1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলা ব্যান্ড সংগীতের পথচলা

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল হক আজম৷ সবাই চেনেন আজম খান নামে৷ বাংলাদেশের পপ সম্রাট৷ তাঁর সেই পপসংগীত থেকেই একটু একটু করে হয়েছে ব্যান্ড সংগীত৷ এখন বাংলাদেশে অন্তত ৩০টি ব্যান্ড দল সক্রিয়৷

Bangladeshi Band Music
ছবি: bdnews24

আজম খান স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে গড়ে তুলেছিলেন ‘উচ্চারণ' নামে একটি ব্যান্ড দল৷ যতদূর জানা যায়, স্বাধীন বাংলাদেশে সেটাই প্রথম ব্যান্ড মিউজিকের গ্রুপ৷ এরপর যাঁর নাম শোনা যায়, তিনি ফিরোজ সাঁই৷ ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদের নামও রাখা যায় একই সারিতে৷

আজম খান তাঁর ব্যান্ড ‘উচ্চারণ'-এর মাধ্যমে গেয়েছেন ‘সালেকা মালেকা', ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে', ‘আসি আসি বলে তুমি আর এলে না', ‘আলাল ও দুলাল', ‘অভিমানী, ‘মুক্তিসেনা আমি'-র মতো গান৷ আর এইসব গান সাধারণ মানুষকে সংগীত নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে৷ তাঁদের কৌতূহলী করেছে৷

এরপর ‘মাইলস' আর ‘সোলস' নামের দু'টি গ্রুপ অনেকদিন রাজত্ব করে৷ সাফিন আহমেদ আর তপন চৌধুরী বাংলা ব্যান্ডে যোগ করেন নতুন এক ধারা৷ আরো যোগ হয় ফিডব্যাক, ফিলিংস, নগর বাউল, রেনেসাঁ৷ ব্যান্ড সংগীতের  লিজেন্ড আইয়ূব বাচ্চুর ‘এলআরবি' আর জেমস-এর ‘নগর বাউল' বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতকে নতুন উচ্চতা দেয়৷

এরাই সাধারণের মাঝে নিয়ে যায় বাংলা ব্যান্ড মিউজিককে৷ খোলা মাঠে, এমনকি রাস্তার পাশে তাঁদের ব্যান্ডের গান, সেটা মেটাল আর হেভি মেটাল যা-ই হোকনা কেন, তরুণদের আকর্ষণ করে ব্যাপকভাবে৷ আর ‘ওয়েভস' নামে একটি গ্রুপ বাংলাদেশে হেভি মেটালের যাত্রা শুরু করে৷ হেভি মেটালের এই গ্রুপটি প্রবাসে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে চর্চা শুরু করেছিল৷ কিন্তু বাংলাদেশে হেভি মেটাল শেষ পর্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়নি৷

ছবি: bdnews24

এরপর ডিফরেন্ট টাচ, উইনিং, নোভা , এলআরবি, আর্ক, পেন্টাগন, পেপার রাইম, লিজেন্ড, সুইট ভেনম, অবস্কিউর ব্যান্ড সংগীতকে আরো এগিয়ে নিয়ে যায়৷

এদিকে বাপ্পা মজুমদার এবং সঞ্জীব চৌধুরি মিলে অন্য ধরনের ব্যান্ড ‘দলছুট' সৃষ্টি করেন৷ ৭০-এর দশকের ফিডব্যাক ছেড়ে মাকসুদ উল হক তৈরি করেন তাঁর ব্যান্ড ‘মাকসুদ ও ঢাকা'৷ আজকের ব্যান্ড  ‘শিরোনামহীন' , ‘ভাইকিংস', ‘দ্য ট্র্যাপ' একদিনে গড়ে ওঠেনি৷ সুমন ‘ওয়ারফেজ' ছেড়ে তৈরি করলেন এই সময়ের অন্যতম সফল ব্যান্ড ‘অর্থহীন'৷

তবে ব্যান্ড সংগীত নিয়ে একটা নেতিবিাচক প্রচারণা সব সময়ই ছিল৷ এখনো আাছে৷ অভিযোগ আছে, এটা পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ৷ খ্যাতিমান ব্যান্ড সংগীত শিল্পী মাকসুদ উল হক, যিনি ‘ম্যাক হক' নামেও পরিচিত, তাঁর মতে, ‘‘বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত নানা ধরনের সমালোচনার মুখেই এগিয়ে গেছে৷ সবকিছুই পরিবর্তন হয়৷ তেমনি শব্দের মানচিত্রও পাল্টায়৷ প্রচলিত শব্দের ধরনও পাল্টায়৷ তাই হেভি মিউজিকে হয়তো কেউ অনভ্যস্ত৷ তাই সমালোচনাও আসে৷ কিন্তু সারবিশ্বে সংগীতে যে পরিবর্তন আসছে, আমাদের তরুনরা সেই পরিবর্তনকে দেখবে না, ধারণ করবে না, তা তো হয় না৷’’ ডয়চে ভেলেকে বলছিলেন তিনি৷

