বাংলা বলে নির্দিষ্ট ভাষা নেই: মালবীয়, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?
৫ আগস্ট ২০২৫
দিল্লি পুলিশের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে যখন বাংলা ও বাংলাদেশি ভাষা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল, ঠিক তখনই অমিত মালবীয়র মন্তব্য বিতর্কে ঘি ঢেলেছে।
ঘটনার সূত্রপাত
দিল্লি পুলিশের হাতে ধৃত আট জন সন্দেহভাজন বাংলাদেশি নাগরিকের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছিল কিছু নথি। পুলিশ এ ব্যাপারে অনুবাদক চেয়ে দিল্লিতে বঙ্গভবনকে চিঠি লিখেছিল। সেই চিঠিতে উল্লেখ ছিল 'বাংলাদেশি ভাষা'র। এরপরই দিল্লি পুলিশকে তীব্র আক্রমণ করে তৃণমূল সহ ইন্ডিয়া জোটের শরিক দল আরজেডি, কংগ্রেস এবং ডিএমকে।
রোববার দিল্লি পুলিশের হয়ে যুক্তি খাড়া করেন অমিত মালবীয়। তিনি এক্স হ্যান্ডেলে বলেন, "দিল্লি পুলিশ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে গিয়ে তাদের ভাষাকে বাংলাদেশি বলে ঠিকই করেছে। এই শব্দবন্ধটা ব্যবহার করা হয়েছে ডায়ালেক্ট সিনট্যাক্স ও উচ্চারণের প্রভেদ তুলে ধরতে।"
তার সওয়াল, "বাংলা বলে নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই যা এই সব প্রভেদকে এক ছাতার তলায় আনতে পারে, দিল্লি পুলিশ বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের ভাষাকে বোঝাতে বাংলাদেশি ভাষা কথাটা ব্যবহার করেছে। পশ্চিমবঙ্গে যে বাংলা ভাষায় কথা বলা হয় তার জন্য নয়।"
বাংলা ভাষাকে যেভাবে ব্যাখ্যা করেছেন মালবীয় তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজনৈতিক থেকে বুদ্ধিজীবীরা।
বিশিষ্টজনেরা যা বলছেন
আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক তপোধীর ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেছেন, "দেশভাগের ৭৮ বছর পরে যারা অজ্ঞানতার চরম পরিচয় দেয়, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী, এ বিষয়ে কথা বলার মানে নেই। বাংলা ভাষাই ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশের বাঙালির মাতৃভাষা। সংবিধান অনুযায়ী এদেশে হিন্দি রাষ্ট্রভাষা নয়, সমস্ত সংবিধান স্বীকৃত ভারতীয় ভাষাই রাষ্ট্রভাষা।"
তিনি বলেন, "আমাদের এখন একসঙ্গে বাঙালির উপর স্পর্ধিত ফ্যাসিবাদী আক্রমণ প্রতিরোধে জোট তৈরি করতে হবে। দেশভাগের চেয়েও অনেক বড় সঙ্কটের মুখে আমরা।"
চিন্তাবিদ ও গবেষক আশীষ লাহিড়ী ডিডাব্লিউকে বলেন, "এদের এত নির্বোধ মনে করতে রাজি নই। চিরকালই ফ্যাসিস্টরা যা করে, কিছু লোককে উসকে দিয়ে অন্য কিছু লোকের সমাজে যে ন্যায্য স্থান রয়েছে, সেটা দাবিয়ে দেওয়া। আজ দেশে ভাষা নিয়ে যে নতুন আবহাওয়া তৈরির চেষ্টা চলছে, তার উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্তানি। অর্থাৎ হিন্দু ধর্মের সঙ্গে হিন্দি ভাষাকে মিলিয়ে দিয়ে একটা রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বিভিন্ন দিক থেকে।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন, "তথাকথিত সংস্কৃত ভিত্তিক ভাষাগুলোর উপরে ওরা হিন্দির একটা নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। এই উদ্যোগ দক্ষিণ ভারতে বাধা পাচ্ছে। এখানে বাধা অপেক্ষাকৃত কম। একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলা ভাষা। তাই বাংলাদেশ সেন্টিমেন্টের সঙ্গে বাংলা ভাষাকে জুড়ে দিতে চাইছে। আমরা যেন এই উসকানিতে পা না দিই। আমরা জানি বাংলা ভাষা কী। আমরা শুধু এটাকে সেয়ানা পাগলামি বলে চিহ্নিত করতে চাইব।"
