শুধু ঢাকা কেন, এবার সারাদেশেই কোরবানির পশুর হাটে আলোচিত ‘বাংলার বস’ ও ‘বাংলার সম্রাট’৷ বাংলার বস গত বছর দেশের সবচেয়ে বড় ষাড়ের স্বীকৃতি পেয়েছে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে৷
বিজ্ঞাপন
গরু দুটিকে তোলা হয়েছে ঢাকার গাবতলি গুরুর হাটে৷ মালিক আজমত আলি গায়েনের অভিযোগ সিন্ডিকেট করে তার গরু বিক্রি করতে দেয়া হচ্ছে না৷ তাই অর্ধেক দাম পেলেও বিক্রি করে দেবেন৷ কিন্তু তাও পাচ্ছেন না৷
বাংলার বসের দাম হেঁকেছেন তিনি ৩০ লাখ টাকা৷ গরুটিতে ৩৭ মণ মাংস আছে বলে দাবি তার৷ আর বাংলার সম্রাটের দাম চান ২৫ লাখ টাকা, মাংস হবে ৩৫ মণ৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্ধেক দামেও ক্রেতা পাচ্ছেন না৷ আজমত আলি এখন দুইটি গরু ২৫ লাখ টাকায়ই ছেড়ে দিতে চান৷ তাতে তার সাত-আট লাখ টাকা লোকসান হলেও তিনি আর গরু নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে চান না৷
৩৫ বছরের আজমত আলি ঢাকায় রিকশা চালাতেন৷ ২০০৯ সালে কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়ি যশোরের মনিরামপুরে চলে যান তিনি৷ তারপর সমিতি ও কিছু ব্যবসা করে টাকা জমান৷ গড়ে তোলেন দুধের গাইয়ের খামার৷ পাশাপাশি কোরবানিতে বিক্রির জন্য ষাড় পালন শুরু করেন৷
এবার যে দুইটি গরু ঢাকার গাবতলির হাটে তিনি নিয়ে এসেছেন তা ফ্রিজিয়ান জাতের৷ বাংলার বসকে এক বছরের কিছু সময় আগে ১৬ লাখ টাকায় কেনেন তিনি৷ আর সম্রাটকে কেনেন আরো আগে৷ গাবতলির হাটের মূল ফটকের কাছেই দুইটি গরু তিনি রেখেছেন পাঁচদিন আগে৷ এজন্য তাকে দিতে হচ্ছে ২৫ হাজার টাকা৷ দুইটি গরুর পিছনে এখন পর্যন্ত তার ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে৷ গত বছর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর দেশের সবচেয়ে বড় ষাড়ের স্বীকৃতি দেয় বসকে৷ আজমত আলিকে দেয় পুরস্কার৷ তারাই তখন ষাড়টির নাম দেয় ‘বাংলার বস’৷
আজমত আলি
‘বাংলার বসকে’ ঠেকাতে সিন্ডিকেট?
আজমত আলির অভিযোগ, ‘‘এমনিতেই এবার ক্রেতাদের আগ্রহ কম৷ তার ওপর ঢাকার খামারিরা সিন্ডিকেট করে আমার গরুর ক্রেতাদের ফিরিয়ে দিচ্ছে৷ তাদের লোকজন চারপাশে ঘিরে থাকে৷ তারা বলে দেয় গরু বিক্রি হবে না৷ কেউ যদি তাদের উপেক্ষা করে দাম জানতে আসে, আমি দাম চাইলে সিন্ডিকেটের লোকজন বলে এর অর্ধেক দামে এরচেয়ে বড় গরু আমরা দেব৷ ক্রেতার মন ভেঙে যায়৷ ফিরে যান৷’’
ইজারাদার ও পুলিশের কাছে অভিযোগও করেছেন তিনি৷ কিন্তু তাতেও কাজ হয় না৷ তারা যখন আসে সিন্ডিকেটের লোকজন সরে যায়৷ আজমত আলি বলেন, ‘‘সবাই ছবি তোলে, সেলফি তোলে আমার গরুর সঙ্গে , কিন্তু কেউ কেনে না৷ বিভিন্ন অনলাইনও আমার সাথে কথা না বলেই আমার গরুর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছে৷’’
ঢাকার বাইরে থেকে আসা আরো কয়েকজন গরুর ব্যাপারি সিন্ডিকেটের অভিযোগ করেন৷ ঢাকার খামারিরা সিন্ডিকেট করে বাইরের গরু বিক্রিতে কৌশলে বাধা দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন অনেকে৷ তবে ক্রেতা মনে করেন, এবার বড় এবং বেশি দামের গরুর চাহিদা কম৷ অনেকে কোরবানি দিচ্ছেন না৷ কেউ কেউ কোরবানি দিলেও উৎসব নেই করোনার কারণে৷
ক্রেতা মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘গতবারের চেয়ে এবার আমাদের বাজেট অনেক কম৷ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে৷’’
