বাগেরহাটে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷ তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা এবং বিচার শুরুর জন্য শীঘ্রই ট্রাইব্যুনালে আবেদন জানানো হবে৷
বিজ্ঞাপন
অভিযুক্ত এই তিনজন হলেন শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার, আব্দুল লতিফ তালুকদার এবং খান আকরাম হোসেন৷ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ গত ১০ই জুন এই তিনজনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে৷
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের কচুয়ায়, সেখানকার থানা পুলিশ গত ১১ই জুন পলাতক আসামি আব্দুল লতিফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করে৷ গত ১৯শে জুন অপর পলাতক আসামি আকরাম হোসেন খাঁনকে রাজশাহী থেকে মোড়েলগঞ্জ থানা পুলিশ গ্রেপ্তারের পর ট্রাইব্যুনালে সোপর্দ করা হয়৷ সর্বশেষ দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর, গত ২১শে জুলাই রাতে বাগেরহাট মডেল থানা পুলিশ বাগেরহাট সদর উপজেলার ডেমা গ্রাম থেকে সিরাজ মাস্টারকে গ্রেপ্তার করে৷ গ্রেপ্তারের পর তাঁদের ট্রাইব্যুনালের ‘সেফহোম'-এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়৷ তাঁরা তিনজনই একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে কাজ করতেন৷ তাঁদের মধ্যে ‘বাগেরহাটের কসাই' বলে কুখ্যাত সিরাজ মাস্টার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন৷
সিরাজ মাস্টার এবং তাঁর দুই সহযোগী আব্দুল লতিফ তালুকদার ও আকরাম হোসেন খাঁন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাটের কচুয়ায় শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যা, ধর্ষণ ও ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ আটটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে মানবতাবিরোধী মামলার আসামি৷ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে কচুয়ার শাঁখারিকাঠি বাজারে গণহত্যার শিকার রঘুদত্তকাঠি গ্রামের শহিদ জিতেন্দ্রনাথ দাসের ছেলে নিমাই চন্দ্র দাস বাদী হয়ে ২০০৯ সালে কচুয়া থানায় এই তিনজনসহ ১২ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন৷ শাখারীকাঠি বাজারে একই দিনে ৪২ জনকে হত্যা করা হয়৷ এছাড়া রামপাল ও ডাকরায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও এই তিনজন জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ৷
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার তদন্ত দল দীর্ঘ তদন্ত শেষে তিনজনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে৷ সোমবার ধানমন্ডিতে স্থাপিত তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান জানান, এই তিন আসামির বিরুদ্ধে আটটি অভিযোগে তদন্ত কাজ সম্পন্ন হয়েছে৷ এর মধ্যে গণহত্যা, ধর্ষণ ও বাড়িতে অগ্নিসংযোসহ লুটতরাজের অভিযোগ আছে৷ ৯টি খণ্ডে মোট ৮৪৪ পৃষ্ঠার ‘ডকুমেন্ট' তৈরি করা হয়েছে৷ এছাড়া তাঁদের বিরুদ্ধে ৬৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণও করা হয়েছে৷ শিগগিরই এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রসিকিউশন বরাবর দাখিল করা হবে৷''
প্রসিকিউটর রানা দাসগুপ্ত ডয়চে ভেলেক বলেন, ‘‘তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই বাছাই করে দেখার পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হবে ট্রাইব্যুনালে৷ এরপ ট্রাইব্যুনাল অভিযোগ গ্রহণ করলে তাঁদের বিচার শুরু হবে৷''
উল্লেখ্য, সারা দেশে এ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ৫৭৭টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১১২, চট্টগ্রামে ৮৪, রাজশাহীতে ৬৬, খুলনায় ১৮৪, সিলেটে ৫০ এবং বরিশালে ৩০টি মামলা দায়ের করা হয়৷ এছাড়া ২০১০ সালের ২৫শে মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার পর এ পর্যন্ত মোট ৯টি মামলায় ১০ জনকে দণ্ড দেয়া হয়েছে৷
একাত্তরে ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসি বৃহস্পতিবার রাতে কার্যকর করা হয়েছে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলো৷ মোল্লার ফাঁসি নিয়ে তৈরি আমাদের বিশেষ ছবিঘর৷
ছবি: AP
অবশেষে ফাঁসি
৪৮ ঘণ্টা ধরে নানা নাটকীয় পরিস্থিতির পর ১২ ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার রাতে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হয়৷ এর আগে মঙ্গলবার রাতে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে বিচারকের নির্দেশে তা স্থগিত হয়৷ মোল্লাকে এভাবে ফাঁসি না দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, জার্মানি সহ অন্যান্যরা৷
