এ কথা বলেছেন জার্মানি রাজধানী বার্লিনের লাইবনিৎস চিড়িযাখানা ও বন্যপ্রাণী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের আন্তর্জাতিক গবেষকরা৷ তাঁরা সকলেই চান, বাঘেদের উপপ্রজাতি বর্তমানের নয়টি থেকে কমিয়ে মাত্র দু'টি করা হোক৷
বিজ্ঞাপন
প্রস্তাবটা তাত্ত্বিক হলেও ব্যাঘ্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে তার প্রভাব হবে ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী, এই হলো বিজ্ঞানীদের আশা৷ তাঁরা চান ‘সুন্দা' টাইগার – অর্থাৎ ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা, জাভা ও বালি দ্বীপে যে ধরনের বাঘ পাওয়া যায় – আর কন্টিনেন্টাল টাইগার, মাত্র এই দু'টি স্বতন্ত্র উপপ্রজাতি বজায় রেখে বাকিগুলো (পুঁথিপত্র এবং হিসেব থেকে) তুলে দেওয়া হোক৷
গবেষণাটি করা হয় বার্লিনের লাইবনিৎস চিড়িয়াখানা ও বন্যপ্রাণী গবেষণা কেন্দ্রের তরফ থেকে৷ আন্তর্জাতিক গবেষকরা প্রকল্পটিতে অংশগ্রহণ করেন৷ গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয় মার্কিন ‘সায়েন্স অ্যাডভান্সেস' জার্নালে৷ গবেষকরা বাঘের ন'টি চলতি উপপ্রজাতি বিশ্লেষণ করেছেন: যার মধ্যে তিনটি উপপ্রজাতি ইতিমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে এবং চতুর্থ একটি উপপ্রজাতি শুধুমাত্র চিড়িয়াখানায় বেঁচে রয়েছে৷
প্রায় ২০০টি বাঘের মাথার খুলি, ১০০টির বেশি বাঘের চামড়া, এছাড়া রসায়ন ও পরিবেশগত নানান তথ্য বিচার করে গবেষকরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, ‘প্যানথেরা টাইগ্রিস সনডাইকা' এবং ‘প্যানথেরা টাইগ্রিস টাইগ্রিস' ছাড়া আর কোনো উপপ্রজাতিকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়োজন নেই৷ তার মধ্যে দ্বিতীয়, অর্থাৎ কন্টিনেন্টাল টাইগার উপপ্রজাতিটিকে দুটি ‘কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট ইউনিট' বা সংরক্ষণ সংক্রান্ত কর্মক্ষেত্রে ভাগ করা চলবে: যেমন উত্তরে সাইবেরিয়ার আমুর টাইগার ও দক্ষিণে রয়াল বেঙ্গল টাইগার৷
বিলুপ্তির পথে বাঘ
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীর উপর সবার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য পালন করা হয় এই দিবস৷ বর্তমানে গোটা বিশ্বের বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩,২০০টি৷ তাদের রক্ষায় কী করা হচ্ছে, জানুন এই ছবিঘর থেকে৷
ছবি: dapd
নাটকীয় হারে কমছে
২৯শে জুলাই আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস৷ মূলত বিশ্বের অন্যতম রাজকীয় এই প্রাণীটি রক্ষায় উদযাপন করা হচ্ছে এই দিবস৷ গত শতকে গোটা বিশ্বে বাঘের সংখ্যা ছিল এক লাখ৷ আর বর্তমানে জঙ্গলে বাঘের এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩,২০০তে৷ এভাবে কমতে থাকলে আগামী দশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে বাঘ৷
ছবি: AP
পৌরাণিক কাহিনিতে বাঘ
মানুষের কাছে অন্যতম সম্মানিত প্রাণী হিসেবে বাঘের কথা বিভিন্ন সংস্কৃতির পুরাণে রয়েছে৷ চীনের রাশিচক্রে উল্লিখিত ১২টি প্রাণীর একটি বাঘ৷ এই প্রাণীকে বনের রক্ষক এবং ক্ষমতা, শক্তি ও সৌন্দর্য্যের প্রতীক মনে করা হয়৷ চীনে পরবর্তী বাঘের বছর ২০২২ সাল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
উপপ্রজাতিগুলোও হুমকির মুখে
উনিশ শতক অবধি বাঘের নয়টি উপপ্রজাতির দেখা মিলেছিল গোটা বিশ্বে৷ বর্তমানে, ইন্দো-চায়না, মালয়, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং আমুর বাঘ বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে৷ আর সুমাত্রান এবং দক্ষিণ চীনের বাঘের অবস্থা আরো সঙ্গিন৷ বালি দ্বীপ, জাভা এবং কাস্পিয়ান অঞ্চলের বাঘ গত ৮০ বছরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে৷ বাঘের বিভিন্ন উপপ্রজাতির মধ্যে আকার, রং এবং লোমের আচ্ছাদনে পার্থক্য রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে
ঐতিহাসিকভাবে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, তুরস্ক, রাশিয়ার পূর্ব উপকূল, চীন এবং সার্বিয়া থেকে ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন দ্বীপপুঞ্জে ছড়িয়ে রয়েছে বাঘের আবাসভূমি৷ কিন্তু বর্তমানে বাঘের আবাসের ৯৭ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে৷ মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড – যেমন বাসস্থান সম্প্রসারণ, চাষাবাদ এবং রাস্তা নির্মাণের মতো কারণে বাঘের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে৷ থাকার জায়গার সংকটের কারণে সহজেই শিকারিদের ফাঁদে ধরা পড়ছে বাঘ৷
ছবি: AP
অবৈধ বাণিজ্য
