কেরালার এর্নাকুলামে কাজ করতে গিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের এক শ্রমিক। বাড়ি ফিরতে না পেরে হতাশার শিকার হলেন তিনি।
বিজ্ঞাপন
বাড়ি আর ফেরা হলো না মুর্শিদাবাদের পরিযায়ী শ্রমিক আসিফ আলি মন্ডলের। বাড়ি ফিরলো তাঁর প্রাণহীন দেহ। দীর্ঘ ৪৮ দিন ধরে তাঁর বাড়ি ফেরার ছটফটানি দিন দু'য়েক আগে শেষ হয়ে গিয়েছে। আত্মহত্যা করেছেন ১৭ বছরের এই গরিব শ্রমিক। কাজের খোঁজে মুর্শিদাবাদ থেকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে তিনি গিয়েছিলেন দক্ষিণ ভারতের কেরালায়। ইটভাটায় কাজ করতে। দুই পয়সা বেশি রোজগার করতে। লকডাউনের ফলে বাড়ি ফেরা হয়নি। ইটভাটা বন্ধ করে মালিক চলে গিয়েছেন। বকেয়া পয়সাও দেননি। জমানো সামান্য টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল তাঁর। বাড়ি ফেরার তাড়নায় দুই বার ট্রেনের টিকিট কেটেছিলেন তিনি। সেই ট্রেন বাতিল হয়েছে। এর্নাকুলাম থেকে একটা শ্রমিকএক্সপ্রেস ট্রেন বহরমপুর এসেছে। অনেক চেষ্টা করেও তাতে ঠাঁই হয়নি। বাড়ি ফেরার ছটফটানি আরও বেড়েছে। আর তাতে জুটেছে হতাশা। শেষ পর্যন্ত উদ্বেগ, ভাবনার বোঝা, নিরাশা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন ওই যুবক।
দুই দশকে নতুন যত ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব
গোটা বিশ্ব এখন করোনা ভাইরাস বিরুদ্ধে লড়ছে, যার শুরুটা হয়েছিল গত বছরের ডিসেম্বরে চীন থেকে৷ গত প্রায় দুই দশকে ছড়িয়ে পড়া নতুন কয়েকটি ভাইরাস নিয়ে এই ছবিঘর৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Center for Disease Control
বার্ড ফ্লু (এইচ৫এন১)
১৯৯৭ সালে হংকংয়ে এইচ৫এন১ ভাইরাস ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ তারপর ২০০৩, ২০০৬, ২০০৭ ও ২০০৮ সালে এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশে এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়৷ ২০০৩ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৬৩০ জন বার্ড ফ্লুতে সংক্রমিত হয়েছেন এবং ৩৭৫ জন মারা গেছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নিপাহ ভাইরাস
১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার পাংকর দ্বীপের ছোট্ট শহর কামপুং তেলুক নিপাহতে নতুন একটি ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়৷ পরের বছর ওই শহরের নামে ভাইরাসটির নামকরণ হয় নিপাহ৷ এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মৃত্যুর আশঙ্কা ৫৪ শতাংশ৷ ২০১৮ সালে ভারতের কেরালায় এই ভাইরাস সংক্রমণে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু হয়৷ ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাসে অন্তত ১০ জন মারা যান৷
ছবি: Getty Images/AFP
সার্স
সিভিয়ার একিউট রেসপিরেটরি সিনড্রোম (সার্স) ভাইরাসের প্রথম প্রাদুর্ভাব হয় চীনে৷ ২০০২ ও ২০০৪ সালে এশিয়ার কয়েকটি দেশে সার্স ভাইরাস মারাত্মক আকারে ছড়িয়ে পড়ে৷ আট হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হন, মারা যান প্রায় ৭৭৪ জন৷ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হলে ভয়াবহ শ্বাসকষ্ট হয়৷ তবে ২০০৪ সালের পর এই ভাইরাসে প্রাদুর্ভাবের খবর আর পাওয়া যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/M. Reynolds
সোয়াইন ফ্লু
২০০৯ সালে প্রথম বিশ্বজুড়ে এইচ১এন১ ভাইরাসের প্রকোপ দেখা যায়৷ শূকরের ফ্লুর সঙ্গে লক্ষণ মিল থাকায় একে সোয়াইন ফ্লু নাম দেওয়া হয়৷ এখন পর্যন্ত বিশ্বের ১১ থেকে ২১ শতাংশ মানুষ এ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছেন৷ দেড় লাখ থেকে প্রায় ছয়লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে৷ ঢাকায় নতুন বছরে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার খবর শোনা গেলেও আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা৷
ছবি: AP
মার্স (মিডলইস্ট রেসপিরেটরি সিনড্রোম)
