বাউলশিল্পীদের উপর হামলা, আবুল সরকারের মুক্তি দাবি
২৩ নভেম্বর ২০২৫
মানিকগঞ্জে রোববার ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা' ব্যানারে থাকা একদল ব্যক্তি এবং গ্রেপ্তার আবুল সরকারের ভক্ত-অনুরাগীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ঘিরে এই হামলার ঘটনা ঘটে৷ এতে বাউল আবুল সরকারের তিন অনুসারীসহ মোট চার জন আহত হয়েছেন৷
বাউলশিল্পী আবুল সরকারের সহকারি বাউলশিল্পী রাজু সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচি ছিল৷ এটা দেখেই তারা আমাদের কর্মসূচির সময় কর্মসূচি দিয়েছে৷ তারপরও আমরা কিন্তু আমাদের কর্মসূচি দুই ঘন্টা পিছিয়ে ১১টায় নিয়েছিলাম৷ তারপরও তারা আমাদের উপর হামলা চালিয়েছে৷ আমরা শান্তি চাই, হানাহানি নয়৷ আমরা আবুল সরকারের মুক্তি চাই৷ কারও সঙ্গে আমরা বিবাদে জড়াতে চাই না৷''
বাউলশিল্পীআবুল সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী মানিকগঞ্জের ঘিওর বন্দর মসজিদের ইমাম মুফতি মো. আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের কর্মসূচি ছিল পূর্বঘোষিত৷ বরং তারা অল্প কয়েকজন লোক নিয়ে এসে বিশৃঙ্খলা করার চেষ্টা করেছে৷ আমরা বাধা না দিলে অনেক বেশি মানুষ আহত হতেন৷ আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছি৷
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
গত ৪ নভেম্বর মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার জাবরা এলাকায় খালা পাগলীর মেলায় পালাগানের আসরে যাত্রাপালা হয়৷ সেখানে বাউলশিল্পী আবুল সরকার যাত্রাপালার মধ্যেমৌলবাদ নিয়ে কথা বলেন৷ মাজার ভাঙা নিয়েও কথা বলেন৷ বিষয়টি নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হয়৷ এর পরিপ্রেক্ষিতে গত বুধবার রাতে মাদারীপুরে একটি গানের আসর থেকে আবুল সরকারকে আটক করে মানিকগঞ্জ ডিবি পুলিশের একটি দল৷
শুক্রবার সকালে তাকে জেলা ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়৷ ওইদিন দুপুরে ধর্ম নিয়ে তার মন্তব্যের প্রতিবাদে ঘিওর বন্দর মসজিদের ইমাম মুফতি মো. আবদুল্লাহসহ পাঁচ জন একটি মামলা দায়ের করেন৷ মামলায় তারা উল্লেখ করেছেন, ইসলাম ও মহান আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন আবুল সরকার৷
ওই মামলায় আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে সন্ধ্যায় মানিকগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নেওয়া হয়৷ বাউলশিল্পী আবুল সরকারের কঠোর শাস্তির দাবিতে ওইদিন মানিকগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত প্রাঙ্গণে ‘আলেম-ওলামা ও তৌহিদি জনতা'র ব্যানারে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়৷ এ সময় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস মানিকগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি মুফতি আবদুল্লাহ আল ফিরোজসহ কয়েকজন বক্তব্য দেন৷
আবুল সরকারের সহকারি শিল্পী রাজু সরকার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আবুল সরকারের পালাগানের পুরো বক্তব্য প্রচার না করে একটি গোষ্ঠী তার বক্তব্য আংশিকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করে পরিবেশ ঘোলাটে করছেন৷ মহান আল্লাহ পাকের তিনটি সৃষ্টির মধ্যে কোনটি আগে করা হয়েছে, প্রতিপক্ষ বাউলশিল্পীকে এমন প্রশ্ন করেছিলেন আবুল সরকার৷ মহান আল্লাহকে নিয়ে কটূক্তি করেননি৷ ওই অনুষ্ঠানে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন৷ ওই গোষ্ঠী ক্ষিপ্ত হয়ে আবুল সরকারের পালাগানের মন্তব্যের ভিডিওর খণ্ডিত অংশ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছে৷ তারা বিশৃঙ্খলা করে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে৷''
পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও হামলা
রোববার সকালে জেলা শহরে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা' ব্যানারে থাকা একদল ব্যক্তি৷ একই সময়ে আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধনের আয়োজন করেন তার ভক্তরা৷ সকাল ১০টার দিকে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা' ব্যানারে একদল ব্যক্তি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন৷ তারা শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে জেলার প্রধান ডাকঘর কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করেন৷
অন্যদিকে, মানিকগঞ্জ প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে আবুল সরকারের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচির আয়োজন করেন তার ভক্ত-অনুরাগীরা৷ কিন্তু অন্য পক্ষের মিছিলের কারণে তারা প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে কর্মসূচি পালন না করে দক্ষিণ সেওতা এলাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দক্ষিণ পাশে জড়ো হন৷
