বছরের শেষে একই সঙ্গে দেখতে হয় চলে যাওয়া বছরের সালতামামি আর নতুন বছরের আগমনি ‘লং শট'৷ প্রথমটি হয় পর্যবেক্ষণের অনুসন্ধিত্সু চোখে; দ্বিতীয়টি স্বপ্নময় প্রত্যাশায়৷ বিগত দিনের কর্মমুখরতায় নতুনের কর্মস্পৃহা নির্মিত হয়৷
বিজ্ঞাপন
এটা কেবল দার্শনিক সত্যই নয়, এটাই জীবনের ভাষ্য৷ তাই ২০১৬ সালের আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ আসলে রাতারাতি পাল্টে যাওয়া কোনো বাংলাদেশ নয়; বরং ২০১৫ সালের পদযাত্রা, এগিয়ে যাওয়া, হোঁচট খাওয়া, ভুল, শুদ্ধ – এ সব কিছু থেকে শিক্ষা ও প্রেরণা লাভের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করা একটি বাংলাদেশ-ই আমাদের চিরকাঙ্খিত৷
এক.
পুরনো বছরের বিদায় আর নতুন বছরের আগমনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রত্যাশার বাতিঘর যেমন শেকড়স্পর্শী হলেও আকাশমুখি, তেমনি কর্ম আর সংগ্রামের সমন্বয়ে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক দার্ঢ্য লেখচিত্র৷ কেননা নতুন বছরের প্রত্যাশার বাংলাদেশটি কেবল কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয়, এর জন্য প্রয়োজন নিজেদের পূর্নোদ্যম কর্মস্পৃহা, আরও বেশি সচেতনতা আর সেই সঙ্গে ইস্পাতসম দৃঢ় শপথ, যার ভেতরে থাকবে আমাদের কর্ম-পরিকল্পনার সঙ্গে প্রত্যাশার মণিকাঞ্চন৷ আর এ আলোচনা কেবল সমষ্টিগতভাবেই নয়, এর গাঢ়তম অংশে ওতোপ্রতোভাবে থাকতে হবে ব্যক্তির নিজস্ব আত্ম-সমালোচনাও৷ কেননা রাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত মানুষেরই জন্যে এবং মানুষই নির্ধারণ করে রাষ্ট্রের গতিপথ৷ ২০১৫ সালের পুনর্পাঠ করলে আমরা দেখতে পাই, ব্যক্তিরও স্খলন ঘটেছে নানা ক্ষেত্রে, অবনমন ঘটেছে ব্যক্তির মানসিকতার আর তার সামগ্রিক ছাপ পড়েছে রাষ্ট্রের নানা ক্ষেত্রে৷ আবার এ-ও সত্যি, মানুষই উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষের জন্য, মানুষই শুনিয়েছে শুভবুদ্ধির জয়গান৷ ২০১৬ সালের বাংলাদেশ সে-ই শুভবুদ্ধির পথ ধরেই এগিয়ে যাবে, কিন্তু তার জন্যে প্রয়োজন মানুষের আন্তরিক উদ্বোধন, অপরাজেয় পদক্ষেপ৷ আমাদের সকলের স্বপ্নগুলোর মহীরূহই নির্মাণ করবে আমাদের কাজের সমীকরণ, আর তা-ই হবে আমাদের প্রত্যাশার ২০১৬ সালের বাংলাদেশ৷
‘‘আল্লাহ’র নামে আর কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
বাংলাদেশে মুক্তমনাদের উপর হামলা নিয়ে বার্লিনে মানববন্ধনে প্রদর্শন করা প্ল্যাকার্ডের ছিল বিশেষ কিছু বার্তা৷ চলুন সেগুলো দেখে নেয়া যাক৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতাকে ‘না’ বলুন’’
বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার কারণে প্রাণ হারাচ্ছে অসংখ্য মানুষ৷ তাই এই বার্তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷ আরেকটি প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসকে আপনার মুখ বন্ধ করতে দেবেন না৷’’
ছবি: DW/A. Islam
‘‘আল্লাহ’র নামে কোনো হত্যাকাণ্ড নয়’’
এই বার্তাটাও পরিষ্কার৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ধর্মীয় মৌলবাদীদের হামলার শিকার আহমেদুর রশীদ চৌধুরী (টুটুল) বলেছিলেন, ‘‘আল্লাহু আকবর’’ বলে তাঁকে কোপানো হয়েছিল৷ বার্লিনে মানববন্ধনে আরেকটি প্ল্যাকার্ডে আল্লাহ’র জায়গায় সৃষ্টিকর্তার কথা উল্লেখ করা হয়৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধ কর’’
ধর্মভিত্তিক সহিংসতা বন্ধের দাবি জানান মানববন্ধনে অংশ নেয়া এক প্রবাসী বাঙালি৷ ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরও বিপক্ষে অবস্থান তাঁর৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘ধর্মীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরব হোন’’
ধর্মের নামে যারা সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছেন তাদের বিরুদ্দে সরব হওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে এই প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাচ্ছে৷
ছবি: DW/A. Islam
বাংলা প্ল্যাকার্ড
বাংলা ভাষায় লেখা প্ল্যাকার্ডও প্রদর্শন করা হয়েছে মানববন্ধনে৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘নাস্তিকতার জন্য মৃত্যু নয়’’
নাস্তিকতা কারো মৃত্যু বা কারাভোগের কারণ হতে পারে না, এমন প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়েছেন একাধিক ব্যক্তি৷ মানবন্ধনে অংশ নেয়াদের সবাই নাস্তিক নন, তবে তাঁরা বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী৷
ছবি: DW/A. Islam
‘‘শব্দ হত্যা করে না, মানুষ করে’’
গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার, লেখক অভিজিৎ রায়ের ছবির সঙ্গে এই বাক্যটি লেখা প্ল্যাকার্ডও ছিল বার্লিনের ব্রান্ডেনবুর্গ গেটের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে৷ চলতি বছর বাংলাদেশে খুন হয়েছেন চারজন ব্লগার এবং একজন প্রকাশক৷
ছবি: DW/A. Islam
7 ছবি1 | 7
২০১৫ সাল নানা কারণেই ঘটনাবহুল৷ এ বছরের শুরু থেকে শেষ অবধি একদিকে যেমন আমরা নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছি, তেমনি উত্তরণও ঘটেছে অনেকক্ষেত্রেই৷ আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণি-চরিত্রের বেশ কয়েকটি দিকের উন্মোচন যেমন ঘটেছে, তেমনি অনাদরে মাটিচাপা পড়েছে অনেক সম্ভাবনার শ্বেতকমল৷ তাই খুব সরল সমীকরণে ২০১৫-কে বিশ্লেষণ করার সুযোগ নেই৷ সারা বছর জুড়েই নানা ঘাত-প্রতিঘাত আর বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে বাংলাদেশকে৷ পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মানুষ হত্যা করে দিনের পর দিন অবরোধ ডেকে দেশকে পঙ্গু করার হীন ষড়যন্ত্রে দেশদ্রোহীরা সমগ্র বাংলাদেশকে বানাতে চেয়েছিল একটি ‘বার্ন ইউনিট', পিটিয়ে হত্যা করা শিশুর নিষ্পাপ নিথর শরীর দিকভ্রান্তের মতো খুঁজেছে ‘মানবতা' শব্দটির অর্থ, মুক্তচিন্তার মানুষকে পুরো বছর জুড়েই চাপাতির হিংস্রতার সামনে দাঁড়িয়ে বলে যেতে হয়েছে ‘কলম চলবেই', মৌলবাদী শ্বাপদের কালো থাবায় নিহত সন্তানের মরদেহের সামনে দাঁড়িয়ে পিতাকে বলতে হয়েছে ‘শুভবুদ্ধির উদয় হোক'৷ এরই মাঝে দগ্ধ মৃত্তিকায় ফোটা ফুলের মতো লাল-সবুজের পতাকার জয় হয়েছে ক্রিকেটের মাঠে, মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ উঠে এসে দাঁড়িয়েছে আরও এক ধাপ, রায় কার্যকর হয়েছে দু'জন কুখ্যাত ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীর, সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনায় এসেছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা (কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত বক্তব্যের কারণে যা দু'বছর আগেই গণজাগরণ মঞ্চ দাবি করেছিল এবং স্মারকলিপি আকারে পেশ করেছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবর), জঙ্গিবাদ দমনে নানামুখি সফল অভিযান চালিয়েছে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী৷ সুতরাং উত্থান এবং পতন – দুয়ের বিচারেই দণ্ডটি মাঝামাঝি রয়ে গিয়েছিল; ২০১৬ সালে সে-ই দণ্ডটি যেনো উত্থানের দিকেই হেলে থাকে, সে-ই প্রত্যাশাই থাকব আমাদের সকলের৷ ন্যায়ের পবিত্র আলোতে অন্যায়ের কালোরাত্রি কেটে যাবে, ২০১৬ সালের বাংলাদেশের ভোর হবে সে-ই আলোরই সার্থক প্রতীক – এই প্রত্যাশা সকল সময়ের জন্য; এ প্রত্যাশা আজন্ম৷
সহিংসতায় প্রধান হাতিয়ার ‘পেট্রোল বোমা’
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতার সময় পেট্রোল বোমার ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে৷ হাতে তৈরি এই বোমা ব্যবহার করে গাড়িতে আগুন দেয়ার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
পেট্রোল বোমায় পুড়ছে জীবন
বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ শতাধিক মানুষ৷ নির্বাচনসংক্রান্ত জটিলতা ছাড়াও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে এসময়৷ হরতাল, অবরোধ চলাকালে ব্যাপক আকারে ব্যবহার হয়েছে পেট্রোল বোমা৷
ছবি: imago/imagebroker/theissen
যেভাবে তৈরি হয় এই বোমা
কাঁচের বোতল, পেট্রোল আর কিছু ভাঙা কাঁচ বা মার্বেলের টুকরা ব্যবহার করে পেট্রোল বোমা তৈরি করছে দুর্বৃত্তরা৷ এরপর সুযোগ বুঝে সেগুলো নিক্ষেপ করছে যাত্রীবাহী গাড়িতে৷ ফলে গাড়ি পুড়ছে, সঙ্গে পুড়ছে মানুষ৷ সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতার আগুনে পুড়ে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture alliance/abaca
রয়েছে অন্য বোমাও
তবে শুধু পেট্রোল বোমাই নয়, লাল বা কালো টেপে মোড়া ককটেলও ব্যবহার হচ্ছে বাংলাদেশে৷ ককটেল তৈরিতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ এবং ছোট পেরেক বা লোহার টুকরা৷ এছাড়া বোমা তৈরিতে গান পাউডারও ব্যবহার করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বোমা বাণিজ্য
রাজনৈতিক অস্থিরতায় সময় হাতে তৈরি বোমার চাহিদা বেড়ে যায়৷ তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা ছাড়াও পেশাদারি গ্রুপও বোমা তৈরি করে৷ চড়া দামে এসব বোমা বিক্রিও করা হয়৷ গত বছর পাওয়া হিসেব অনুযায়ী, একেকটি হাত বোমার দাম ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত৷
ছবি: Reuters
বড় পর্যায়ে বোমা হামলা
বলাবাহুল্য, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে আত্মঘাতী বা বড় পর্যায়ে বোমা হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি৷ তবে ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল৷
ছবি: dpa - Bildfunk
আত্মঘাতী হামলা
১৭ আগস্টের সেই সিরিজ হামলার পর কয়েকটি আত্মঘাতী বোমা হামলার ঘটনাও ঘটে৷ দৈনিক জনকণ্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেসময় ‘‘বোমা হামলায় বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত হন৷’’ তবে নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর হাতে জঙ্গিবাদের উত্থান দমনে সক্ষম হয়৷ ২০০৭ সালে জেএমবির কয়েকজন শীর্ষ নেতার ফাঁসি কার্যকর হয়৷
ছবি: AP
বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম
ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি হারুন উর রশীদ স্বপন জানান, বাংলাদেশ পুলিশের শক্তিশালী বোমা নিষ্ক্রিয়করণ টিম রয়েছে৷ তাদের কাছে আধুনিক সরঞ্জামও রয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ের বোমা নিষ্ক্রিয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছে পুলিশের এই টিম৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
7 ছবি1 | 7
প্রথমেই এটুকু পরিষ্কার করে নেয়া দরকার যে, ‘প্রত্যাশার বাংলাদেশ' কেবল একটি বায়বীয় শব্দবন্ধই নয়; এর সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের নানা দিকের নানা অলঙ্কার৷ একটি মানচিত্র যখন রাষ্ট্র হয়ে উঠে তখন তার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক হয় রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যগুলো আর সে-ই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রত্যাশিত অগ্রযাত্রাই আসলে রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা৷ ২০১৬ সালের প্রত্যাশার বাংলাদেশ তাই, বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত নানা পরিমাপকের জন্যে প্রত্যাশা, যা অবশ্যই আকাশ-কুসুম নয়; বরং কর্মস্পৃহার আলোতে বাস্তব৷ প্রশ্ন উঠতেই পারে, রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা কী করে সেই গুরুত্বপূর্ণ পরিমাপকগুলোকে আমাদের প্রত্যাশার পথে চালনা করতে পারি৷ এ কথা ভুলে গেলে চলবে না, বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস৷ সুতরাং এ দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি – সকল ক্ষেত্রেই গণ-মানুষের প্রত্যক্ষ ও ইতিবাচক অংশগ্রহণই পারে আমাদের প্রত্যাশার পথে বাংলাদেশকে বিনির্মাণ করতে৷ জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতেই রাষ্ট্রের সামগ্রিক বিষয় নির্ধারিত হবার কথা, রাষ্ট্রের চরিত্র নির্ধারিত হবার কথা; কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্যি, ২০১৫ সাল পর্যন্ত তার খুব কম প্রতিফলনই আমরা দেখেছি৷ বরং নানাক্ষেত্রে উপেক্ষিত হয়েছেন জনগণ, তাঁদের অধিকারগুলো চলে গেছে নানা কায়েমি স্বার্থবাদীদের হাতে; ফলে রাষ্ট্র তার সকল নিয়ামকে ছোটো হতে হতে আপাদমস্তক কিছু দানবীয় ছায়ামূর্তির মুঠোর মধ্যে চলে গেছে৷ মানুষের চেয়ে বড় কিছু নেই, মানুষের কল্যাণের জন্যে রাষ্ট্রের চেয়ে বড় কোনো প্রতিষ্ঠান নেই – এই বোধের অন্তর্ধান যেদিন হয়েছে, সেদিনই চোরাবালিতে আটকে গেছে বাংলাদেশ৷ ২০১৬ সালের বাংলাদেশ হোক মানুষের বাংলাদেশ, কেবল কিছু ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান বা দলের নয় – এ সত্যটুকুই হোক ২০১৬ সালের বাংলাদেশের আপ্তবাক্য৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
দুই.
