জার্মানির বড় শহরগুলোতে বাড়ি কি ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া এমনিতেই দুঃসাধ্য৷ অভিবাসীদের ক্ষেত্রে সেটা আরো বেশি কঠিন৷ বিদেশি-বহিরাগতদের সম্পর্কে বাড়ির মালিকদের প্রচলিত ধারণাকে জাতিবাদের নামান্তর বলা চলে৷
বিজ্ঞাপন
আইসেগুল আচার এক তুর্কি মহিলা৷ তাঁকে এক বাড়ির মালিকের কাছ থেকে স্পষ্ট শুনতে হয়েছে: ‘‘বিদেশিদের বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে না!'' আইসেগুলের বাস বন শহরে৷ ৩০ বছরের বেশি আগে তিনি তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসেন৷ এ দেশটা তাঁর ভালো লাগে, নিজের স্বদেশ বলেই মনে হয় – কিন্তু বাড়ি খোঁজার সময় নয়৷
জার্মানিতে তিনবার বাড়ি বদলেছেন আইসেগুল৷ প্রতিবারই তাঁর একই অভিজ্ঞতা হয়েছে: জার্মান বাড়িওলাদের কাছে তিনি মনপসন্দ ভাড়াটিয়া নন৷ তাঁর পদবী, জার্মান ভাষা বলার ধরন এবং চেহারা – সবই ভুল, অন্তত বাড়িওলাদের চোখে৷ একা আইসেগুলেরই এই অভিজ্ঞতা নয়৷ বিদেশি-বহিরাগতদের অধিকাংশ জার্মানিতে বাড়ি খুঁজতে গিয়ে একই বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন৷
জার্মানিতে বাড়ি সমস্যায় অভিবাসীরা
অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ তবে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷এ সমস্যা জার্মানিতে বসবসারত তুর্কিদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়৷ কারণ জার্মানিতে প্রায় ৪০ লাখ তুর্কি আছেন৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
অভিবাসী তুর্কিদের সমস্যা বেশি
জার্মানিতে অভিবাসীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়৷ এগুলোর মধ্যে বাড়ির সমস্যাকে একটি বড় সমস্যা হিসেবে ধরা যেতে পারে৷ জার্মানিতে অভিবাসীদের মধ্যে তুর্কিদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০ লাখ৷ কাজেই সমস্যাটাও ওদের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শীতকালে ঠান্ডায় কষ্ট পায়
তুর্কিদের সাধারণত বাসা ভাড়া দেওয়া হয় পুরনো এলাকায় বহু বছরের পুরনো বাড়িগুলোয়৷ সেই সব বাড়িতে হয়ত দরজা ঠিকমতো বন্ধ হয় না বা জানালা দিয়ে বাতাস ঢোকে বা খানিকটা খোলা থাকে৷ অথবা শীতকালে হিটার কাজ করে না, অর্থাৎ ঠান্ডায় কাটাতে হয়৷ বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলেও ঠিক করানো যায়নি৷ এভাবেই জানান তিন দশক আগে তুরস্ক থেকে জার্মানিতে আসা আহমেদ খালিফি৷
ছবি: DW/C. Ruta
বাড়ির অবস্থা অস্বাস্থ্যকর
আহমেদ খালিফির ছেলে আদেলের বাড়িতেও প্রায় একই সমস্যা৷ বাড়িটি ৪০ বছরের পুরনো হওয়ায় খুবই স্যাঁতসেঁতে, অন্ধকার এবং অস্বাস্থ্যকর৷ এ ব্যাপারে অবশ্য বাড়িওয়ালার মাথা ব্যথা নেই, কয়েকবার বলেও কোনো কাজ হয়নি৷
ছবি: DW/C. Ruta
অবশেষে নিজেই দায়িত্ব নেন
আবদাল ১৫ বছর এ বাড়িতে আছেন, কিন্তু একবারও রঙ করা হয়নি৷ আর সেকথা বাড়ির মালিককে কয়েকবার বলায় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন যে, প্রয়োজনে তিনি যেন নিজেই এ কাজ করে নেন৷ তাই আবদাল এ কাজ ভালো না জানা সত্ত্বেও নিজেই করছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb
শীতের কথা ভেবে ভীত
একটি মাত্র ঘর আর সেখানেই বাচ্চাদের নিয়ে থাকেন আলিয়া৷ ঘরে যেসব জিনিসের জায়গা হয় না, সেসব জিনিস স্থান পেয়েছে বাড়ির বারান্দায়৷ কিন্তু শীতের সময় এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের কি হবে – তা ভেবে অস্থির আলিয়া৷ এই অবস্থা অবশ্য শুধু আলিয়ার একার নয়৷
ছবি: DW/C. Stefanescu
অভিবাসীদের বেশি সন্তান
