গত এক সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ২৬০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে৷ শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে মিয়ানমার সরকার৷ গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এই সহিংসতায় এখন পর্যন্ত চারশ'রও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর জানিয়েছে, গত এক সপ্তাহে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে ৫৮ হাজার রোহিঙ্গা৷ মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের অভিযোগ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা এআরএসএ রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে৷ তবে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা বলছেন, সেখানকার সেনাবাহিনী তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতেই বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে, নির্বাচরে হত্যা করছে রোহিঙ্গাদের৷ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, ‘‘তিনটি গ্রামের ২৬২৫টি বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে জঙ্গি গোষ্ঠী এআরএসএ''৷
মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী বাড়িগুলোতে আগুন লাগিয়েছে৷
বাংলাদেশের নাফ নদীর পাশে শরণার্থী শিবিরে গাদাগাদি করে আশ্রয় নিয়েছেন রোহিঙ্গারা৷ স্থানীয়দের অনেকে দয়াপরবশ হয়ে নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন কয়েকজনকে৷ ইউএনএইচসিআর এর স্থানীয় মুখপাত্র জানিয়েছেন, সেখানে যে কয়টি শরণার্থী শিবির রয়েছে তাতে আর তিল পরিমাণ জায়গা নেই৷
মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশ যাত্রা
নিজের দেশে সহিংসতা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা৷ তবে জাতিসংঘের অনুরোধ সত্ত্বেও সীমান্তে কড়াকড়ি অব্যাহত রেখেছ বাংলাদেশ৷ আজও রোহিঙ্গাদের অবৈধ অভিবাসী মনে করে মিয়ানমার৷
আশ্রয়ের সন্ধান
মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে সেদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর উপর রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের পরিকল্পিত হামলার জের ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর দমনপীড়ন শুরু করেছে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী৷ ফলে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে ছুটছেন রোহিঙ্গারা৷ সর্বশেষ অস্থিরতায় ইতোমধ্যে প্রাণ গেছে একশ’র বেশি মানুষের৷
ব্যাপক উদ্বাসন
বাংলাদেশের সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখান থেকে এক রোহিঙ্গা শিশুকে পার করছেন এক ব্যক্তি৷ মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে, রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা সাতটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, একটি চেকপোস্ট এবং এক শহরের দুই প্রান্তে হামলা করেছে৷
ছবি: Getty Images/R.Asad
বৌদ্ধ শরণার্থীরা ছুটছে দক্ষিণের দিকে
নিরাপত্তা বাহিনীর দমনপীড়নের কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকার বৌদ্ধরাও নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় খুঁজছেন৷ রোহিঙ্গা মুসলমান এবং রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই উত্তেজনা বিরাজ করছে৷ ২০১২ সালে সেখানে রক্তাক্ত দাঙ্গা হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
প্রবেশ নিষেধ
বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা আশ্রয়প্রত্যাশী রোহিঙ্গাদের সীমান্ত থেকে ফিরিয়ে দিচ্ছেন৷ তবে এ সব বাধার মাঝেও তিন হাজারের মতো রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন৷ বাংলাদেশ ইতোমধ্যে চারলাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
মানবিক সংকট
একটি আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থার কর্মী লিখেছেন: ‘‘অনেক রোহিঙ্গাকে আমরা অসুস্থ অবস্থায় পাচ্ছি৷ এর কারণ তাঁরা বাংলাদেশে প্রবেশের আগে দীর্ঘসময় সীমান্তে আটকে ছিলেন৷ অসুস্থদের মধ্যে নারী এবং শিশুদের সংখ্যা বেশি৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa/M.Alam
বাংলাদেশে স্বাগত নয়
কক্সবাজারের কুতুপালাং শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া একদল রোহিঙ্গা শরণার্থী৷ বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের একটি দ্বীপে সরিয়ে নিতে চাচ্ছে যেটি বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ সময় পানির নীচে তলিয়ে থাকে৷
ছবি: Reuters/M. P. Hossain
নো ম্যান’স ল্যান্ডের আটকে থাকা
পানির মধ্যে দিয়ে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশের চেষ্টা করছে রোহিঙ্গা শিশুরা৷ এই মুহূর্তে ছ’হাজারের মতো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় সীমান্তে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে৷
ছবি: Reuters/M. Ponir Hossain
7 ছবি1 | 7
শুক্রবার শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন ৬০ বছরের বৃদ্ধ জালাল আহমেদ৷ যিনি জানালেন, ‘‘২০০ মানুষ নিয়ে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে তাদের গ্রামে চড়াও হয় এবং বাড়িঘর সবকিছুতে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ আমরা যদি ফিরে যাই, দেখামাত্র আমাদের গুলি করবে সেনাবাহিনী৷''
মিয়ানমারের সেনা প্রধান বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘‘রাখাইনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে তারা একটি ফ্রেমওয়ার্ক অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছেন৷ ‘বাঙালি সমস্যা' একটা দীর্ঘদিনের সমস্যা, যেটা সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই৷''
সহিংসতার শিকার মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা
02:13
এদিকে, রাখাইনে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ডাব্লিউএফপি সহ অনেক দাতা সংস্থা কাজ করছিল, যারা সহিংসতা শুরু হওয়ার পর তাদের কাজ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছেন৷ মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক মুখপাত্র জানালেন, ‘‘মাউংদোতে শিশুরা এমনিতেই অপুষ্টিতে ভুগছিল, তাদের জন্য জরুরি খাদ্য দরকার ছিল৷ কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনোরকম খাদ্য সহায়তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷''
রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে ৮০ হাজারেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছিল, যাদের চিকিৎসা প্রয়োজন বলে জুলাইতে রিপোর্ট করেছিল ডাব্লিউএফপি৷ এছাড়া যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে অনেক নারী অন্তঃসত্ত্বা, অনেকে সেখানে গিয়ে কেবল সন্তান জন্ম দিয়েছে, কারো একেবারে ছোট সন্তান রয়েছে, তাদের অবিলম্বে খাদ্য সহায়তা না দিলে বড় ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি৷
এদিকে, শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাদের সতর্ক করে দিয়েছে৷ আকাশসীমা লঙ্ঘন করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ঢুকে পড়ার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ৷ গত ২৭ ও ২৮ আগস্ট এবং শুক্রবার মিয়ানমারের কয়েকটি হেলিকপ্টার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷
অং সান সু চির কিছু তথ্য
ছবিঘরে তাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মুহূর্ত৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শৈশবেই বাবার মৃত্যু
১৯৪৫ সালের ১৯ জুন তখনকার ব্রিটিশ উপনিবেশের অংশ বার্মার রেঙ্গুনে জন্ম অং সান সু চি-র৷ বাবা জেনারেল অং সান-কে যখন হত্যা করা হয় সু চি-র বয়স তখন মাত্র ৩ বছর৷ ওপরের ছবিটি তোলা হয়েছিল জেনারেল অং সান-এর মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে৷
ছবি: gemeinfrei
রাজনীতিতে পদার্পণ
সু চি-র শৈশব কেটেছে ভারতে৷ উচ্চ শিক্ষার্থে ইংল্যান্ডে যাওয়ার পর সেখানে মাইকেল অ্যারিসের সঙ্গে পরিচয় হয়৷ পরবর্তীতে অ্যারিসকেই বিয়ে করেছিলেন সু চি৷ দুটি ছেলে আছে এই দম্পতির৷ ১৯৮৮ সালে নিজের দেশ মিয়ানমারে ফেরেন সু চি৷ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দেন প্রথম জনসভাতেই৷
ছবি: AFP/Getty Images
নির্বাচিত হয়েও বঞ্চিত
১৯৯০ সালে নির্বাচন হয়৷ নির্বাচনে শতকরা ৮০ ভাগ ভোট পায় সু চি-র দল এনএলডি৷ কিন্তু তখনকার সামরিক শাসক নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতায় পরিবর্তনের গণতান্ত্রিক দাবিকে পাত্তাই দেয়নি৷
ছবি: picture alliance/AP Images/M. Sato
গৃহবন্দি
নির্বাচনের কিছুদিন আগেই সু চি-কে গৃহবন্দি করা হয়৷ ২০১০ সালে পুরোপুরি মুক্তি প্রাপ্তির আগে বার কয়েক বাইরে আসার সুযোপ পেয়েছিলেন ‘মিয়ানমারের গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ হিসেবে পরিচিত এই রাজনীতিবিদ৷
ছবি: picture-alliance/epa/N. Chan Naing
নোবেল পেলেন সু চি
গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য অহিংস আন্দোলন করায় ১৯৯১ সালে সু চি-কে শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর স্বীকৃতি দেয় নোবেল কমিটি৷ গৃহবন্দি ছিলেন বলে সু চি নিজে যেতে পারেননি৷ তাঁর পক্ষ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন তাঁর ব্রিটেনে নির্বাসিত পুত্র কিম৷
ছবি: AP
মুক্তির দাবি
সু চি-কে মুক্তি দেয়ার দাবি উঠছিল বিশ্বের প্রায় সব প্রান্ত থেকে৷ কিন্তু তখনকার সামরিক বাহিনী তাতে কর্ণপাত করেনি৷
ছবি: picture-alliance/ dpa
অবশেষে মুক্তি
অবশেষে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তি পান অং সান সু চি৷
ছবি: picture alliance/epa/N. C. Naing
সংসদ সদস্য সু চি
২০১২ সালে আবার নির্বাচন হয় মিয়ানমারে৷ ১৯৯০ সালে সু চি-কে গৃহবন্দি করার পর থেকে কোনো নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চি-র দল এনএলডি৷ ২২ বছর পর আবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে ঠিকই নির্বাচিত হন সু চি৷ সেই সুবাদে এখন তিনি বিরোধী দলের নেত্রী৷
ছবি: AP
২০ বছর পর
২০১২ সালে মুক্ত সু চি-র হাতেই তাঁর পুরস্কারটা তুলে দেয় নোবেল কমিটি৷ সু চি জানান, এই পুরস্কার তাঁকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অনেক প্রেরণা জুগিয়েছে৷
ছবি: Reuters
জার্মানিতে সু চি
২০১৪ সালে সু চি জার্মানির রাজধানী বার্লিনেও এসেছিলেন৷ তখন মানবাধিকার রক্ষা এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দীর্ঘদিন লড়াই করার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁর হাতে ভিলি ব্রান্ড পুরস্কার তুলে দেন জার্মান প্রেসিডেন্ট গাউক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে সমালোচিত
মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন সত্ত্বেও এর প্রতিবাদ করেননি অং সান সু চি৷ অনেক রোহিঙ্গা দেশছাড়া হয়ে সাগরে ডুবে মরলেও সু চি নীরব ভূমিকাই পালন করছেন৷ শান্তিতে নোবেল জয়ী হয়েও একটি সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার নির্যাতনের বিষয়ে তাঁর নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা করেছেন অনেকেই৷