‘‘আমাদের ব্যান্ড সংগীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে৷ অনেক ইমপ্রুভ করেছে৷ তার নিজস্ব আইডেন্টিটি তৈরি হয়েছে৷ এখন এর দর্শক শ্রোতা বেড়েছে৷ পৃষ্ঠপোষক বেড়েছে৷ কর্পোরেট, নন-কর্পোরেট সমর্থন বেড়েছে৷ সরকারও সমর্থন দিচ্ছে৷ এই যে প্রতিবছর ‘জয় বাংলা' কনসার্ট হয়, এটা তারই প্রমাণ৷''

‘‘আমরা আযম খানের অনুসারী হিসেবে ৭০-এর দশকে ব্যান্ড সংগীত শুরু করি৷ আর সেই ধারা কিন্তু অনেক গ্লোরিফায়েড, অনেক উজ্জ্বল৷ এপর এগিয়ে গেছে৷ নানা  ঘরানার ব্যান্ড এখন হচ্ছে৷ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে৷ তরুণরা এখন আরো অনেক ভালো করছে৷ আসলে আমরা যদি আমাদের শ্রবণমানকে আরো বিস্তৃত করি, বিশ্বায়নের এই যুগে চোখ-কান আরেকটু খোলা রাখি, তাহলে ব্যান্ড সংগীত আমাদের বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়৷'' বলেন মাকসুদ৷

‘‘আমাদের তরুনরা কিন্তু তাদের ব্যান্ড নিয়ে অ্যামেরকিা, ক্যানাডা , অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে৷ আর আমাদের সময় একমাত্র আইয়ুব বাচ্চু একমাত্র ফুল টাইম ব্যান্ড মিউজিক করতেন৷ তিনি এটাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছিলেন৷ কিন্তু এখন অনেকেই ব্যান্ড মিউজিককে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন৷ দেশের ভেতরে এর বাজার বাড়ছে৷ চাহিদা বাড়ছে৷''

বলা যায়, বাংলাদেশে এখন ব্যান্ড সংগীতের এক নতুন যুগ শুরু হয়েছে৷ শিরোনামহীন, ব্ল্যাক, জলের গান, অর্থহীন, ক্রিপটেইক ফেইট, চিরকুট, লালন, নেমেসিস, শহরতলী, রিকল, শূণ্য-র মতো ব্যান্ডগুলোর কাজ নজর কাড়ছে৷

‘এখন অনেকেই ব্যান্ড মিউজিককে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন’

This browser does not support the audio element.

চিরকুট-এর শারমিন সুলতানা সুমি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নব্বই-এর দশককে বাংলা ব্যান্ড মিউজিকের স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ ফিডব্যাক, নগর বাউল, এলআরবি, ওয়ারফেজ, রেনেসাঁ, মাইলস এ রকম অসাধারণ সব গ্রুপের জন্ম হয়েছিল৷ তাঁরা বাংলা ব্যান্ডের ট্রেন্ড সেট করেন৷ গান যে শুধু প্রেম, ভালোবাসা নিয়ে কথা বলবে, তা নয়৷ মানুষের জীবন নিয়ে কথা বলবে৷ জীবনের সব বিষয় নিয়েই যে গান হতে পারে, তা তাঁরা তখন প্রতিষ্ঠা করেন৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়ান, সংগ্রাম করেই ব্যান্ড মিউজিক মানুষের সামনে নিয়ে এলেন৷ নব্বই-এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তাঁদের দেখানো পথে ব্যান্ড মিউজিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়৷ কিন্তু পরে কিছু সময়ের জন্য ভাটার টান লক্ষ্য করা যায়৷ তবে এখন আবার ব্যান্ড-এর পাওয়ার বা জোয়ার যা-ই বলি, তা আবার ফিরে এসেছে৷ আমরা যারা এখন ব্যান্ডের গান করছি, শিরোনামহীন, দলছুট, শূন্য, লালন আর আমরা করছি চিরকুট৷''

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশে এখন একটি সাধারণ কনসার্টে ৪০ হাজার লোক হয়৷ আর বড় কনসার্টে দুই লাখ, তিন লাখ লোক হয়৷ এটা অনেক বড় একটি বিষয়৷ ব্যান্ড সংগীত তারুণ্যকে এক করে৷ ঐক্যবদ্ধ রাখে৷ আর এই ঐক্যই আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন৷''