অন্য পক্ষের সমাবেশস্থল থেকে প্রায় ৫০০ থেকে ৬০০ গজ দূরে শহীদ মিনারের অবস্থান৷ সেখানে আবুল সরকারের ভক্ত-অনুসারীদের অবস্থানকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে৷ একপর্যায়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে ‘মানিকগঞ্জ জেলার সর্বস্তরের আলেম-ওলামা ও তৌহিদী জনতা' ব্যানারে থাকা ব্যক্তিদের হামলায় আবুল সরকারের তিন ভক্ত-অনুরাগী আহত হন৷
আহত ভক্তরা হলেন জেলার শিবালয়ের শাকরাইল গ্রামের আবদুল আলীম (২৫), সিঙ্গাইরের তালেবপুর গ্রামের আরিফুল ইসলাম (২৯) ও হরিরামপুরের কামারঘোনা গ্রামের জহিরুল ইসলাম (৩২)৷ আহত অন্যজন হলেন সদর উপজেলার বরঙ্গাখোলা গ্রামের আবদুল আলীম (২৭)৷
ঘিওর বন্দর মসজিদের ইমাম মুফতি মো. আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘তারাও আমাদের উপর হামলা করেছে৷ এতে মাওলানা আব্দুল আলীম নামের এক মাদরাসা শিক্ষকসহ দুইজন গুরুতর আহত হয়েছেন৷''
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস্) আবদুল্লাহ আল মামুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে ‘‘তৌহিদী জনতার একটি অংশ আবুল সরকারের সমর্থকদের ওপর চড়াও হন৷ একপর্যায়ে তিন-চারজন আহত হন৷ মাওলানা আব্দুল আলীম নামে মাদরাসা শিক্ষক আহত হওয়ার যে খবর ছড়িয়ে পড়েছে সেটা ঠিক নয়৷ উনি আসলে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে গিয়ে মাথাঘুরে পড়েছিলেন৷ তাকে কেউ আঘাত করেনি৷ পরে তিনি সুস্থ্য হয়েছেন৷ পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে৷ পরিস্থিতি এখন শান্ত ও স্বাভাবিক আছে৷''
আবুল সরকারের মুক্তি দাবি ও হামলার নিন্দা
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সরকারের প্রছন্ন মদদ ছাড়া এই ধরনের হামলা সম্ভব না৷ আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের শুরু থেকেই এক ধরনের মব ছড়িয়ে বাউলশিল্পী ও মাজারের উপর হামলা করা হচ্ছে৷ কিন্তু সরকার এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ আমরা দাবি জানাই, দ্রুত এই ধরনের মব সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে৷ পাশাপাশি গ্রেপ্তার হওয়া আবুল সরকারসহ এই ধরনের ঘটনায় গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি দিতে হবে৷''
নারী অধিকার কর্মী খুশি কবীর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর যে ধরনের আঘাত হানা হচ্ছে, সেটা প্রতিহত করার দায়িত্ব সরকারের৷ কিন্তু আমরা সরকারকে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখছি না৷ দ্রুত আবুল সরকারের মুক্তিসহ এই ধরনের কর্মকাণ্ড যারা ঘটাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাই৷''
অবিলম্বে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করেছে বাংলাদেশ লেখক শিবির৷ সংগঠনটির সভাপতি কাজী ইকবাল ও সাধারণ সম্পাদক শফি রহমান স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে এ দাবি জানানো হয়েছে৷ এতে বলা হয়, ‘‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে খেয়াল করছি, বিগত আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আমলে যেভাবে এ দেশে ভিন্নমতের ওপরে দমন-পীড়ন চলছিল, এখনো সেই ধারা ভিন্নভাবে জারি রাখা হচ্ছে৷ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে নির্যাতন জারি রেখেছিল৷ সেই জায়গা দখল করার চেষ্টা করছে এখনকার তথাকথিত আলেম সমাজ ও তৌহিদী জনতা নামধারী রাজনৈতিক ধুরন্ধররা৷''
এর আগে বাউলশিল্পী আবুল সরকারের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ‘সম্প্রীতি যাত্রা'-র উদ্যোগে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে৷ শুক্রবার বিকেল চারটার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে এই মানববন্ধন হয়৷ এতে বিভিন্ন বাউল–সুফি সংগঠন, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সামাজিক সংগঠন ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন৷ অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল, ‘আবুল সরকারের মুক্তি চাই', ‘গান, জ্ঞান ও ভক্তির নিরাপত্তা চাই', ‘মাজার দরবার রক্ষা করো', ‘পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে' -এমন বক্তব্য সম্বলিত পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড৷
মানববন্ধনে বাংলাদেশ সুফি জাগরণ পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘এই দেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সুফি-বাউলেরা সব সময় অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন৷ পরিকল্পিতভাবে শিল্পী আবুল সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ অবিলম্বে তাকে মুক্তি না দিলে বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে৷''
বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার বলেন, ‘‘একদিন পৃথিবীটা বাউলের হবে৷ শিল্পীদের ওপর হামলা ও গ্রেপ্তার মানবাধিকার লঙ্ঘন- এটি মেনে নেওয়া হবে না৷''
প্রসঙ্গত, কারাগারে যাওয়া আবুল সরকার মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার তিল্লী ইউনিয়নের পারতিল্লী এলাকার বাসিন্দা৷ তিনি এলাকায় বাউলশিল্পী ছোট আবুল সরকার নামে পরিচিত৷