অভিবাসীদের বাড়ির বড় সমস্যা৷ তার কারণ, তাঁরা বড় শহরগুলোর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করেন৷ তাছাড়া জার্মানদের তুলনায় অভিবাসীরা কম রোজগার করেন এবং তাঁদের সন্তান সংখ্যা বেশি হওয়ায় বাড়ি পেতেও অসুবিধা হয়৷ এছাড়া একই ধরণের বাড়ির জন্য জার্মানদের তুলনায় তাঁদের কাছে বেশি ভাড়াও চাওয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB
বাড়ির অবস্থা করুণ
অভিবাসীদের বাসস্থান সমস্যা অবশ্য নতুন সমস্যা নয়৷ অভিবাসীরা যেসব এলাকায় থাকেন সেই পুরনো বাড়িগুলোকে ঠিকঠাক না করানোয়, দিনদিন সেগুলি জরাজীর্ণ হয়ে পড়ছে৷ এই অবস্থা নিদিষ্ট কোনো শহরে নয়, প্রায় শহরেই এই একই অবস্থা৷
ছবি: Fars
আগুনে পরিবারের আট জনের মৃত্যু
প্রায় চার মাস আগে বাডেন-ভ্যুর্টেমব্যার্গের বাকনাং শহরে একটি বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইন ছিল বিপজ্জনক এবং একথা বারবার মালিককে বলার পরও তা ঠিক করা হয়নি৷ যার ফল হয় মর্মান্তিক৷ ঘর গরম বা পানি গরমের জন্য ব্যবহার করা হতো কাঠের চুল্লি৷ ঐ বাড়িতেই আগুন লেগে একজন তুর্কি মা তাঁর সাত সন্তানসহ মারা যান৷ ছবিতে বাকনাং শহরের কিশোর-কিশোরীরা মৃত পরিবারের প্রতি ফুল আর মোমবাতি দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বাড়ি মালিকদের মত
বাড়িওয়ালাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, তুর্কি পরিবারগুলো অনেক বড়, সবসময় হৈচৈ লেগে থাকে এবং তেমন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন নয়৷ আর সেজন্যই তাঁদের বাড়ি ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কিছুটা আপত্তি থাকে বাড়িওয়ালাদের৷
ছবি: picture-alliance/dpa
তরুণদের ভিন্নমত
বয়স্ক অভিবাসীরা বাসস্থানের ব্যাপারে যতটা বৈষম্যের শিকার হন বলে মনে করেন, এই প্রজন্মের তুর্কিরা তেমনটা মনে করে না৷ সম্ভবত এই প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জার্মান ভাষা ভালো জানার কারণেই এমনটা ঘটছে৷
ছবি: Suzheh.sub.ir
10 ছবি1 | 10
অথচ জার্মানিতে ভাড়াবাড়িতে থাকাটাই স্বাভাবিক: জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক বাস করে ভাড়াবাড়িতে৷ বার্লিন অথবা হামবুর্গের মতো বড় শহর ধরলে, সেখানকার প্রতি দশজন বাসিন্দাদের মধ্যে আটজনই থাকেন ভাড়াবাড়িতে৷ বড় শহরে খালি ফ্ল্যাটের সংখ্যাও কম – বা সম্ভাব্য ভাড়াটিয়াদের সংখ্যা বেশি৷ কাজেই বাড়ির মালিকরা যাকে ইচ্ছা নিতে পারেন কিংবা বাদ দিতে পারেন, ফ্ল্যাট দিতে পারেন কিংবা নাকচ করতে পারেন৷ যে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানসহ একা বাসরত মহিলা, ছাত্র কিংবা কর্মহীনেরা আগেই বাদ পড়বেন বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে৷ সেই সঙ্গে যুক্ত হয় জাতিবাদ৷
হিজাব পরিহিতা মুসলিম মহিলারা এবং কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানরা বিশেষ করে এই জাতিবাদের শিকার হন: এঁদের মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ বাড়ি বা ফ্ল্যাট খুঁজতে গিয়ে শুনেছেন, ‘‘দুঃখিত৷ ওই ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়া হয়ে গিয়েছে৷'' আইসেগুল আচারকেও বার বার সে অজুহাত শুনে বিদায় নিতে হয়েছিল৷ শেষমেষ তাঁর বড়ছেলের মাথায় একটি আইডিয়া আসে৷ ছেলেটি ঝরঝরে জার্মান বলে৷ সেই নাম ভাঁড়িয়ে জার্মান নাম ধরে টেলিফোনে জিগ্যেস করে, ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেওয়া হয়েছে কিনা৷ বাড়িওলা এবার এই কাল্পনিক ‘‘হের শুলৎস''-কে সত্যি কথাটাই বলেন: না, বাড়ি ভাড়া দেওয়া হয়নি৷
আইসেগুল অবশেষে একটি ফ্ল্যাট পেয়েছেন বটে, তবে কোনো জার্মানের কাছ থেকে নয়৷ তাঁর ফ্ল্যাটটির মালিক হলেন এক স্পেনীয়৷ অর্থাৎ আইসেগুলের মতো তিনিও বিদেশি-বহিরাগত৷