বাংলাদেশের নিত্যপণ্যের বাজার ক্রমশ অস্থির হচ্ছে, দাম দফায় দফায় বেড়ে চলেছে৷ গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেও প্রায় প্রতিদিনই বাজারের এই উর্ধ্বগতি ও অস্থিরতার চিত্র উঠে আসছে৷
বিজ্ঞাপন
চাল, ডাল, ভোজ্য তেল, আলু, চিনি, পেয়াঁজ, আদা, বিভিন্ন রকম সবজি, আটা, ডিম, দুধসহ প্রায় সবধরণের খাদ্যপণ্য গত কয়েকমাস ধরে বিভিন্ন সময়ে ঘুরে-ফিরে বাড়তির দিকেই যাচ্ছে৷
বাড়তি দামের চাপে দেশের জনগোষ্ঠীর বিশাল অংশ পড়েছে কষ্টের মধ্যে৷ এদের বেশিরভাগেরই আয়-উপার্জন সীমিত৷ ফলে নিত্যদিনের জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে বরাবরই বেগ পেতে হয়৷ আর ক্রমাগত দাম বাড়ায় কষ্টের মাত্রাও বেড়ে যায়৷ দাম বাড়ার পরিধিটা বেশ বড় হওয়ায় জীবনযাপন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়৷ বাজারে শুধু খাদ্যপণ্যের দাম বাড়লে তাও কষ্ট সয়ে কিছুটা সামাল দেয়ার চেষ্টা করা যেতো৷ কিন্তু খাদ্যের বাইরের পরিবহনের ব্যয় ও বাড়িভাড়া বেড়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হচ্ছে না গরিব মানুষেরও মধ্যবিত্তে রপক্ষে৷
কেন দাম বাড়ছে? আর কেনই বা দাম বাড়ার গতিতে লাগাম টানা যাচ্ছে না? এ প্রশ্ন দুটোর সদুত্তর পাওয়া বেশ কঠিনই৷ অর্থনীতিবিদরা চাহিদার বিপরীতে সরবরাহের ঘাটতিকে দায়ী করছেন৷ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কিছু পণ্যের দাম বৈশ্বিক বাজারে চড়া বলে বেশি দাম আমদানি করে আনতে হচ্ছে৷ ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বাজারের সিন্ডিকেটকে দুষছেন, দুষছেন সরকারের অপরযাপ্ত পদক্ষেপকে৷ মন্ত্রীরা কেউ কেউ মনে করছেন, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার তুলনায় দ্রব্যমূল্য সেভাবে বাড়েনি৷ তাঁরা বরং বিশ্ববাজারের উচচ মূল্য ও অস্থিরতাকে প্রধান কারণ মনে করছেন৷ আর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন যাবতীয় দায় এই যুদ্ধের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়েছে৷
যে যাই বলুন না কেন, দাম বেড়ে যাওয়ার সংকট যে বেশ গভীর হয়ে গেছে, তা সরকারের একাধিক পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট৷ যেমন, আসন্ন রমজান মাস উপলক্ষে সারা দেশে এক কোটি পরিবাবরকে কমমূল্যে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবির) মাধ্যমে দুই দফায় সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল, ছোলা, পেঁয়াজ ও খেজুর সরবরাহ করা হবে৷ এ জন্য বিশেষ কার্ড দেয়া হবে যা দেখিয়ে কার্ডধারীরা নিয়মিত বাজারদরের চেয়ে কমমূল্যে এসব পণ্য কিনতে পারবেন৷
এই ধরণের পদক্ষেপ নিয়ে নিম্নআয়ের ভুক্তভোগী মানুষকে সাময়িকভাবে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া গেলেও মূল সমস্যার কোনো অর্থবহ সমাধান আসবে না৷ একইভাবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার দোহাই তুলে দেশের ভেতরের মূল্যবৃদ্ধিকে বৈধতা দেয়ার প্রয়াসটিও ইতিবাচক নয়৷ কোনো সন্দেহ নেই, বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে তার প্রভাব দেশের বাজারেও পড়তে বাধ্য৷ প্রশ্ন হলো, তা কতখানি ও কোনমাত্রায়? আজকে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়লে আগামীকালই চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে খুচরা বাজারের ক্রেতাকে আগের দিনের চেয়ে বাড়তি দাম দিতে হবে কেন?
বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশের মুদি বাজার
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদি বাজারের মধ্যে তুলনা করা কঠিন৷ মার্কিন এক কোম্পানি সীমিত আকারে সেই চেষ্টা করেছে৷ তাদের দেয়া তথ্য থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে এই ছবিঘরে৷
ছবি: David McNew/Getty Images
গ্রোসারি সূচক ২০২১
ব্যক্তিগত লোন দেয়ার মার্কিন অনলাইন কোম্পানি ‘নেটক্রেডিট’ গতবছর ৯ নভেম্বর ২০২১ সালের গ্রোসারি সূচক প্রকাশ করে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুপারমার্কেটের ওয়েবসাইট থেকে নেয়া তথ্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি করা হয়৷ প্রথমে, বাজারের একটি তালিকা তৈরি করে সেগুলোর দাম কোন দেশে কেমন, তা জানার চেষ্টা করা হয়৷ সূচকটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: David McNew/Getty Images
১০টি পণ্যের তথ্য
সূচক তৈরিতে যে ১০টি পণ্যের তথ্য নেয়া হয়েছে সেগুলো হলো সকালের নাস্তার জন্য সিরিয়াল, ১২টি ডিম, ৫০০ গ্রাম হাড় ছাড়া মুরগীর বুকের মাংস, ৫০০ গ্রাম মাখন, ১ লিটার বোতলজাত ভেজিটেবল তেল, ৫০০ গ্রাম সাদা পাউরুটি, ১ লিটার দুধ, ১ কেজি আলু, ১ কেজি টমেটো, ১ কেজি কলা, ১৪০ গ্রাম ক্যানড টুনা ও বোতলজাত দেড় লিটার পানি৷
ছবি: Oliver Berg/dpa/picture alliance
বাংলাদেশে খরচ
উপরের পণ্যগুলো কিনতে বাংলাদেশে ১৯৯০ টাকা খরচ হতো বলে জানিয়েছে নেটক্রেডিট৷ বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে নেটক্রেডিট দেখেছে, এই পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশের দৈনিক গড় বেতনের ৩৪০ শতাংশ৷
ছবি: DW
সবচেয়ে বেশি সুইজারল্যান্ডে, কম জিবুতিতে
এই ১০টি পণ্য কিনতে সুইজারল্যান্ডে খরচ পড়তো প্রায় সাড়ে চার হাজার টাকা৷ আর জিবুতিতে মাত্র ৬০০ টাকা৷
ছবি: ZDF
বাংলাদেশ চার নম্বরে
পণ্য কেনার খরচ বের করার পর নেটক্রেডিট বিশ্বব্যাংকের তথ্য ব্যবহার করে প্রতিটি দেশের মানুষের গড় দৈনিক আয় জানার চেষ্টা করেছে৷ এরপর এই দুই তথ্য দিয়ে ‘অ্যাফোরডিবিলিটি পার্সেন্টেজ’ বা সক্ষমতার হার বের করেছে৷ এতে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষের সক্ষমতার হার ৩৪০ শতাংশ৷ অর্থাৎ ঐ ১০ পণ্য কিনতে খরচ হওয়া ১৯৯০ টাকা একজনের দৈনিক গড় বেতনের ৩৪০ শতাংশ৷ তালিকায় বাংলাদেশের উপরে আছে কম্বোডিয়া, কেনিয়া ও নিকারাগুয়া৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
সবচেয়ে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে ঐ ১০ পণ্য কিনতে খরচ পড়তো ২,২১২ টাকা, যা দেশটির দৈনিক গড় বেতনের মাত্র ১২ শতাংশ৷ এরপর আছে নেদারল্যান্ডস (খরচ ২১১৫ টাকা, সক্ষমতা ১৫ শতাংশ), লুক্সেমবার্গ (খরচ ২৯৩০ টাকা, সক্ষমতা ১৫ শতাংশ), ফিনল্যান্ড (খরচ ২১৪৬ টাকা, সক্ষমতা ১৬ শতাংশ), সিঙ্গাপুর (খরচ ২৯৩৩ টাকা, সক্ষমতা ১৮ শতাংশ) ও যুক্তরাজ্য (খরচ ২২২২ টাকা, সক্ষমতা ১৯ শতাংশ)৷
ছবি: Photoshot/picture alliance
তথ্য নেই
গ্রোসারি সূচকে ভারত, পাকিস্তান, জার্মানিসহ অনেক দেশের তথ্য দেয়া হয়নি৷
ছবি: Martin Wagner/imago images
চালের দাম
৯ মার্চ, ২০২২ সালে সার্বিয়ার ক্রাউড-সোর্সড ভিত্তিক বৈশ্বিক ডাটাবেজ কোম্পানি ‘নাম্বেও’র ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখা যায় বাংলাদেশে এক কেজি চালের (সাদা) দাম ৬০ টাকা৷ জাপানে দাম সবচেয়ে বেশি ৩৬৯ টাকা৷ এছাড়া যু্ক্তরাষ্ট্রে ৩৪০, সুইজারল্যান্ডে ২৫১, জার্মানিতে ১৮১, যুক্তরাজ্যে ১২৫, পাকিস্তানে ৭৬, ভারতে ৫৯, নেপালে ৬০ ও শ্রীলঙ্কায় ৫১ টাকা৷
ছবি: DW/H. Ur Rashid
পেঁয়াজের দাম
১০ মার্চ নাম্বেওর ওয়েবসাইটে দেখা যায় বাংলাদেশে এক কেজি পেঁয়াজের দাম সাড়ে ৫৩ টাকা৷ ভারতে ৪০ টাকা, পাকিস্তানে ২৫ টাকা, শ্রীলঙ্কায় ৬৬ টাকা, নেপালে ৪৯ টাকা, যুক্তরাষ্ট্রে ২২০ টাকা, যুক্তরাজ্যে ১০৮ টাকা ও জার্মানিতে ১২১ টাকা৷
ছবি: Reuters/L. Niesner
নাম্বেওর গ্রোসারি সূচক
নিউইয়র্ক শহরের বাজারের সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বাজারমূল্যের তুলনা করে তালিকা প্রকাশ করে নাম্বেও৷ এতে দেখা যাচ্ছে, নিউইয়র্কে যে গ্রোসারির দাম ১০০ টাকা৷ বাংলাদেশে সেটা ৩০ টাকায় পাওয়া যায়৷ জার্মানিতে পাওয়া যায় ৫২ টাকায়, যুক্তরাজ্যে ৫৬ টাকা, ভারতে ২৬ টাকা, পাকিস্তানে ১৭ টাকা ও নেপালে ২৬ টাকায়৷ সূচকটি দেখতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: imago/Levine-Roberts
নাম্বেওর তথ্য বিশ্বাসযোগ্য?
বিশ্বের যে কেউ নাম্বেওর ডাটাবেজে তথ্য ঢোকাতে পারে৷ তাই কেউ চাইলে ইচ্ছেমতো তথ্য দিতে পারে৷ সে কারণে নাম্বেওর তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে৷ এরপরও নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট, ইকোনমিস্ট, টাইম ম্যাগাজিনের মতো বিশ্বখ্যাত গণমাধ্যমে বিভিন্ন সময় নাম্বেওর তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে৷ নাম্বেও বলছে, গত ১২ মাসে ঢাকার বিভিন্ন জিনিসের দাম নিয়ে মোট ৩,১৩২ বার তথ্য যুক্ত করেছেন ২৭৪ জন নাম্বেও ব্যবহারকারী৷
ছবি: Frank Hoermann/SvenSimon/picture alliance
11 ছবি1 | 11
বিশ্ববাজারের দাম বাড়লে তার জের ধরে স্থানীয় বাজারে দাম বাড়ার পেছনে একাধিক বিষয় কাজ করে৷ স্থানীয় বিক্রেতারা আগাম মুনাফা তুলতে দাম বাড়িয়ে দেয়৷ তাদের যুক্তি হলো: আমদানিকারকরা আগামীতে যখন উচ্চদামে পণ্য আনবে, তখন তা উচ্চদামেই পাইকারী বাজারে ছাড়বে আর সেগুলোর দাম আরেকটু বেড়ে খুচরা বাজারে আসবে৷ তখন খুচরা বিক্রেতাকেও মুনাফা করতে দাম আরেকদফা বাড়াতে হবে৷ ফলে তারা দাম বাড়ালেও মুনাফার মাত্রা অপরিবর্তিতই থাকবে৷ কিন্তু বর্তমান যে মজুদ তাদের কাছে আছে, তা শেষ হয়ে গেলে আর কোনো কারণে পণ্য সরবরাহে আমদানি পরযায়ে বা পাইকারী বাজারে ব্যাঘ্যাত ঘটলে অনেক বিক্রেতার কাছেই তখন বিক্রয়যোগ্য পণ্য নাও থাকতে পারে৷ সে আশংকায় এখনই দাম বাড়িয়ে লোকসানের ঝুঁকি এড়ানো হয়৷ এভাবে শেষতক ভোক্তার ঘাড়ে বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যত দামের বোঝাও অনেকটা আগামভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়৷
