি, তখন সবাই চিৎকার আর কান্নাকাটি করে আমাকে জানালো যে, আমরা লখনৌ যেতে চাই না৷ আমাদের স্বাধীন দেশে আমরা থাকতে চাই৷ তখন আমি কুমিল্লা সেনানিবাসের কর্মকর্তাদের সাথে বেশ ঝগড়া করেই রোগীদের লাখনৌ পাঠানোর পরিকল্পনা পাল্টাতে বাধ্য করি৷''
স্বাধীন বাংলাদেশে আবারো সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন ডা. সিতারা রহমান৷ ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল ছিল তাঁর কর্মস্থল৷ এসময় সেনা কর্মকর্তা এবং মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবিদুর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন সিতারা৷ ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর বড়ভাই মেজর এ টি এম হায়দার বীরউত্তম নিহত হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে যান ক্যাপ্টেন ডা. সিতারা রহমান৷
প্রতিবেদন: হোসাইন আব্দুল হাই
সম্পাদনা: আব্দুল্লাহ আল-ফারূক