সুমি সংগীতের মধ্যে কোনো বিভাজন রেখা টানার বিপক্ষে৷ তাই তিনি বলেন, ‘‘আমরা তো আসলে গ্লোবাল সিটিজেন৷ আমাদের দেশে মিউজিকে যে যন্ত্র ব্যবহার হয়, তার সব আমাদের না৷ আর এত বেশি ভাগ করলে পরে আর কাজটা করা হয় না৷ আমার কথা, আমার ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে আমি যে মেসেজটা দিতে চাই, সেটা গুরুত্বপূর্ণ৷ আমরা আমাদের ভাষা এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করেই সেটা করি৷ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণ নয়, আমাদের নিজস্বতা আছে৷ বাংলা ব্যান্ড মিউজিক এরইমধ্যে তার জায়গা করে নিয়েছে৷ জায়গা করে নিয়েছে নিজস্বতা ও যোগ্যতায়৷''

ব্যান্ড মিউজিকে বিদেশি ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার আর বিদেশি ঢংয়ের সুরের অভিযোগ করেন কেউ কেউ৷ এর জবাবে সুমি বলেন, ‘‘আমাদের দল চিরকুট৷ আমরা ওয়েস্টার্ন ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহার করি৷ কিন্তু এর সঙ্গে আমাদের ম্যান্ডোলিন, বেঞ্জো, হারমোনিয়ামও ব্যবহার করি৷ আর সুরটি কিন্তু বাংলাদেশেরই৷ আমরা তো শুধু দেশের মধ্যেই কাজ করি না৷ আমরা দেশের বাইরেও কাজ করি৷ আমরা বিদেশে দেশকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যভাবেই নিয়ে যাই৷ আমরা সব সময় আমাদের সংস্কৃতি, সুরকেই নিয়ে যাই৷ আমরা কখনোই অন্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলি না৷ আমাদের নিজস্বতা না থাকলে অন্যরা বাংলাদেশকে চিনবে কিভাবে?''

‘আমাদের নিজস্বতা না থাকলে অন্যরা বাংলাদেশকে চিনবে কিভাবে?’

This browser does not support the audio element.

তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত এখন বিশ্বমানের৷ আর বাংলাদেশে এটাকে পেশা হিসেবেও নেয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে৷ সুমি বলেন, ‘‘এখন অনেকেই যাচ্ছেন দেশের বাইরে শো করতে৷ আগে বাঙালি কমিউনিটির মধ্যেই শো হতো৷ গত সাত বছর ধরে ইন্টারন্যাশনালি অনেক শো করছি আমরা৷ ২০১৬-তে আমরা ইউএসএর সবচেয়ে বড় শো-তে ২১শ' ব্যান্ডের মধ্যে পারফর্ম করেছি৷ আমরা ভারত, শ্রীলঙ্কা, নরওয়েতে ইন্টারন্যাশনাল শো করেছি৷ আমরা শুধু না, অনেকেই করেছেন৷ আমাদের মিউজিক অনেক স্ট্রং এটা আমরা ইন্টারন্যাশনাল শো-তে  প্রমাণ করছি৷''

‘‘ একটা ধারণা ছিল এন্টারটেইনমেন্ট মানে ফ্রি, মিউজিক মানে ফ্রি৷ বাংলাদেশের মার্কেট ছোট৷ তারপরও এখন আমরা এই ধারণা থেকে বের হয়ে আসছি৷ এখনো সারভাইব করা কঠিন, তারপরও ব্যান্ড মিউজিককে পেশা হিসেবে নেয়া শুরু হয়েছে৷ আর এর জন্য দরকার কোয়ালিটি অব ওয়ার্ক৷ আমাদের ব্যান্ডের বয়স ১৫ বছর৷ আমি আগে চাকরি করতাম৷ গত ছয় বছর ধরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যান্ডের ওপরই নির্ভর করছি৷'' জানালেন সুমি৷

বাংলাদেশে নারীদের আলাদা ব্যান্ডের প্রচেষ্টা হয়েছে, তবে তা সফল হয়নি৷ নারীদের নিয়ে ব্যান্ড তৈরির প্রসঙ্গে সুমি বলেন, ‘‘আমাদের ব্যান্ডে তো আমিই একমাত্র নারী আর সবাই পুরুষ৷ আমি অবশ্য নিজেকে নারী বা পুরুষ হিসেবে দেখি না৷ আমি একজন ব্যান্ড সংগীত শিল্পী৷''

বাংলা ব্যান্ড সংগীতের সংগ্রাম বাংলাদেশের সমান বয়সি৷ ব্যান্ড সংগীতের যাত্রা হয়তো কখনো ম্রিয়মান ছিল৷ কিন্তু থেমে থাকেনি কখনো৷ অনেক সমালোচনা আর অবহেলাকে সাথে করে তারা এগিয়ে গেছে৷ সেই গুরু আজম খান থেকে শুরু করে অনেক শিল্পী আর সংগঠকের অবিরাম চেষ্টা এবং সাধনায় বাংলা ব্যান্ড মিউজিক বাংলা গানের এক উজ্জ্বল ধারা হয়ে উঠেছে৷

বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত নিয়ে আপনার ভাবনা লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