২০১৫ সালের শুরু থেকেই বাংলাদেশ প্রবেশ করেছিল এক ভয়াল মেঘমালার নীচে৷ বিএনপি-জামাত জোট সরকারের টানা অবরোধ আর মানুষ পোড়ানোর অপ-রাজনীতির কুৎসিত শিকলে আটকে পড়েছিল দেশ৷ বছরের শেষে এসে এর জবাব পেয়েছে বিএনপি-জামাত পৌরসভার নির্বাচনে৷ মানুষ পুড়িয়ে মানুষের কাছে ভোট চাওয়া বা পাওয়া যায় না – এর বড়ো প্রমাণ দিয়েছে বাংলাদেশের জনগণ৷ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বিএনপি-জামাতের অপ-রাজনীতিকরা৷ কেবল মানুষ পোড়ানোই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অতীতের মতোই জঘন্যভাবে বিকৃত করেছে এই ‘নেমেসিস'-এর দল৷ অথচ মুক্তিযুদ্ধই হবার কথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির মূলভিত্তি৷ গণজাগরণ মঞ্চ তার আন্দোলনের সূচনা পর্ব থেকেই বলে আসছে – বাংলাদেশের রাজনীতি হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনীতি৷ এখানে সরকারি বা বিরোধি দল – সকলকেই বিশ্বাস করতে হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মৌল চেতনায়৷ সে লক্ষ্যেই এখনও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি আমরা৷ ২০১৬ সালের বাংলাদেশে প্রত্যাশার সবচেয়ে বড় অংশটি জুড়ে থাকবে জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ৷ কারণ, এই দেশদ্রোহী ও যুদ্ধাপরাধের দল কোনোভাবেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার পেতে পারে না৷ ইতোমধ্যে প্রকাশিত নানা রায়ের ‘অবজারভেশন'-এ জামায়াতে ইসলাম এবং তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্র সংঘকে (বর্তমান ছাত্র শিবির) যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছে৷ সুতরাং রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় প্রত্যাশার ক্যানভাস হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাপ্রসূত রাজনীতি৷ একমাত্র এই রাজনীতির হাত ধরেই বাংলাদেশ প্রবেশ করতে পারে পূর্ণ আলোর পথে, যে আলোতে মুক্তি বাংলাদেশের আকাশে৷ রাজনীতির ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় হলো, রাজনৈতিক নেতাদের রাজনৈতিক যোগ্যতা৷ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির পথকে রুদ্ধ করে রাখা হয়েছে ছাত্র সংসদের নির্বাচন বন্ধ করে দিয়ে৷ এই পরিকল্পিত রাজনৈতিক আগ্রাসনটির সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িয়ে আছে৷ ছাত্র সংসদগুলো অকার্যকর থাকায় একদিকে যেমন সাধারণ ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ কমে যাচ্ছে, তেমনি জাতীয় রাজনীতি একটি বড়ো নেতৃত্ব শূন্যতার দিকে যাচ্ছে৷ এখনও বাংলাদেশে যে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদগণ রয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই ছাত্র রাজনীতির মধ্য দিয়ে নিজেদের শাণিত করেছেন জাতীয় রাজনীতির জন্য৷ এই নেতৃত্ব শূন্যতার সুযোগ নিচ্ছেন অন্যান্য নানা গোষ্ঠী, যাদের কাছে রাজনীতি মানেই নিজস্ব সুবিধা আর ভোগের ব্যাকরণ৷ ফলে প্রতারিত হচ্ছেন জনগণ, মুখ থুবড়ে পড়ছে রাজনীতির মূল তত্ত্ব৷ অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ না থাকায় ছাত্রনেতারা পরিণত হচ্ছেন দলীয় তল্পিবাহকে৷ অছাত্ররা নানাভাবে সুযোগ করে নিচ্ছে; সুযোগ নিচ্ছে তৃতীয়, চতু্র্থ নানা পক্ষ৷ ছাত্ররাজনীতির নামে একটি বড়ো অংশ যোগ দিচ্ছে টেন্ডারবাজিতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে তারা কোনো কথাই বলছে না৷ এই প্রক্রিয়াটি গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংসের অন্যতম প্রধান নিয়ামক৷ রাজনীতির ক্ষেত্রে ত্যাগ-সংগ্রাম-আন্দোলনের ইতিহাস যতটা গুরুত্বপূর্ণ হবার কথা, তার চেয়েও গুরুত্ব পাচ্ছে পেশী শক্তি, অস্ত্রের মহড়া, দলীয় লেজুড়বৃত্তি ইত্যাদি৷
অভিজিৎ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ, বিচারের দাবি
বইমেলা থেকে ২৬শে ফেব্রুয়ারি রাতে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত হন ব্লগার অভিজিৎ রায়৷ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিতকে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়৷
ছবি: DW
যেখানে হামলার শিকার অভিজিৎ, বন্যা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার ফুটপাথ৷ লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়ের নিহত হবার এই জায়গাটা নিরাপত্তা বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রেখেছে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ হামলায় তাঁর স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যাও গুরুতর আহত হন৷
ছবি: DW
বেঁচে গেছেন বন্যা
হামলার পর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা৷ দুষ্কৃতিকারীরা তাঁকে কুপিয়ে জখম করলেও প্রাণে বেঁচে যান অ্যামেরিকায় বসবাসকারী এই ব্লগার৷ বর্তমানে স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি৷
ছবি: DW
নির্বাক অজয় রায়
ছেলের মৃত্যুর খবরে নির্বাক নিহত অভিজিৎ রায়ের বাবা অজয় রায়৷ আজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন৷
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আদায়ের জন্য বিরোধীদলের কর্মসূচিতে পুড়ছে যানবাহন, ধ্বংস হচ্ছে সম্পদ, মরছে মানুষ৷ হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো অনেকে এখনো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
সারি সারি পোড়া মানুষ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট এখন হরতাল-অবরোধের নামে পোড়ানো জীবিকার তাগিদ কিংবা দৈনন্দিন প্রয়োজনে রাস্তায় নামা মানুষে ভরে গেছে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
শিশুর কষ্ট বোঝেনা তারা!