শিক্ষাবিদ তথা রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য পবিত্র সরকার বলেন, "এ ধরনের অশিক্ষিত কথাবার্তা একজন আইটি সেলের প্রধান বলবেন, আশা করিনি। বিজেপি যদি আশা করে থাকে যে, বাংলায় তারা ভোটে জিতবে, তাহলে তাদের কোনও প্রতিযোগী বা শক্রর দরকার হবে না। অমিত মালবীয়র মতো লোকেরাই বিজেপির ভরাডুবির জন্য দায়ী হবেন। এ নিয়ে বেশি কথা খরচ করাটাও অবান্তর।"
বিজেপি রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য দুই বাংলার ভাষার মধ্যে একটা বিভাজন রেখা টানতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, "আপনি বাংলাদেশের একটি বই পড়ুন আর পশ্চিমবঙ্গের টেক্সট বই পড়ুন। পড়লেই বুঝতে পারবেন কোন বই সুবোধ সরকার লিখেছেন আর কোন বই বাংলাদেশের শফিকুল ইসলাম লিখেছেন।"
সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী বিস্মিত হয়েছেন শমীকের যুক্তি শুনে। তিনি বলেন, "ক্রিয়াপদের জন্য ওপার বাংলার সঙ্গে এপার বাংলার কিছু ভাষাগত পার্থক্য আছে। বাংলাদেশের একটা আলাদা কথনরীতি আছে। অনেকদিন ধরেই এটা তৈরি হয়েছে। দেবেশ রায় এটাকে সমর্থনও করেছেন। কিন্তু দুই বাংলার প্রমিত ভাষা একই। ভাষাবিদরা সূক্ষ্ম পার্থক্য বুঝতে পারেন। কবিতার ক্ষেত্রে সেই পার্থক্য বোঝা যায় না।"
সিলেটের ভাষা বিতর্ক
অমিত মালবীয় তার বার্তায় আসামের সিলেটের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। তার বক্তব্য, "বাংলাদেশের সরকারি ভাষা শুধু শুনতেই আলাদা নয়, এর মধ্যে সিলেটি ডায়ালেক্ট রয়েছে যা ভারতীয় বাঙালিদের কাছে দুর্বোধ্য।"
লোকসভায় কংগ্রেসের ডেপুটি লিডার গৌরব গগৈ সমাজ মাধ্যমে বলেছেন, "বিজেপির আইটি সেল ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং আসামের বরাক উপত্যকার লক্ষ লক্ষ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা ভাষাকে এই অপমান করছে। প্রথমে বিজেপি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) মাধ্যমে বাঙালিদের বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। আর এখন তাদের ভাষাকে বিদেশি বলে অপমান করছে। বিজেপি একতাবদ্ধ ভারত চায় না। তারা শুধু পুরনো ক্ষতকে আবার উসকে দিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করতে চায়।"
তৃণমূল নেত্রী সুস্মিতা দেব বলেন, "বরাকের জেলায় আমরা আজ থেকে না, শত শত বছর ধরে সিলেটি ভাষায় কথা বলছি। শুধু বরাকে নয় বরাকের বাইরে, বাংলাতেও অনেক মানুষ আছেন যারা সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। অমিত মালবীয়কে বলছি যে আপনারা যখন একটা অঞ্চলের ইতিহাস জানেন না, তখন এই মন্তব্য কেন করছেন? এটা সিলেটি ভাষার অপমান।"
সাবেক বিজেপি সাংসদ রাজদীপ রায় বলেন, "সিলেটি ভাষা বাংলাদেশের আধুনিক রাষ্ট্র বা এমনকী পূর্ব পাকিস্তানের চেয়েও অনেক প্রাচীন। এটি আজকের রাজনৈতিক সীমানা ও ইতিহাসের ঊর্ধ্বে। একে শুধুমাত্র একটি "বাংলাদেশি উপভাষা" বলে চিহ্নিত করা, যেটা নাকি ভারতীয় বাঙালিদের কাছে অপরিচিত— এটি শুধু ভুল নয়, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ও নিন্দনীয়।"
তিনি বলেন, "উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক উপত্যকা, মেঘালয়ের কিছু অংশ ও ত্রিপুরা মিলিয়ে প্রায় ৭০ লক্ষ মানুষ সিলেটি ভাষায় কথা বলেন। তারা গর্বিত ভারতীয় এবং বাঙালি। তাদের ভাষাকে "বিদেশি" বা "অবাঙালি" বলে খারিজ করে দেওয়া মানে বিভাজনের ক্ষতবিক্ষত ইতিহাসকে আরও তীব্র করা।"