এটি সার্স ভাইরাস গোত্রেরই একটি ভাইরাস৷ ২০১২ সালে প্রথম সৌদি আরবে এই ভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়৷ দেশটিতে মার্সে আক্রান্ত প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ মারা যান৷ উট থেকে এই ভাইরাস মানবদেহে ছড়ায় বলে ধারণা করা হয়৷ হাঁচি, কাশি ও সংস্পর্শের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষেও ছড়ায়৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
করোনা ভাইরাস
চীনের উহান প্রদেশে গত ডিসেম্বর থেকে করোনা ভাইরাস প্রকোপ শুরু হয়৷ পরবর্তীতে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে৷
ছবি: Getty Images/AFP/STR
বৈশ্বিক মহামারি
২০২০ সালের শুরু থেকেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বিভিন্ন দেশে৷ এক পর্যায়ে বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা৷ এশিয়া থেকে ইউরোপ হয়ে এখন অ্যামেরিকা রয়েছে করোনা আক্রান্ত দেশগুলোর শীর্ষে৷ সারা বিশ্বে এরিমধ্যে দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে রহস্যময় ভাইরাসটি৷
ছবি: Getty Images/L. DeCicca
প্রতিষেধক নেই
এখনও করোনার কোন প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি৷ তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ৷ কয়েকটি উদ্যোগ বেশ খানিকটা এগিয়েছে৷ মানব শরীরে কিছু সম্ভাব্য টিকার পরীক্ষা নিরীক্ষাও শুরু হয়েছে৷ তবে সেগুলো কার্যকারিতা নিশ্চিত হতে আরো বছর খানেক সময় লাগতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Yonhap
8 ছবি1 | 8
তাঁর সঙ্গী ও একই ইটভাটায় কাজ করা সরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, কয়েক দিন ধরেই চিন্তায়, ভাবনায় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন আসিফ। তবে তিনি যে এইরকম কাজ করে ফেলবেন, তা ভাবা যায়নি। হতাশায় ডুবে থাকা আসিফ আমবাগানে গিয়ে গলায় দড়ি দেন। তার আগের দিন রাতেও মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলেন তিনি। তখনও বাড়ি থেকে দূরে থাকার কষ্ট ও ফিরতে চাওয়ার ইচ্ছে নিয়েই কথা হয়েছিলো। তাঁর কাকা জানিয়েছেন, আসিফ ছিলো বাড়ির বড় ছেলে। কেরালায় মজুরি বেশি পাওয়া যায় বলে এত দূরে গিয়ে ইটভাটায় কাজ করছিলেন। লকডাউন যে দিন হলো, তার কয়েকদিন পরেই তাঁর ফেরার কথা ছিলো।
এখন ফিরছে আসিফের প্রাণহীন দেহ। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''তা হলে কি এটাই মানতে হবে, জীবিত ব্যক্তির থেকে মৃতের দাম বেশি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের কাছে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে থাকা পরিযায়ী শ্রমিকরা মূল্যহীন। তঁদের ফেরানো হচ্ছে না। মরদেহ ফিরলে পরিবার অন্তত একবার শেষ দেখা দেখতে পারে। কেরালা সরকার তাই মরদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা করছে।'' লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা ও বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরীর বক্তব্য, ''মুখ্যমন্ত্রী একবার তাঁর অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে জানুন, পরিযায়ী শ্রমিকদের টাকা কীভাবে বাংলার অর্থনীতিকে মজবুত করেছে। তাঁদের বিপদের দিনে এখন কী করে মুখ্যমন্ত্রী মুখ ফেরাতে পারেন? তিনি একবার নিজেকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন।''
করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ১০০ দিন
গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম করোনায় সংক্রমিত রোগী পেয়েছিল জার্মানি। সেই থেকে শুরু করোনাবিরোধী লড়াইয়ের ১০০ দিন হয়ে গেল। দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Heimken
প্রথম রোগী মিউনিখে
করোনা সংক্রমণের পর দীর্ঘ চিকিৎসা-পর্ব শেষে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরা রোগীটি মিউনিখের।
ছবি: Reuters/F. Bensch
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর ঘোষণা
চীনে সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় ততদিনে করোনা নিয়ে আতঙ্ক জার্মানিতেও কিছুটা ছড়াতে শুরু করেছিল। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ইয়েন স্পান সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, "আমরা সতর্ক এবং প্রস্তুত আছি। আন্তর্জাতিক ও ইউরোপীয় পর্যায়ে এবং সব রাজ্যের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছি আমরা।"