কোলের শিশুও বাঁচতে পারছেন না জ্বালাও-পোড়াওয়ে হাত থেকে৷ প্রতিপক্ষের আদর্শকে ভুল প্রমাণ করে শ্রেয়তর আদর্শ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা নয়, প্রতিপক্ষকে আঘাত করে, হত্যা করে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা অনেক দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ স্বাধীন দেশে নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে পোড়ানোও দেখতে হচ্ছে৷ ৩ নভেম্বর আট বছরের সুমি দাদীর সঙ্গে নেত্রকোনা থেকে ঢাকা আসছিল৷ জয়দেবপুর চৌরাস্তায় তাদের বাসটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বোবা কান্না...
নির্মমতার আরেকটি ছবি হয়ে আছে মজিবরের পোড়া শরীর৷ মজিবর বাকপ্রতিবন্ধী৷ কুমিল্লার দেবিদ্বারের এক ট্রাকের হেলপার৷ পিকেটারদের বোমা হামলায় বাসের সঙ্গে তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ সবাই শুনে বুঝবে এমনভাবে কথা তিনি বলতে পারেন না, বোবা কান্নায় শুধু পারেন অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে, আর্তনাদ করতে আর এ অন্যায়ের প্রতিকার আশা করতে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
মেয়েকে দেখতে গিয়ে মা হাসপাতালে
জাহানারা বেগম৷ বয়স ৫২৷ পেশা – ফেরি করে কাপড় বিক্রি করা৷ হরতাল-অবরোধ থাকলে বিক্রি কমে যায় বলেই হয়তো সেদিন কাপড় নিয়ে বাড়ি বাড়ি না ঘুরে জাহানারা গিয়েছিলেন শ্যামপুরে৷ সেখানে তাঁর মেয়ের বাড়ি৷ মেয়েকে দেখে অটো রিক্সায় ফেরার সময়েই বিপদ৷ বিরোধী দলের কিছু সমর্থক সেই অটোরিক্সাতেও ছুড়ে মারে পেট্রোল বোমা৷ সন্তানের প্রতি অপত্য স্নেহের মূল্য আগুনে পুড়ে চুকাচ্ছেন জাহানারা বেগম!
ছবি: Mustafiz Mamun
তালহার অসহায়ত্ব
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর শাহবাগে বাসে পেট্রোল বোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা৷ শরীরের ৩০ শতাংশ পুড়ে যাওয়ায় আবু তালহা সেই থেকে ১ নম্বর বার্ন ইউনিটে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
রাজমিস্ত্রী
রাজমিস্ত্রী ও ঠিকাদার আবুল কালাম আজাদের শরীর পুড়েছে গত ১২ নভেম্বর৷ সেদিন ঢাকার রায়েরবাগেও একটি চলন্ত বাসে ছোড়া হয় পেট্রোল বোমা৷ সেই থেকে তাঁরও ঠিকানা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১ নম্বর বার্ন ইউনিট৷
ছবি: Mustafiz Mamun
বাসচালক
২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শাহবাগে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো সেই বাসটি চালাচ্ছিলেন মাহবুব৷ যাত্রীদের মতো তাঁর শরীরও পুড়েছে৷ তাঁর দেয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যু্দ্ধের সময়, অর্থাৎ ১৯৭১ সালেই জন্ম মাহবুবের৷ স্বাধীনতার ৪২ বছর পর দেশ পুড়ছে, তিনিও পুড়েছেন৷
ছবি: Mustafiz Mamun
ঘুমের মাঝেই আগুন...
৭ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ জেলার মাওয়া ফেরিঘাটে বাসে ঘুমাচ্ছিলেন হেলপার আলমগীর৷ থামানো বাসেই দেয়া হয় আগুন৷ পোড়া দেহ নিয়ে এখন তিনি হাসপাতালে৷
ছবি: Mustafiz Mamun
লেগুনার যাত্রী
১০ নভেম্বর ঢাকার লক্ষীবাজারে পেট্রোল বোমা ছুড়ে পোড়ানো হয় একটি লেগুনা৷ লেগুনা পুড়ে শেষ, লেগুনার যাত্রী কামাল হোসেন ভাগ্যগুণে বেঁচে গেছেন৷ তবে শরীরের ৩৫ ভাগেরও বেশি অংশ পুড়ে গেছে৷ ৩৬ বছরের এ তরুণ লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে৷ চিকিৎসকদের চেষ্টা এবং সুস্থ মানসিকতার প্রতিটি মানুষের শুভকামনায় তিনি শিগগিরই হয়তো ফিরবেন স্বাভাবিক জীবনে৷ কিন্তু এই দুর্ভোগ, এই দুঃস্বপ্নের দিনগুলো কি কোনোদিন ভুলতে পারবেন?
ছবি: Mustafiz Mamun
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুভও ছিলেন রায়েরবাগের সেই বাসে৷ তাই ১২ নভেম্বর থেকে তিনিও পোড়া শরীর নিয়ে পড়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের বিছানায়৷
ছবি: Mustafiz Mamun
10 ছবি1 | 10
সুতরাং এখন সময় এসেছে জাতীয় রাজনীতির স্বার্থেই ছাত্র রাজনীতিকে ঋদ্ধ করার৷ ২০১৬ সালের বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে একটি বড়ো প্রত্যাশার জায়গা থাকবে ছাত্র সংসদগুলোকে পুনরায় কার্যকর করার উদ্যোগ গ্রহণ করার৷ এ প্রত্যাশা কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছেই নয়, শিক্ষার্থীদের কাছেও, কেননা, তাঁদেরকেই ভবিষ্যতের জন্যে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই আদায় করতে হবে৷
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্যে আরেকটি বড় ধাপ হলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজনীতির মাঠ থেকে ‘লাল কার্ড' দেখিয়ে দেয়া৷ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা, যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেই বিশ্বাস করে না, তাদের কোনো অধিকারই নেই বাংলাদেশে রাজনীতি করার৷ অন্যদিকে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা রাজনৈতিক নেতাদের চিহ্নিত করার সময়টাও হবে ২০১৬৷ কারণ শুরুটা যত তাড়াতাড়ি হবে, কাজের গতি তত অর্থবোধক হবে৷
রাজনৈতিক শিষ্টাচারের প্রসঙ্গটির ক্ষেত্রেও ২০১৬ হতে পারে আমাদের কাঙ্খিত মাইলফলক৷ আমরা অতীতের কয়েকটি ঘটনায় যেমন দেখেছি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক শিষ্টাচারের অনুকরণীয় নমুনা, তেমনি অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মাঝে দেখেছি শিষ্টাচার বহির্ভূত কদর্য আচরম৷ সরকারি দলের অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-উপমন্ত্রী-এমপিদেরও দেখেছি শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণে ২০১৫ সালকে নানাভাবে কলঙ্কিত করেছেন৷ ২০১৬ সালে এই অপবৃত্ত থেকে তারা বেরিয়ে আসবেন৷ রাজনীতি একটি শিল্পও বটে, রাজনৈতিক নেতারা নিঃসন্দেহে জনগণের কাছে সে-ই সংস্কৃতির উজ্জ্বল শিল্পী৷ এই বোধটুকু ২০১৬ সালে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে প্রত্যাশা করতেই পারি৷ আমরা ‘ক্যামোফ্লেজ'-এর রাজনীতি বা রাজনীতির ক্যামোফ্লেজ চাই না – আমরা চাই স্বচ্ছ রাজনৈতিক শিল্প, যা জনগণের পক্ষে এবং দেশের জন্যে কল্যাণকর৷
সারা দেশে হত্যা ও হামলার প্রতিবাদ
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশককে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিন জনকে হত্যাচেষ্টার প্রতিবাদ চলছে সারা দেশে৷ ছবিঘরে প্রতিবাদ কর্মসূচির কিছু মুহূর্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বর্বরোচিত হামলায় প্রকাশক হত্যা
শনিবার ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে প্রকাশনীর স্বত্তাধিকারী ফয়সাল আরেফিনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷ শনিবার তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়৷ ছবিতে দীপনের মরদেহ দেখে তাঁর স্ত্রীর কান্নায় ভেঙে পড়ার মূহূর্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
আরেক প্রকাশকসহ তিনজন গুরুতর আহত
একই দিনে আরেক হামলায় শুদ্ধস্বর প্রকাশনের স্বত্তাধিকারী আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক তারেক রহিমক এবং কবি ও ব্লগার রণদীপম বসুকে কুপিয়ে জখম করে দুর্বৃত্তরা৷ জাগৃতির লালমাটিয়ার কার্যালয়ে এ হামলার ঘটনা ঘটে৷ ছবিতে চিকিৎসাধীন আহমেদুর রশীদ টুটুল৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ
প্রকাশক ও লেখকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে শনিবারই রাজপথে নামে মানুষ৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad
দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি
প্রকাশক ও লেখকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় বিক্ষোভ মিছিল৷ প্রতিবাদমুখর জনতা হামলায় জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বই প্রকাশ অপরাধ?
এই প্রথম বাংলাদেশে বই প্রকাশের জন্য প্রকাশককে প্রাণ দিতে হলো৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
‘আসুন লেখালেখি বন্ধ রাখি’
প্রতিবাদ সমাবেশের একটি ব্যানারে লেখা, ‘আসুন লেখালেখি বন্ধ রাখি’৷ হত্যাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে এমন তৎপরতা রোধে প্রশাসন ব্যর্থ – এমন ক্ষোভই প্রকাশ পেয়েছে লেখালেখি বন্ধ রাখার কথায়৷ তবে বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টক শো-তে গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার জানান, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন প্রকাশক টুটুল জানিয়েছেন যে, তাঁর ওপর যত হামলাই হোক, ভবিষ্যতেও তিনি বই প্রকাশ করবেন৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
হরতালে পিছালো জেএসসি
জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশককে হত্যা এবং শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিন জনকে হত্যার চেষ্টার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবিতে মঙ্গলবার সারাদেশে আধাবেলা হরতাল ডেকেছে গণজাগরণ মঞ্চ৷ এই কর্মসূচির কারণে মঙ্গলবারের জেএসসির পরীক্ষা সকাল ১০টার পরিবর্তে দুপুর ২টা থেকে শুরু করা হবে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে পরীক্ষাসূচির এই পরিবর্তনের কথা জানানো হয়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: picture-alliance/landov
মামলা
ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ডা. রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় মামলা করেছেন৷ শুদ্ধস্বরের কর্ণধারসহ তিনজনের ওপর হামলার ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি হত্যা চেষ্টা মামলা হয়েছে৷ ওপরের ছবিতে কবি, ব্লগার রণদীপম বসু৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
8 ছবি1 | 8
তিন.
