পশ্চিমবঙ্গে আল কায়দা জঙ্গি গোষ্ঠী সংগঠন বাড়াচ্ছে৷ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়ের সাম্প্রতিক মন্তব্যে ফের আলোড়ন রাজ্য রাজনীতিতে৷
বিজ্ঞাপন
পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় গত শনিবার দিল্লিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এর সঙ্গে দেখা করার পরেই মন্তব্য করেন, পশ্চিমবঙ্গে আল কায়দার মতো আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী তাদের সংগঠন বাড়িয়ে চলেছে, কিন্তু রাজ্য সরকার নির্বিকার৷ ভোটের বছরে কেন্দ্রের সরকারের কাছে রাজ্যপালের এই ধরনের অভিযোগের অবশ্যই রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে৷ বিশেষত যেখানে পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতা দখলে তৎপর বিজেপি বারবারই রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির অভিযোগ তুলে, কেন্দ্রীয় শাসন জারির দাবি তুলছে৷ কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে পরিস্থিতি আদতেই কতটা উদ্বেগজনক?
সারা ভারতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এবং অভিযানের মূল দায়িত্ব জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ'র৷ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে গত বছর নভেম্বরে জঙ্গিসন্দেহভাজনদের গ্রেপ্তারি এবং তাদের ডেরায় তল্লাসির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত এনআইএর এক অফিসার পরিচয় গোপন রাখার শর্তে জানালেন, উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ আছে৷ মাটির তলায় কংক্রিটের ঘর এবং সুড়ঙ্গ তৈরি ছাড়াও, হাতে তৈরি বিস্ফোরক খুঁজে পাওয়া গেছে৷ তল্লাশি করে পাওয়া গেছে হাতে তৈরি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, যা এমনকি মাওবাদী জঙ্গিরাও কখনও বানায়নি৷ এসবের অর্থ একটাই৷ বড় কোনও নাশকতার প্রস্তুতি চলছিল৷
এনআইএ'র ওই অফিসার জানালেন, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ দায়ের হওয়া আর.সি-৩১/২০২০ মামলায় দেশের একাধিক জায়গা থেকে মোট ১১ জনকে আটক করা হয়েছে, যারা প্রত্যেকেই বাঙালি এবং পশ্চিমবঙ্গেরবাসিন্দা৷ এর মধ্যে একদিনেই আটক হয়েছে নয় জন৷ ছয় জন মুর্শিদাবাদে এবং তিন জন কেরলে৷ এই দলটির নেতা সন্দেহে আটক হয়েছে জনৈক মুরশিদ হাসান ওরফে শফিক, যে পূর্ব এবং দক্ষিণ ভারতের একাধিক জায়গা ঘুরে আল কায়দার জিহাদি মতবাদ প্রচার করছিল বলে অভিযোগ৷
আইএস এখনো যেসব দেশের জন্য হুমকি
মার্কিন সামরিক অভিযানে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবু বকর আল বাগদাদি নিহত হয়েছেন৷ তবে এখনও অনেক দেশের জন্য এই জঙ্গি গোষ্ঠীকে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা৷
ছবি: dpa
ইরাক
দেশটিতে মার্কিন সমর্থিত বাহিনীর কাছে হেরে আইএস যোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে৷ এখনও তারা ইরাকের কয়েকটি প্রদেশে অপহরণ ও বোমাবাজি করছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরাকে প্রায় দুই হাজার আইএস যোদ্ধা সহিংস তৎপরতা চালাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/Dabiq
সিরিয়া
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও গত বছর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালিয়েছে আইএস৷ অ্যামেরিকান বাহিনীকেও টার্গেট করেছে তারা৷ ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মরুভূমিতে সক্রিয় রয়েছে৷
ছবি: DW/Judit Neurink
মিশর
বিগত এক বছরে মিশরে কোনো বড় আক্রমণ না হলেও দেশটিতে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে৷ দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিনাই প্রদেশে অভিযানে কয়েকশ উগ্রপন্থি নিহত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Desouki
সৌদি আরব
সৌদি আরবে বেশ কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীসহ সংখ্যালঘু শিয়াদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে আইএস৷ সৌদি আরব যখন আইএসের বিরুদ্ধে প্রচারে অংশ নিয়েছিল তখন তাদের বিরুদ্ধেও আক্রমণ চালানোর আহ্বান জানিয়েছিল গোষ্ঠীটি৷ অ্যামেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি বলছে, আইএস সৌদি আরবে এখনও সক্রিয় এবং সৌদি কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে ভালো জানে৷
ছবি: dpa
ইয়েমেন
আইএস ২০১৪ সালের শেষদিকে ইয়েমেন শাখা ঘোষণা করে৷ হুতি বিদ্রোহী ও সৌদি আরব সমর্থিত আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সরকারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে৷ ইয়েমেনে আইএস আল কায়েদার সাথে লড়াই করছে এবং উভয় দল শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ দেশটিতে অনেক হামলা ও হত্যার দায় আইএস স্বীকার করলেও কোনো অঞ্চল তাদের দখলে নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
নাইজিরিয়া
বোকো হারাম ২০০৯ সাল থেকে উত্তর নাইজেরিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় আক্রমণ চালিয়েছে৷ ২০১৬ সালে এই গোষ্ঠীকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যার একটি অংশ আইএসের প্রতি অনুগত৷ আইএস পশ্চিম আফ্রিকায় গত বছর বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল৷ এই অঞ্চলে গোষ্ঠীটির আধিপত্য বাড়ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Marte
আফগানিস্তান
দেশটিতে ২০১৫ সাল থেকে সক্রিয় রয়েছে আইএস৷ এখনো নানগারহার প্রদেশে তাদের খুব শক্তিশালী মনে করা হয়৷ অ্যামেরিকান কমান্ডাররা বলছেন, আফগানিস্তানে প্রায় দুই হাজার আইএস যোদ্ধা তালেবানকে আক্রমণ করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/E. Waak
শ্রীলঙ্কা
এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় গির্জা ও হাসপাতালে বোমা হামলায় জড়িত ছিল বলে দাবি করে আইএস৷ শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা বিস্ফোরণের জন্য তাদের সঙ্গে যুক্ত দুইটি স্থানীয় মুসলিম উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে দায়ি করেন৷ ওই বিস্ফোরণের পর আইএস একটি ভিডিও প্রকাশ করে যাতে আটজনকে তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা যায়৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশটির হাজার হাজার মানুষ আইএসের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত বলে জানা গেছে৷ ধারণা করা হয় প্রায় ৫০০ ইন্দোনেশিয়ান আইএসের পক্ষে লড়াইয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল৷ গত বছর সুরবায়ায় আত্মঘাতী হামলায় ৩০ জন নিহত হয়৷ ওই হামলার পেছনে আইএস এর মদদপুষ্ট জামাহ আনসারুত দৌলা সংগঠনটির হাত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ফিলিপাইন্স
ফিলিপাইন্সরা আশঙ্কা করছেন সিরিয়া ও ইরাক থেকে পালিয়ে আসা আইএস উগ্রপন্থিরা মিন্ডানাও প্রদেশের প্রত্যন্ত বন এবং মুসলিম গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে৷ এই অঞ্চলটি নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ইসলামী বিদ্রোহের কারণে কুখ্যাত৷ এই অঞ্চলে সংঘটিত হামলা এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য আইএস দায় নিলেও তার যথার্থতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: Reuters/Handout
10 ছবি1 | 10
যদিও মুর্শিদাবাদের গ্রেপ্তারির ঘটনায় পাল্টা অভিযোগও উঠেছিল, যে যারা গ্রেপ্তার হয়েছে এনআইএ'র হাতে, তারা সবাই নিরীহ সাধারণ মানুষজন৷ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংস্থা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার বশবর্তী হয়েই মুসলিমদের অভিযুক্ত করছে৷ কিন্তু বিষয়টা এরকম নয় তো যে বিজেপির মুসলিম-বিরোধিতার নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে আসল বিপদটা নজর এড়িয়ে যাচ্ছে?
‘‘হিন্দুরাও যুক্ত আছে কম-বেশি’’: শামিম আহমেদ
অধ্যাপক শামিম আহমেদ, যিনি সব সময়ই সোশাল মিডিয়ায় এবং সভা-সমিতিতে এই ধরনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ধরপাকড় হেনস্থার প্রতিবাদ করে থাকেন, তিনি কিন্তু প্রশ্নটার গুরুত্ব স্বীকার করছেন৷ তবে তাঁর মতে, ‘‘(বিপদের সম্ভাবনা) বেশিরভাগ সময়ে চোখের আড়ালেই থাকে৷ আমার তো মুর্শিদাবাদে, সীমান্ত এলাকায় বাড়ি৷ যারা এই ধরনের কাজ করে থাকে, তাদের সঙ্গে পুলিশ, প্রশাসনের একটা অংশ তো আছে৷ যারা কাজটা করছে, তারা মুসলমান, কিন্তু টাকাপয়সার জোগানে হিন্দু লোকও যুক্ত আছে৷ এটা একটা বড় র্যাকেটও৷ অস্ত্রশস্ত্র থেকে শুরু করে সব কিছুই৷ ছোটবেলা থেকেই এটা আমরা দেখে আসছি৷ এর মধ্যে ধর্মীয় বিষয় ছিল না৷ যেহেতু সেখানে ৬০-৬৫% মুসলমান, সেহেতু যারা যুক্ত আছে, তাদের অধিকাংশই মুসলমান৷ কিন্তু হিন্দুরাও যুক্ত আছে কম-বেশি৷''
রাজ্যপাল ধনকড়ের অভিযোগের পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর এখনও কোনও পদক্ষেপ করেনি৷ তবে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শুরু থেকেই মুর্শিদাবাদেএনআইএর কাজকর্ম সম্বন্ধে অবহিত থাকছেন৷ প্রকৃত অপরাধীদের চিহ্নিত করার সময়, তিনি ধর্মনিরপেক্ষভাবে প্রশাসকের ভূমিকা পালন করেন কি না, সেটাই এবার দেখার৷