ছবি: AFP/O. Andersen
নির্বিঘ্ন প্রথম মাস
ফেব্রুয়ারির শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে জনজীবন একেবারে স্বাভাবিক ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য চলেছে। সীমান্ত খোলা ছিল। নির্বিঘ্নে এবং সফলভাবে শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব বার্লিনালে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক মানুষ অংশ নিয়েছেন সে উৎসবে।
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Kalaene
মার্চেও নিশ্চিন্ত বার্লিন
বার্লিনে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে ২ মার্চ। জার্মানির রাজধানী শহরের যে হাসপাতলে তার চিকিৎসা হয়েছিল, সেখানকার মেডিকেল অফিসার বিষয়টিকে একেবারে পাত্তা না দিয়ে বলেছিলেন, "এটা কাকতালীয় ঘটনা।" ছবিতে মার্চে বার্লিনে অনুষ্ঠিত বুন্ডেসলিগার একটি ম্যাচের দৃশ্য৷
ছবি: Getty Images/Bongarts/M. Hangst
আসল লড়াই শুরু
মার্চ মাসে পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে শুরু করে। বাতিল করতে হয় বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেল ট্রাইড শো।
ছবি: picture-alliance/dpa/B.v. Jutrczenka
ম্যার্কেলের সতর্কবার্তা
চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তখনো চুপ। ১১ মার্চ নীরবতা ভাঙলেন, এক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, এখনই সতর্ক না হলে জার্মানির ৬০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে।
ছবি: Getty Images/AFP/K. Nietfeld
সীমান্ত বন্ধ, জনজীবনে বিধিনিষেধ
তারপর ধীরে ধীরে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয় জার্মানি। খাদ্য সামগ্রী এবং জরুরি প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া বাকি সব দোকান, ব্যবসা পতিষ্ঠান বন্ধ করে ঘরের বাইরে চলাফেরায়ও আরোপ করা হয় নিষেধাজ্ঞা। বাতিল করা হয় খেলাধুলা, সংস্কৃতিসহ সব বিষয়ের সব অনুষ্ঠান।
ছবি: picture-alliance/dpa/CTK/M. Chaloupka
প্রশংসিত জার্মানি
সংক্রমিতের সংখ্যা বাড়তে থাকলেও জার্মানিতে করোনা সংক্রমণে মৃত্যুহার এখনো কম। এ পর্যন্ত সংক্রমিত হয়েছেন এক লাখ ৬০ হাজারের বেশি মানুষ, মৃতের সংখ্যা সাত হাজারের কম। মৃত্যুহার কম রাখতে পারায় বিশ্বজুড়ে চলছে জার্মানির চিকিৎসাব্যবস্থার প্রশংসা।
ছবি: picture-alliance/AP Photo/A. Heimken
বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা
তবে বন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা বলছে, খুব সতর্ক না হলে সংক্রমণ দশগুণ বেড়ে ১৮ লাখ হয়ে যেতে পারে। সুতরাং, করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইটা হয়তো দীর্ঘই হবে জার্মানিতে।
ছবি: Reuters/F. Bensch
9 ছবি1 | 9
হতে পারে, এ সবই রাজনৈতিক কোলাহল। কিন্তু এর পিছনে একটা সত্যও থেকে যাচ্ছে। তা হলো, ভিন রাজ্যে আটকে পড়া রাজ্যের পরিযায়ী শ্রমিকদের হাল এবং তাঁদের ফেরানো নিয়ে রাজ্য সরকারের গয়ংগচ্ছ মনোভাব, বিরোধীরা যাকে বলছে অনীহা। রাজ্যের বাইরে যাওয়া শ্রমিকদের সংখ্যা প্রচুর। তা হলে প্রথমে কেন মাত্র দুইটি ট্রেনের ব্যবস্থা করা হলো? তারপর প্রবল সমালোচিত হওয়ার পর মাত্র দশটি ট্রেনের ব্যবস্থা করা হলো? একটা ট্রেনে এক হাজার ২০০ শ্রমিককে ফেরানো যাচ্ছে। তাহলে মোট ১৪ হাজার ৪০০ শ্রমিককে রাজ্যে ফেরানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাকি হাজার হাজার শ্রমিক ঘরে ফেরার জন্য মরিয়া। তাঁদের কী হবে? এর কোনও জবাব রাজ্য সরকার অন্তত দিচ্ছে না।
হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো, যে আসিফ ঘরে ফিরতে না পেরে নিজেকে শেষ করে দিলেন, তাঁর মরদেহ আজ ঘরে ফিরছে। তাঁর স্বজন ছাড়া কেই বা আর এই যন্ত্রণা মর্মে মর্মে অনুভব করবেন? সরকারি খাতায় তো আসিফ এরপর একটা সংখ্যায় পরিণত হবেন। সেখানে উল্লেখ থাকবে, পশ্চিমবঙ্গের একজন শ্রমিক কেরালার এর্নাকুলাম জেলায় আত্মহত্যা করেছেন। কেন করেছেন, তার ইতিহাস হারিয়ে যাবে। যেমন যায় আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে।