বাংলা মাধ্যম স্কুলের হাল কি ফিরবে
২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান৷ এই আপ্তবাক্য একুশ শতকের কলকাতায় কতটা সত্যি, তা শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দিলে বোঝা যাবে৷ ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পর ইংরেজির গুরুত্ব বেড়েছে৷ বহুজাতিক সংস্থার দপ্তর খুলেছে এ দেশে৷ এর ফলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার ঝোঁক বেড়েছে৷ বেসরকারি মালিকানাধীন ইংরেজি স্কুল ফুলে ফেঁপে উঠেছে৷ এর পাশে বাংলা মাধ্যম স্কুল ক্রমশ রুগ্ন হয়ে পড়েছে৷ পঠনপাঠনের মাধ্যমই যখন বদলে যাচ্ছে, তখন বাংলা ভাষা জমি হারাচ্ছে বাংলাতেই৷ অথচ বিশ্বে ২৬ কোটি মানুষের ভাষা বাংলা৷ এর মধ্যে ২২ কোটির প্রথম ভাষা৷ ভারতে হিন্দির পরই সংখ্যার নিরিখে বাংলা ভাষাভাষীদের স্থান।
এত মানুষের মুখের ভাষার সঙ্কট শুরু হচ্ছে একেবারে শিক্ষাঙ্গন থেকে৷ পশ্চিমবঙ্গের সরকার পোষিত বিদ্যালয় মূলত দুটি সমস্যায় ভুগছে৷ বিপুল সংখ্যায় শূন্যপদে শিক্ষক নিয়োগ না হওয়া এবং স্কুলে পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর অভাব৷ শিক্ষক আন্দোলনের কর্মী কিঙ্কর অধিকারী বলেন, " প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত রাজ্যের স্কুলে প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে৷ এর ফলে শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ছাত্র ও শিক্ষকের অনুপাত বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না৷ কেন্দ্রীয় আইন অনুযায়ী ৩৫-৪০ জন ছাত্রপিছু একজন করে শিক্ষক থাকার কথা৷ কিন্তু, রাজ্যের স্কুলে ৭0 জন ছাত্রের জন্য একজন শিক্ষক রয়েছেন৷ এর ফলে ছাত্রদের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারছেন না শিক্ষকরা৷''
কলকাতা ও জেলায় যেখানে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের সংখ্যা বেশি এবং আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন মানুষের বাস, সেখানে আবার ছবিটা আলাদা৷ সেই স্কুলগুলিতে ক্রমশ কমছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা৷ অনেক স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা এতটাই কম যে তা বন্ধ করার কথা ভাবছে শিক্ষা দপ্তর৷ এখানে শিক্ষকরা থাকলেও ছেলেমেয়েরা পড়তে আসছে না৷ অভিভাবকরা ছেলেমেয়েদের পাঠাচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে৷ লেকটাউনের বাসিন্দা বন্দনা সরকার বলেন, " সরকারি স্কুলে ঠিক মতো পড়াশোনা হয় না৷ সিলেবাসও আধুনিক নয়৷ তার থেকে বড় কথা, ইংরেজিতে ভালো না হলে ভবিষ্যতে কিছু করতে পারবে না৷" ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ইংরেজির প্রয়োজন শুধু স্কুল নয়, বাংলা ভাষাকে পিছনে ঠেলে দিচ্ছে৷
অভিভাবকের দাবিকে খারিজ করতে পারছেন না সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনার মথুরাপুরের উচ্চ বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা বলেন, " সত্যিই আমাদের পরিকাঠামোর অভাব৷ ইংলিশ মিডিয়ামে স্মার্ট ক্লাস হয়েছে, আর আমাদের এত ছেলেমেয়ে যে তাদের দিকে নজর দেওয়ার সুযোগ নেই৷" যদিও এখন শিক্ষকরা ভালো অঙ্কের বেতন পাচ্ছেন, অন্যান্য পেশার থেকে অনেক বেশি ছুটিও পাচ্ছেন৷ অথচ সরকারি স্কুল কোন মানে পৌঁছতে পারে, সেই পথ দেখিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল৷ শিক্ষামন্ত্রী মণীশ সিসোদিয়ার পরিকল্পনায় স্কুলে চালু হয়েছে " হ্যাপিনেস ক্লাস'' ৷ খুশির ক্লাস-এ ছেলেমেয়েরা ধ্যান করছে, নীতি শিক্ষার গল্প শুনছে৷ তারপর পড়ছে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান৷ এর ফলে জনপ্রিয়তায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পিছনে ফেলছে সরকারি স্কুল৷
পশ্চিমবঙ্গে কি এই পরিবর্তন সম্ভব নয়? তাহলে মুনাফানির্ভর বেসরকারি স্কুলের রমরমা কমে, একইসঙ্গে মাতৃভাষায় পঠনপাঠনের গুরুত্ব বাড়ে৷ কিঙ্করের বক্তব্য, " স্কুল ও পড়ুয়া সংখ্যার বিচারে দিল্লির সঙ্গে আমাদের তুলনা করা যায় না৷ তবে আর্থিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে আমরা ১০ শতাংশ স্কুলে খুশির ক্লাস শুরু করতে পারি৷ সেটা মডেল হয়ে উঠবে৷ দিল্লির মতো এখানেও অভিভাবকরা সরকারি স্কুল নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠবেন৷" আপাতত বেসরকারি ও সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান পরিচালিত কনভেন্ট স্কুলের দাপট বাড়ছে৷ পাড়ায় পাড়ায় গজিয়ে উঠেছে নার্সারি স্কুল৷ সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের জন্য প্রাইভেট টিউশনের রমরমা বেড়েছে৷ স্কুলের শিক্ষকরা তাঁর ক্লাসের ছাত্রদেরই স্কুলের বাইরে অর্থের বিনিময়ে পড়াচ্ছেন!
শিক্ষার এই তথৈবচ অবস্থার মধ্যে ভাষা কোথায় দাঁড়িয়ে? সেই ছবিটাও আশাব্যঞ্জক নয়৷ সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা জয়শ্রী দেবনাথের বক্তব্য, "বাংলার প্রতি দরদ কমেছে ছেলেমেয়েদের৷ ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাঙালি ছেলেমেয়েরা চেতন ভগতের লেখা পড়ছে, কিন্তু বাংলা ক্লাসিক পড়ছে না৷ এতে ওদেরই ক্ষতি হচ্ছে৷''