লক্ষণীয় বিষয় হলো, যে পণ্য এখনো আমদানি করাই হয়নি সেটার হালনাগাদ দামকে বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান দাম হাঁকা হচ্ছে দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে৷ কিন্তু বিশ্ববাজারে দরপতন ঘটলে স্থানীয় বিক্রেতাদের যুক্তি উল্টে যায় এভাবে যে তারা আগে আমদানিকৃত বা মজুদকৃত পণ্য থেকে বি্ক্রি করছেন৷ আর যখন এসব আমদানি করা হয়েছিল, সেগুলোর দাম বেশি ছিল৷ বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই এই চর্চা চলছে৷
আবার বাংলাদেশে চাল ও গম ছাড়া আর কোনো খাদ্যপণ্য আমদানিতেও সরকারের কোনো ভূমিকা নেই বললেই চলে৷ টিসিবি যেসব পণ্য আমদানি করে, সেগুলোও বেসরকারি ডিলারদের মাধ্যমে করা হয়৷ ফলে, ভোগ্যপণ্য আমদানির প্রায় পুরোটাই বেসরকারিখাতের হাতে৷ আবার এদের মধ্যে অল্প কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান আমদানির বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে৷ সেজন্য অভিযোগ করা হয় যে কতিপয় বড় আমদানিকারক সিন্ডিকেট বা নিজেদের মধ্যে চক্র করে রেখেছে যাতে অন্য কেউ সেখানে ঢুকতে না পারে৷ আসলে, এটা ঠিক চক্র নয়, এটা হলো বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের তুলনামূলক প্রতিযোগিতা ও খরচ-সাশ্রয় করার সক্ষমতা যাকে অর্থনীতির পরিভাষায় বলে ইকোনমিজ অব স্কেল৷
তবে এই সক্ষমতার শক্তি যখন অনেক বেশি হয়ে যায়, তখন তা সমস্যা তৈরি করে৷ কেননা, সরকারের পক্ষেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না৷ আর তাই বাজারে দাম ওঠা-নামায় এসব বড় প্রতিষ্ঠানই মূল নিয়ামক হয়ে ওঠে৷ এরাই পণ্যের দাম নির্ধারণ করে নিজেদের মুনাফা ঠিক রেখে৷
এটাতো আমদানির দিক৷ আমদানির পর পাইকারী বাজার হয়ে খুচরা বাজারে পণ্য আসতে যে একাধিক স্তর পার হতে হয়, সেখানে দোকান ভাড়া ও পরিবহন ব্যয়ের মতো ব্যয়গুলো মিটিয়ে মুনাফা ধরে বিক্রয়মূল্য নির্ধারিত হয়৷ এক্ষেত্রে কিছু অদৃশ্য ব্যয় আছে যা দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখে৷ বিশেষত অবৈধ চাঁদাবাজি৷ এই অবৈধ চাঁদাবাজির বখরা নেয় এক শ্রেণীর পুলিশ, মাস্তান ও রাজনৈতিক নেতা৷ বিষয়টি ‘প্রকাশ্য গোপনীয়' বা ওপেন সিক্রেট৷ মূলত এক ধরণের রেন্ট সিকিং বা অনুপার্জিত আয়ের বড় ধরণের চক্র তৈরি হয়েছে এখানে যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে ভোক্তার ওপর৷ সুশাসনজনিত ঘাটতির কারণে এটা বন্ধে বা নিয়ন্ত্রণে কারযকর পদক্ষেপের অভাব প্রবল৷ অথচ তা করা গেলে দাম বাড়ায় কিছুটা হলেও লাগাম টানা যেতো৷ এদিকে মনোযোগ না দিয়ে না করে শুধু আমদানি শুল্ক কমিয়ে বা সাময়িকভাবে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে দাম তেমন একটা কমানো যাবে না৷
দাম নিয়ন্ত্রণে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সময়ে ব্যবসায়ীদের সাথে বৈঠক করে৷ সেখানে কোনো কোনো পণ্যের সর্বোচ্চ দর ঠিক করাও হয়৷ বাস্তবে দেখা যায় যে সেটি আর ঠিক থাকে না৷ ফলে দর বেঁধে দেয়ার প্রয়াসটা বহুলাংশে ব্যর্থতায় পরযবসিত হয়৷ সরকারের পক্ষ থেকে ট্যারিফ কমিশন বিশ্ববাজার, স্থানীয় মজুদ ও চাহিদা পরিস্থিতি নিয়মিত বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন পণ্যের দাম কী হতে পারে, তার একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আসছে কয়েক বছর ধরে৷ বাস্তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বেশি দামে ভোক্তাদেরকে পণ্য কিনতে হয়৷ আর তাই সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠে যে দাম বেঁধে দেয়া কী আদৌ সম্ভব?
আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এভাবে দাম বেঁধে দেয়া খুব বাস্তবসম্মত নয়৷ একইভাবে সম্ভব নয় ব্যবসায়ী-বিক্রেতারা কোন পণ্যে কতোটা বা কী হারে মুনাফা করবে, তা নির্ধারণ করা৷ বরং, পণ্য সরবরাহের বিভিন্ন ধাপে অবৈধ লেনদেন ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করা যৌক্তিক পদক্ষেপ৷ একইসঙ্গে বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন, আমদানি, চাহিদা ও দামের সঠিক ও বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত সরকারের হাতে থাকা আবশ্যক যেন এসব তথ্য নিবিড়ভাবে বিশ্লেষণ করা যায়৷ সেই বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন পণ্যের সম্ভাব্য বা নির্দেশক (বেঞ্চমার্ক) দাম নিয়মিত প্রকাশ ও প্রচার করা যেতে পারে৷ তাতে করে ভোক্তারা অন্তত এটা ধারণা করতে পারবেন যে তাঁরা কতটা বেশি দিয়ে কিনছেন৷ এতে করে সবধরণের বিক্রেতাদের ওপর একটা নৈতিক চাপও তৈরি হবে৷
সর্বোপরি দেশে যে বড় ধরণের আয়-বৈষম্য তৈরি হয়েছে, তাও প্রতিফলিত হচ্ছে উচ্চদামে তথা মূল্যস্ফীতিতে৷ মোট জনগোষ্ঠীর তুলনায় আনুপাতিক হারে অনেক কম হলেও একটা বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা এতোটাই বেশি যে কোনো উচ্চমূল্যই তাদের কাছে বাধা নয়৷ এরা বরং সামগ্রিক চাহিদা বাড়াতে ভূমিকা রাখছে যার প্রভাব পড়ছে দামে, বাড়ছে ব্যয়ের বৈষম্যও৷ অন্তত সাদাচোখে তাই দেখা যাচ্ছে৷
২০২১ সালের ছবিঘর
দ্রব্যমূল্যের তুলনা: ২০০৯ বনাম ২০২১
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করে৷ ছবিঘরে ঢাকার একটি বাজারে ২০০৯ ও ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর নির্দিষ্ট কিছু পণ্যের দাম উল্লেখ করা হয়েছে৷
চাল
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি বিপণন অধিদপ্তর প্রতিদিন ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম প্রকাশ করে৷ এতে দেখা যাচ্ছে ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার এক বাজারে এক কেজি সরু বোরো চালের দাম ছিল ৩৪-৩৬ টাকা৷ ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর একই বাজারে ঐ চালের দাম ছিল ৫৭-৭০ টাকা৷ মোটা বোরো চালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২১-২৩ টাকা৷ ২০২১ সালে ছিল ৪৪-৪৭ টাকা৷
ছবি: DW
ডাল
২০০৯ সালে এক কেজি দেশি মসুর ডালের দাম ছিল ১০৮-১১০ টাকা৷ ২০২১ সালে ১০০-১১০ টাকা৷ আমদানিকৃত মসুর ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ১১২-১১৫ টাকা৷২০২১ সালে সেটা কমে হয় ৮৫-৯০ টাকা৷ মুগ ডালের দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮৫-১০০ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১২০-১২৫ টাকা৷
ছবি: bdnews24.com/T. Ahammed
পেঁয়াজ
এক কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ছিল ৪০-৪৪ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ৫৫-৬০ টাকা৷ আর আমদানিকৃত পেঁয়াজের দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৮-৩৪ টাকা৷ ২০২১ সালে ৪৫-৫০ টাকা৷
ছবি: Harun Ur Rashid Swapan
রসুন
২০০৯ সালে এক কেজি দেশি রসুনের দাম ছিল ৯০-১০৫ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা কম ছিল, ৫০-৭০ টাকা৷ আমদানিকৃত রসুনের এক কেজির দাম ২০০৯ সালে ছিল ৮০-৮৫ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বেড়ে হয় ১১০-১২০ টাকা৷
ছবি: bdnews24.com/A. Mannan
কাঁচা মরিচ
২০০৯ সালের ১০ নভেম্বর ঢাকার এক বাজারে এক কেজি কাঁচা মরিচের দাম ছিল ৩০-৪০ টাকা৷ ঐ একই বাজারে ২০২১ সালের ১০ নভেম্বর কাঁচা মরিচের দাম ছিল ১২০-১৩০ টাকা৷
ছবি: DW/H.U.R. Swapan
সয়াবিন তেল
২০০৯ সালে এক লিটার সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০-৭৩ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ১৩৮-১৪২ টাকায়৷
ছবি: Gustavo Cuevas/dpa/picture-alliance
চিনি
২০০৯ সালে আমদানিকৃত এক কেজি চিনির দাম ছিল ৫২-৫৪ টাকা৷ ২০২১ সালে ৭৫-৭৭ টাকা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J.Kalaene
ডিম
২০০৯ সালে দেশি মুরগির ডিম ছিল ৩২-৩৪ টাকা হালি৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ৫৫-৬০ টাকায়৷ ফার্মের মুরগির ডিমের (লাল) দাম ২০০৯ সালে ছিল ২৫-২৬ টাকা৷ ২০২১ সালে ৩৬-৪০ টাকা৷
ছবি: Reuters/W. Kurniawan
গরুর মাংস
গরুর মাংসের কেজিপ্রতি দাম ২০০৯ সালে ছিল ২২০-২৩০ টাকা৷ ২০২১ সালে সেটা বিক্রি হয়েছে ৫৮০-৬০০ টাকায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/N. Bachmann
খামারের মুরগী
২০০৯ সালে কেজিপ্রতি দাম ছিল ১০০-১১০ টাকা৷ ২০২১ সালে ১৫০-১৬০ টাকা৷
ছবি: Getty Images/AFP/H. Dinh Nam
দেশি রুই
২০০৯ সালে ছিল ১৪০-১৬০ টাকা৷ ২০২১ সালে ২০০-৩০০ টাকা৷ বিস্তারিত জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Mortuza Rashed
পানির দাম
গত ১২ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে ঢাকা ওয়াসা৷ ২০০৯ সালে আবাসিক গ্রাহকদের জন্য প্রতি ইউনিট (১ হাজার লিটার) পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৭৫ পয়সা৷ গত জুলাই থেকে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা দরে দাম দিতে হচ্ছে৷ অর্থাৎ গত ১২ বছরে ইউনিটপ্রতি পানির দাম প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে৷ সম্প্রতি চট্টগ্রাম ওয়াসাও আগামী মাস থেকে পানির দাম বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে৷
ছবি: AP
বিদ্যুৎ
এ বছরের ২১ জুন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) ও ভোক্তাকণ্ঠ আয়োজিত এক ওয়েবিনারের মূল নিবন্ধে বলা হয়, গত ১১ বছরে বিদ্যুতের দাম ১০ বার বেড়েছে৷ পাইকারি বিদ্যুতের দাম ১১৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে৷ আর খুচরা পর্যায়ে দাম বেড়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ৷
ছবি: DW
জ্বালানির দাম বৃদ্ধি
৩ নভেম্বর বুধবার রাতে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়৷ ডিজেলের মোট চাহিদার ৬৩ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পরিবহন খাতে৷ আর সেচকাজে ব্যবহৃত হয় ১৬ শতাংশ৷ ৪ নভেম্বর ফার্নেস অয়েলের দাম লিটারপ্রতি তিন টাকা বাড়িয়ে ৬২ টাকা করা হয়৷ আরও বেড়েছে বেসরকারি খাতের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম৷ ১২ কেজির সিলিন্ডারে বেড়েছে ৫৪ টাকা৷
ছবি: Getty Images/P. Walter
মুনাফা সত্ত্বেও বৃদ্ধি
জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, সবশেষ ২০১৩ সালে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল৷ মাঝে ২০১৬ সালে দাম কিছুটা কমানোও হয়েছিল৷ তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ববাজারে দাম যখন কম ছিল তখন তেলের দাম ততটা না কমানোয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা মুনাফা করেছিল৷ আর এবার টানা পাঁচ মাস ক্ষতি হওয়ার পর দাম বাড়ানো হলো৷
ছবি: Alastair Grant/AP/picture alliance
ঢাকায় বাসা ভাড়া দ্বিগুন হয়েছে
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বলছে ঢাকায় ২০১০ সালে দুই কক্ষের পাকা বাসার গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৩০০ টাকা৷ ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৪ হাজার ৫৯০ টাকা৷ আধাপাকা (টিন শেড) বাড়ির দুই কক্ষের ভাড়া ২০১০ সালে ছিল ৬ হাজার ৮০০ টাকা৷ ২০১৯ সেটা বেড়ে হয় ১৩ হাজার ২০০ টাকা৷ ২০১০ সালে দুই কক্ষের মেসের গড় ভাড়া ছিল ১১ হাজার ৫০০ টাকা৷ ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় ২৩ হাজার ২০০ টাকা৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. uz Zaman
জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে
এ বছরের জুনে ক্যাব জানায় ২০২০ সালে ঢাকায় জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬.৮৮ শতাংশ এবং সেবা-সার্ভিসের দাম বেড়েছে ৬.৩১ শতাংশ৷ ২০১৯ সালে এটি ছিল যথাক্রমে ৬.৫০ শতাংশ ও ৬.০৮ শতাংশ৷ ২০১৮ সালে তা ছিল ৬ শতাংশ ও ৫.১৯ শতাংশ৷ ঢাকার ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা-সার্ভিসের মধ্য থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য ও ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের সংগৃহীত মূল্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে ক্যাব৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
মাথাপিছু আয় বেড়েছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেবে ২০০৯-২০১০ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৮৪৩ মার্কিন ডলার৷ আর সবশেষ হিসাব বলছে, মাথাপিছু আয় এখন ২,৫৫৪ ডলার৷ তবে এই আয়ের সুষম বণ্টন হচ্ছে বলে মনে করেন না অনেক অর্থনীতিবিদ৷ কারণ একদিকে যেমন একদল মানুষ দ্রুত ধনী হচ্ছেন, আবার গরিবের সংখ্যাও বাড়ছে৷ করোনার সময়ে প্রায় সোয়া তিন কোটি মানুষ নতুন করে দরিদ্র্য হয়েছেন বলে সম্প্রতি এক জরিপে জানা গেছে৷