ছবি: picture-alliance/AA
শেষ দেখা
বৃহস্পতিবার ফাঁসির রায় কার্যকরের কিছুক্ষণ আগে কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তার পরিবারের সদস্যরা৷ এসময় জেলগেটে কাদের মোল্লার ছেলে হাসান জামিল বলেন, ‘‘ইসলামী আন্দোলন করার কারণেই আমার পিতাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়া হয়েছে৷’’
ছবি: Reuters
গ্রেপ্তার, দম্ভোক্তি
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০০৮ সালে ঢাকার একটি থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১০ সালের জুলাইয়ে গ্রেপ্তার হন জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কাদের মোল্লা৷ পরবর্তীতে কারাগারে দাঁড়িয়ে তাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘বাংলাদেশ হয়েছে বলে অনেকের মাতব্বরি বেড়ে গেছে৷’’
ছবি: Reuters
যত অভিযোগ
কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মোট ৬টি অপরাধ বিবেচনায় নেয়া হয়৷ এগুলো হলো পল্লবি এলাকার গণহত্যা, কবি মেহেরুননিসা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা, সাংবাদিক খন্দকার আবু তালিব হত্যা, কেরানীগঞ্জের ভাটার চর ও ভাওয়াল খানবাড়ি হত্যাকাণ্ড, আলুব্দি গণহত্যা এবং মিরপুরের হযরত আলি পরিবারে গণহত্যা৷ এর সঙ্গে লুটতরাজ, ধর্ষণ এবং ধ্বংসযজ্ঞের অভিযোগও আছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: Archiv Rowshan Jahan Shathi
প্রথমে যাবজ্জীবন, পরে মৃত্যুদণ্ড
ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটিতে কাদের মোল্লার অপরাধ প্রমাণিত হয়৷ এর প্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে৷ সেসময় কাদের মোল্লা আদালত থেকে বের হওয়ার সময় ‘বিজয় চিহ্ন’ দেখান৷ এতে সারাদেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়৷ পরবর্তীতে আপিলের ভিত্তিতে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সর্বোচ্চ আদালত৷
ছবি: Strdel/AFP/Getty Images
দাফন সম্পন্ন
বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পর মাইক্রোবাসে করে কাদের মোল্লার মরদেহ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করা হয়৷ বাংলাদেশে ডয়চে ভেলের কন্টেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম লিখেছে, ‘‘স্থানীয় সময় রাত ৪টার দিকে ফরিদুপরের আমিরাবাদ গ্রামে লাশ পৌঁছানোর পর জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।’’
ছবি: Mustafiz Mamun
তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া
কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সৃষ্টি হওয়া শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চে আবারো ভিড় করেছেন অসংখ্য মানুষ৷ মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর সেখানে উপস্থিত জনতা উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে৷
ছবি: Reuters
‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো’’
গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার ডয়চে ভেলেকে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘‘জাতি আজ কলঙ্ক মুক্ত হলো৷ ৪২ বছর পরে হলেও একজন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর হলো৷’’ তিনি আশা করেন, সব যুদ্ধাপরাধীর দণ্ডই কার্যকর হবে৷
ছবি: privat
জার্মানির প্রতিক্রিয়া
এর আগে, বৃহস্পতিবার জার্মানির মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনার মার্কুস ল্যোনিং এক বিবৃতিতে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করতে বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন৷ তিনি বলেছিলেন, জার্মানি নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করে না৷ তাই ফাঁসির পরিবর্তে কারাদণ্ড দেবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: dapd
ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক
একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০১০ সালে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করে৷ তবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল বিএনপি মনে করে, সরকার বিরোধী দলকে দুর্বল করতে এই ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করেছে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই ট্রাইব্যুনাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে৷