একের পর এক মুক্তচিন্তার মানুষ হত্যার ক্ষেত্রে এক ভয়ার্ত কালো অধ্যায় হিসেবে পঞ্জিকার পাতায় ২০১৫ সাল থেকে যাবে৷ ভিন্ন চিন্তার মানুষের ওপর আক্রমণের যে বিভৎস নজির সৃষ্টি হয়েছে ২০১৫ সালে, তা বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে গেছে প্রায় মধ্যযুগে৷ কলমের বিরুদ্ধে চাপাতির বিভৎসতায় স্তব্ধ হয়ে গেছে চিন্তাশীল মানুষ৷ বিদেশিরাও মৌলবাদীদের হামলার লক্ষ্যতে পরিণত হয়েছেন৷ এক সপ্তাহেরও কম সময়ের ব্যবধানে প্রাণ হারান দু'জন বিদেশি নাগরিক৷ এছাড়াও নজিরবিহীন হামলার ঘটনা ঘটে শিয়া সম্প্রদাযের পবিত্র দিন আশুরা উদ্যাপনের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে৷ ঢাকার চারশ বছরের ইতিহাসে এই ঘটনা এবারই প্রথম৷ এরপর বগুড়াতেও একই ঘটনা ঘটে৷ সেখানকার মানুষ এই হামলার পরই শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বের কথা জানতে পারে৷ এ থেকে সাধারণ মানুষের মানসিকতা স্পষ্ট, যেমন স্পষ্ট জঙ্গি-মৌলবাদীদের অপ-উদ্দেশ্য৷ শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা হাসিলের এ বিভৎস খেলায় জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর অপ-তৎপরতা সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশকে অনেকখানি পিছিয়ে নিয়েছে ২০১৫ সালে৷ হিন্দু সম্প্রদায়ের শতবর্ষী পুরোনো মেলায় বোমা হামলা হয় দিনাজপুরের কান্তজিও মন্দিরে৷ এই আঘাত আমাদের ঐতিহ্যের উপর আঘাত, এ আঘাত আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত৷ তাছাড়া এ ঘটনাগুলোতে বাংলাদেশ অত্যন্ত নেতিবাচকভাবে আলোচিত হয়েছে আন্তর্জাতিক নানা প্রাঙ্গনে, যার প্রভাব নানামুখি৷ বছরের শেষ দিনে যদিও ব্লগার ও স্থপতি রাজীব হায়দার শোভনের (২০১৩ সালে তাঁকে হত্যা করে মৌলবাদীরা) হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা হয়েছে, কিন্তু অন্য মামলাগুলো এখনও শ্লথগতিতে এগিয়ে চলছে৷ ২০১৬ সালের বাংলাদেশের কাছে প্রত্যাশা – এ বাংলাদেশ হবে সকলের, সকল মতের৷ এখানে দর্শনকে দর্শন দিয়েই খণ্ডানোর সংস্কৃতি চালু হবে, গ্রন্থের বিরুদ্ধে থাকবে গ্রন্থ, চিন্তার বিরুদ্ধে চিন্তা, মতের বিরুদ্ধে মত৷ তাই চাইবো, দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হোক ন্যায় বিচারের ২০১৬ সালের সৌধ৷ কেবল মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীই নয়, ২০১৬ সালে চিহ্নিত করা হোক প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে থাকা আলোহীন মনোজগতের সেইসব করুণার পাত্রদের, যারা প্রশাসনে থেকেই তাদের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে আরও বেশি৷ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হবার ব্যর্থতাকে ঢাকতে চাইছে চটুল আর উন্মাদগ্রস্ত বক্তব্য দিয়ে৷ প্রশাসন কখনও কোনো বিশেষ মতের অনুসারী হতে পারে না৷ প্রশাসনের কোনো ধর্ম নেই, আইনের কোনো ধর্ম নেই, রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম নেই – থাকতে পারে না৷ কিন্তু ব্যক্তি, যারা এই প্রশাসন বা সংস্থাগুলোর দায়িত্বে আসছেন, তাদের মনোজগৎ মুক্ত হোক সব মত ও পথের জন্য৷ রাষ্ট্রের চরিত্র যদি কোনো বিশেষ মতের চরিত্র হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে, সে রাষ্ট্রে ভিন্ন মতের মানুষের কোনো নিরাপত্তা নেই৷ এই মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই কেবল প্রচ্ছদ করে তৈরি করতে হবে রাষ্ট্রের মানসিকতা৷ সেই কর্মযজ্ঞে সকল মানুষের অনবদ্য সমন্বয় হোক ২০১৬ সাল৷ বাংলাদেশ মুক্ত হোক সকল জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী অপশক্তির ভয়াল থাবা থেকে৷ মানুষের জন্যে ২০১৬ সালেই বাংলাদেশ হয়ে উঠুক কল্যাণকর একটি রাষ্ট্র৷
জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠন জামায়েত ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ জামায়াত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের ঘোষণা দিয়েছে৷ এদিকে দাবি উঠেছে, জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার৷ এই বিষয়ে আমাদের ছবিঘর৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
‘‘জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল’’
বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার (০১.০৮.১৩) বিকেলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করেছেন হাইকোর্ট৷ বিচারপতি এম মোয়াজ্জেম হোসেন, ইনায়েতুর রহিম এবং কাজী রেজা-উল-হকের সমন্বয়ে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাদের রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন৷ রায়ে বলা হয়, ‘‘জামায়াতের গঠনতন্ত্র শুধু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, জামায়াত একটি সন্ত্রাসী দল৷’’
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
২০০৯ সালের রিটের রায়
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কয়েকটি সংগঠন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা হাইকোর্টে রিট করেন ২০০৯ সালে৷ রিটে জামায়াতের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে উল্লেখ করা হয়, জানান ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর৷ সেই রিটের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রায় ঘোষণা করলেন আদালত৷
ছবি: Reuters
জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
আদালতের রায়ের পর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এবং এই মামলার আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক জানান, রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন৷ সেজন্য ইতিমধ্যে রায়ের কার্যকারিতার স্থগিতাদেশ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান
১৯৭১ সালে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর চূড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জন করে বাংলাদেশ৷ বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ‘‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল৷ তবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেদলের কিছু নেতার হত্যা, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের মতো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে জামায়াত৷’’
ছবি: AP
ট্রাইব্যুনালে বিচার
জামায়াত যুদ্ধাপরাধের দায় অস্বীকার করলেও ২০১০ সালে গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একের পর এক জামায়াত নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণ হচ্ছে৷ এই ছবিঘর তৈরির দিন (০১.০৮.১৩) অবধি ছয়জনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল৷ সর্বশেষ আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে৷
ছবি: Reuters
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷
ছবি: AP
জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি
এদিকে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায়ের পর দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি আরো জোরালো হয়েছে৷ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানালেও সরকার এতটা সাহসী হবে বলে আশা করেন না৷ মুনতাসির মামুনের কথায়, ‘‘জামায়াত একটি যুদ্ধাপরাধী দল৷ ট্রাইব্যুনালের একাধিক রায়ে তা বলাও হয়েছে৷ তাই যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবেও জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
ব্লগারদের সতর্ক প্রতিক্রিয়া
বৃহস্পতিবার আদালত রায় ঘোষণার আগেই ফেসবুকে আরিফ জিবতেক লিখেছেন, ‘‘হাইকোর্টের রায়টা কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ নিয়া মামলা না৷ মামলাটা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনে জামায়াত আইনসিদ্ধভাবে নিবন্ধিত হয়েছে কিনা, সেটা নিয়ে বিবেচনা৷’’ এই ব্লগার লিখেছেন, ‘‘যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার চাই, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নিয়া আমার মাথাব্যথা নাই৷’’
ছবি: privat
এই দাবি নতুন নয়
পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৪১ সালে জামায়াত প্রতিষ্ঠার পর মোট তিনবার দলটি নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ১৯৫৯ এবং ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে৷ ১৯৭৯ সালের ২৫শে মে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জামায়াত প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ পায়৷
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও বিচারের রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে ২০১৬ হবে আমাদের আকাঙ্খার কেন্দ্রবিন্দু৷ ইতোমধ্যেই দু'জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় কার্যকর করেছেন বাংলাদেশের সরকার৷ একই সঙ্গে গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনায় এসেছে জামাত-শিবির নিষিদ্ধের বিষয়টি৷ এই বিষয়টির ক্ষেত্রে ২০১৬ সালেই একটি সমাধানে পৌঁছানো যাবে বলে প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের৷ একই সঙ্গে জামাত-শিবিরের বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারি আওতাধীন আনার বিষয়েও ২০১৬ একটি কার্যকর বছর বলে আমরা মনে করছি৷ কেননা ২০১৩ সাল থেকেই সারা দেশের মানুষ স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে জামাতের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান৷ এরপরেও তিন বছর অতিবাহিত হতে চলছে, অথচ সরকারের কোনো কার্যকর উদ্যোগ চোখেই পড়ছে না৷ ২০১৬ সালেই এ প্রশ্নে সরকার আরও সচেষ্ট হয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করবে – এ প্রত্যাশা আমাদের সকলেরই৷
২০১৫ সালে সরকারের একটি সাহসি ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ পদ্মা সেতু৷ বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গর্বিত, কেননা আমরা নিজেদের উদ্যোগেই নির্মাণ করতে যাচ্ছি ছয় কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ পদ্মা সেতু৷ ২৮ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পটির অর্থায়ন করবে বাংলাদেশ সরকার নিজেই৷ ২০১৬ সালে নিজস্ব অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনার ধারাটি অব্যাহত থাকবে – এমন প্রত্যাশা আমাদের সকলেরই৷
চার.
আগেই বলেছি, কোনো আকাশ-কুসুম প্রত্যাশার দাবি নিয়ে লেখাটি লিখছি না৷ বরং আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে আমাদের কাজের প্রতি সচেতনতাটুকুও এখানে মুখ্য আলোচনা৷ আমাদের অধিকারের হরিৎক্ষেত্রটি আমাদেরই যত্ন করতে হবে, নির্মাণ করতে হবে আমাদের নিজস্ব কর্ম-পরিকল্পনা৷ রাষ্ট্রকে যেমন উন্নয়নমূলক ও আদর্শগত কাজ বাস্তবায়নের বিষয়ে শক্তিশালী করতে হবে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে রাষ্ট্র-চরিত্র যেন বিচ্যুত না হয়, সে লক্ষ্যে সমানভাবে কাজ করতে হবে৷ ২০১৬ সালে বাংলাদেশকে আমরা দেখতে চাই আমাদের অতীতের ভুলগুলোর ঊর্ধ্বে, আমরা শুনতে চাই নতুন বছরের নতুন গান – যে গান মানুষের, যে গান কল্যাণের, যে গান কর্মের আর উদ্বোধিত শুভবোধের কোরাস৷