গাবতলি গুরুর হাটের ম্যানেজার মো. সানোয়ার হোসেন অবশ্য দাবি করেন, সিন্ডিকেট করে গরু বিক্রিতে বাধা দেয়ার কোনো অভিযোগ তারা এখনো পাননি৷ তবে অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেবেন৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের জানার বাইরে কেউ এরকম কিছু করে থাকলে তো আমাদের কিছু করার নাই৷’’
বাস্তবতা ভিন্ন, হাট আগের মতো
ভিন্ন বাস্তবতায় এবার আসছে কোরবানির ঈদ৷ তারপরও বিক্রেতাদের আশা বিক্রি হবে আগের মতোই৷ হাট না জমলেও বাজারে আসা মানুষের সামাজিক দূরত্ব বা করোনা নিয়ে ভীতি তেমন একটা নেই৷
ছবি: Sazzad Hossain
ক্রেতা কম
দেশের সবচেয়ে বড় কোরবানির হাটটি বসে ঢাকার গাবতলীতে৷ ঈদের মাত্র চারদিন বাকি থাকলেও ক্রেতা সমাগম অন্যবারের চেয়ে কম৷ সংখ্যায় কম এসেছে পশুও৷
ছবি: Sazzad Hossain
শিশু ও বৃদ্ধ
করোনা ভাইরাসের কারণে শিশু ও বৃদ্ধ হাটে আসতে বারণ করা হয়েছে৷ তবে অনেকেই তা মানছেন না৷
ছবি: Sazzad Hossain
বাংলার বস
এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ষাঁড়ের স্বীকৃতি পেয়েছে৷ মালিক আজমত আলি বাংলার বসের দাম হেঁকেছেন ৩০ লাখ টাকা৷ গরুটিতে ৩৭ মণ মাংস আছে বলে দাবি তার৷
ছবি: Sazzad Hossain
সামাজিক দূরত্ব
হাটগুলোতে মোবাইল কোর্ট আছে৷ তারপরও সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো বালাই নেই৷ এজন্য বিশেষ কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি৷ ইজাদারদের পক্ষ থেকে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারও সরবরাহ করা হয়নি৷
ছবি: Sazzad Hossain
বাংলার সম্রাট
আজমত আলি তার এই গরুটির নাম দিয়েছেন বাংলার সম্রাট৷ ৩৫ মণ ওজনের গরুরটির দাম চেয়েছেন ২৫ লাখ টাকা৷ কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্ধেক দামেও ক্রেতা পাচ্ছেন না৷
ছবি: Sazzad Hossain
হ্যান্ড স্যানিটাইজার
কিছু বেসরকারি সংগঠন হাটে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছে৷ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মাইকে ঘোষণাও চলছে৷
ছবি: Sazzad Hossain
নির্দেশিকা
স্বাস্থ্যবিধি মানতে হাটের ভিতরে প্রবেশমুখে স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত ব্যানার টানিয়েই দায়িত্ব শেষ করেছে সিটি কর্পোরেশন৷
ছবি: Sazzad Hossain
গতবারের অর্ধেক
ঢাকায় এবার মোট ১৯টি গরুর হাট বসেছে৷ এরমধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ১২টি এবং উত্তরে নয়টি। ব্যাপারিরা জানান, গতবারের তুলনায় এবার ৫০ ভাগ গরু কম এসেছে৷
ছবি: Sazzad Hossain
এক কোটি পশু
বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী আসন্ন কোরবানির ঈদের জন্য এক কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি পশু রয়েছে৷ গত বছর এক কোটির কিছু বেশি পশু কোরবানি হয়েছিল৷ মহামারির কারণে এ বছর তা আরও কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Sazzad Hossain
9 ছবি1 | 9
গরু কম, ক্রেতাও কম
গরুর ব্যাপারিদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার ঢাকায় গরু এসেছে গতবারের অর্ধেক৷ আর ভারতীয় গরুও হাটে নেই৷ কড়াকড়ির পরও অল্প কিছু গরু চোরাচালানির মাধ্যমে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসলে তা ঢাকা পর্যন্ত আসেনি৷
ঢাকায় এবার মোট ১৯টি গরুর হাট বসেছে৷ এরমধ্যে দক্ষিণ সিটিতে ১২টি এবং উত্তরে ৯টি৷ গরুর ব্যাপারি লালন মিয়া জানান, গতবারের তুলনায় এবার ৫০ ভাগ গরু কম এসেছে৷ তার সঙ্গে অনেক ব্যাপারি এবার আর গরু নিয়ে আসেননি৷ যারা এসেছেন তারাও আতঙ্কে আছেন সব গরু বিক্রি করতে পারবেন কিনা৷ আর দামও ক্রেতারা অনেক কম বলছেন৷
হাটগুলোতে মোবাইল কোর্ট আছে৷ কিন্তু তারপরও সামাজিক দূরত্ব মানার কোনো বালাই নেই৷ আর এটা মানা সম্ভব নয় বলেও জানান কয়েকজন৷ ইজাদারদের পক্ষ থেকে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা দেখা যায়নি৷ কিছু বেসরকারি সংগঠন পশুর হাটে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা করেছে৷ তবে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে মাইকে ঘোষণা চলছে৷আর গরুর হাটে বয়স্ক ও শিশুদের যেতে নিরুৎসাহিত করা হলেও তারা যাচ্ছেন৷
তবে কোনো কোনো ইজারাদার দাবি করেন তারা হাসিল কাউন্টারে ফ্রি মাস্ক ও স্যানিটাইজারারের ব্যবস্থা করেছেন৷ আবার কেউ বলছেন এটা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব৷
করোনায় খামারে পশু বেচাকেনা
সংক্রমণ এড়াতে কোরবানির পশু কিনতে উন্মুক্ত হাটের চেয়ে খামারের দিকে বেশি ঝুঁকছেন মানুষ৷ এক্ষেত্রে উচ্চ মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের আগ্রহই বেশি৷ চাহিদা বেশি থাকায় এবার দামও কিছুটা বেশি বলে অভিযোগ ক্রেতাদের৷
ছবি: DW/M. Rashed
সাজসজ্জা
সাধারণ সময়ে খামারগুলোতে সরাসরি ক্রেতার আসেন না৷ তবে গত কয়েকবছরে ঈদে খামার থেকে গরু কেনার প্রবণতা শুরু হয়েছে৷ ক্রেতাদের অভ্যর্থনা জানাতে খামারগুলোকে সাজানোও হয়েছে তাই নতুনরুপে৷
ছবি: DW/M. Rashed
দর্শক
ঢাকার কিছু খামারে এখন কোরবানিকে সামনে রেখে বিদেশি জাতের অনেক গরু মোটাতাজা করা হয়৷ বিশালাকারের এসব গরু দেখতে ক্রেতাদের পাশাপাশি উৎসাহী মানুষও জড়ো হন৷ এটি সাদিক এগ্রো ফার্মের ছবি৷
ছবি: DW/M. Rashed
গরু দেখা
নারায়নঞ্জের নাবিল এগ্রো থেকে পাঁচটি গরু আগেই কিনে রেখেছে ঢাকার একটি পরিবার৷ ধানমণ্ডি থেকে তারা এসেছেন গরুগুলো দেখতে৷ ঈদের আগেই সেগুলো খামার থেকে পৌঁছে দেয়া হবে তাদের বাড়িতে৷
ছবি: DW/M. Rashed
পরিচ্ছন্নতা
এই খামারটিতে গড়ে ২০ টি গরুর দেখাশোনার জন্য রয়েছে একজন পরিচর্যাকারী৷ কোরবানিকে সামনে রেখে পরিচ্ছন্নতায় রাখা হচ্ছে না কোন ত্রুটি৷
ছবি: DW/M. Rashed
ছুঁয়ে দেখা
নাবিল এগ্রো এবারের কোরবানির জন্য মোট ২৫০ গরু প্রস্তুত করেছে৷ তাদের কাছে ৪০ হাজার টাকা থেকে আট লাখ টাকা দামের গরুও রয়েছে৷
ছবি: DW/M. Rashed
ক্রেতাদের পরামর্শ
সাধারণত এই ধরনের খামারে পরিচিত ক্রেতারা পুরনো সম্পর্কের ভিত্তিতেই গরু কিনতে আসেন বেশি৷ অনেক ক্রেতা অবশ্য একাধিক খামার ঘুরেও দাম যাচাই করে নেন৷ গরু দেখার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে নিচ্ছেন এই পরিবারের সদস্যরা৷
ছবি: DW/M. Rashed
অর্ধেক বিক্রি শেষ
খামারগুলো দেশি জাতের পাশাপাশি অ্যামেরিকার ব্রাহমা, ইন্ডিয়ান বলদ, শাহিওয়াল, দেশাল, ভূটানি গরুও মোটাতাজা করে৷ ঈদের দিন সাতেক বাকি থাকতেই নামিদামি ফার্মগুলোতে অর্ধেকের বেশি গরু বিক্রি হয়ে গেছে৷ খামার মালিকেরা আশাবাদী যে এবার করোনার প্রভাব সত্ত্বেও বিক্রি ভালো হবে৷
ছবি: DW/M. Rashed
ওজন নেয়া
এই খামারটিতে এক হাজার কেজি পর্যন্ত ওজনের গরু আছে৷ ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়েরই সুবিধার্থে বিক্রির আগে-পরে গরুগুলোর ওজন লিখে রাখা হয়৷
ছবি: DW/M. Rashed
সবচেয়ে বড় গরু
অ্যামেরিকান ব্রাহমা জাতের ‘রোজো’ নামের এই গরুটির বয়স মাত্র সাড়ে তিন বছর৷ দেড় বছর বয়সে এটি আমদানি করেছে সাদিক এগ্রো৷ এখন গরুটির ওজন প্রায় ১৩০০ কেজি, যা দেশে এবারের কোরবানির সবচেয়ে বড় গরু বলে দাবি তাদের৷ পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী ৩৭ লাখ টাকা দিয়ে ঈদের ১৫ দিন আগেই সেটি কিনে নিয়েছেন৷