গত এক হাজারেরও বেশি সময় ধরে চীন এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে প্রথাগত ঔষধ তৈরিতে বাঘের শরীরের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হচ্ছে৷ মূলত বাত এবং চর্ম রোগেই চিকিৎসায় এসব ব্যবহার করা হয়৷ ১৯৮৭ সাল থেকে অবশ্য বাঘের দেহের বিভিন্ন অংশ বিক্রি আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ৷ তবে এখনো কালোবাজারে বাঘের চাহিদা অনেক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খামারে বাঘ
জঙ্গলে খুব অল্প কিছু বাঘ টিকে থাকলেও বিভিন্ন খামার এবং চীন ও এশিয়ার বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বর্তমানে বন্দি আছে পাঁচ হাজারের মতো বাঘ৷ পরিবেশ বিষয়ক অনুসন্ধানী এজেন্সি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছে, খামারে পালন করা বাঘের চামড়া এবং হাড় ব্যবহার করে বিলাসী আসবাব এবং ওয়াইন তৈরি করা হয়৷ এ কারণে জঙ্গলে মুক্ত পরিবেশে থাকা বাঘও শিকার করা হচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বিনোদনে বাঘ
সেই সতেরো শতক থেকে সার্কাসে ব্যবহার হচ্ছে বাঘ৷ প্রাণিবাদিরা সার্কাসে বাঘের এ ধরনের ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন৷ বিশেষ করে বাঘকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পদ্ধতি, ক্রমাগত ভ্রমণ এবং অপ্রাকৃতিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা৷ ব্রিটিশ সরকার বিষয়টি আমলে নিয়ে সার্কাসে বনের প্রাণী ব্যবহারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপের চিন্তা করছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মানুষের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ভূমি দখল নিয়ে বাঘ এবং মানুষের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জঙ্গলের বাঘ আরো হুমকির মুখে পড়ছে৷ জঙ্গলের পরিধি কমায় খাদ্যের সন্ধানে বাঘ লোকালয়ে হাজির হচ্ছে, হামলা চালাচ্ছে বিভিন্ন গবাদি পশুর উপর৷ ছবিতে একটি বাঘিনীর মরদেহ পরীক্ষা করছেন ভারতের বন কর্মকর্তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংরক্ষণের প্রচেষ্টা
২০১০ সালের নভেম্বরে রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলনে বাঘ আছে বাংলাদেশ সহ এমন ১৩টি দেশ ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করে৷ এজন্য বাঘ শিকার বন্ধ এবং বাঘের আবাসস্থল সংরক্ষণ ও উন্নয়নের দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ ছবিতে শুল্ক বিভাগের হাতে আটক বাঘের চামড়া দেখানো হচ্ছে৷
ছবি: AP
চিড়িয়াখানায় অথবা জঙ্গলে, নাকি দু’টোতেই?
এমনকি স্বনামধন্য চিড়িয়াখানাতেও বাঘের প্রজনন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে মতভেদ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে৷ এক্ষেত্রে চিড়িয়াখানাগুলোর মন্তব্য হচ্ছে, তারা গবেষণা এবং জীনগতভাবে বৈচিত্র্যময় বাঘের বংশ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে৷ তবে ‘‘বর্ন ফ্রি’’ এর মতো সংগঠনগুলো চায়, বাঘ রক্ষায় জঙ্গলেই আরো উদ্যোগ নেওয়া হোক৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
এশিয়ার জঙ্গলগুলোতে আজ মাত্র ৩,২০০ থেকে ৩,৬০০ বাঘ বেঁচে রয়েছে, বলে বিজ্ঞানীদের অনুমান৷ বাঘেদের আদত হ্যাবিট্যাট বা বাসস্থান কমে মাত্র সাত শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ এমন অবস্থায় ব্যাঘ্র সংরক্ষণের ক্ষেত্রে নানা ধরনের উপপ্রজাতির উপর নজর রাখতে গেলে কাজের ক্ষতি হবে, বলে বার্লিনের গবেষকদের ধারণা৷ তাঁরা চান, বিভিন্ন দেশের টাইগার পপুলেশন বা ব্যাঘ্র গোষ্ঠীকে এক করে দেখা হোক, এমনকি ‘হাইব্রিড' বা মিশ্র উপপ্রজাতির বাঘেও তাঁদের আপত্তি নেই – যেহেতু তাতে ‘জিন পুল' বা বংশগত সংমিশ্রণ বাড়বে৷ এক্ষেত্রে মুখ্য গবেষক টোমাস ভিল্টিং দক্ষিণ চীন তথা ইন্দোচীনের প্রায় অবলুপ্ত ব্যাঘ্র গোষ্ঠীগুলির উদাহরণ দিলেন: মালয় এবং বেঙ্গলের ‘‘সাদার্ন কন্টিনেন্টাল'' টাইগারদের সঙ্গে তাদের যোগ করলে সংরক্ষণের কাজ অনেক সহজ হবে, বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা৷
টাইগার কনজারভেশন বা ব্যাঘ্র সংরক্ষণের কাজও সর্বত্র একহারে এগোচ্ছে না৷ নেপাল, ভারত অথবা রাশিয়ার মতো দেশে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে – যেমন ভারতে বিগত তিন বছরে বাঘের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়ে ২০১৪ সালের শেষে দাঁড়িয়েছে ২,২২৬-এ৷ অপরদিকে ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়ার মতো দেশে বাঘেদের আদমশুমারি পর্যন্ত করা হয় না৷ কাম্বোডিয়া, লাওস ও ভিয়েতনাম-এ বাঘেরা প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়েছে৷ অপরদিকে থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারে স্বল্প মেয়াদে বাঘের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব৷