কথায় বলে ‘মরা হাতির দাম লাখ টাকা'৷ কিন্তু মরা বিমান, মানে যার আয়ু শেষ হয়ে গেছে, তা থেকে কত আয় করা যায়? এক ইউরোপীয় প্রকল্পের আওতায় বিমানের যন্ত্রাংশগুলির পুনর্ব্যবহারের আরও উন্নত পথের খোঁজ চলছে৷
বিজ্ঞাপন
কোনো বিমান শেষবারের মতো জমি স্পর্শ করার পর কী ঘটে? কয়েক লক্ষ মাইল চলার পর বিশাল উড়োজাহাজ আবর্জনার পাহাড়ে পরিণত হয়৷ এবার শুধু টুকরোগুলি ফেলার অপেক্ষা৷
এক ইউরোপীয় গবেষণা উদ্যোগ এই প্রক্রিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে কার্যকর করার পথ খুঁজছে৷ এক্ষেত্রে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ সবার আগে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ শনাক্ত করতে হবে এবং ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব বিমানের নক্সায় সেগুলি সামিল করতে হবে৷ প্রকল্পের সমন্বয়ক আইচে চেলিকেল বলেন, ‘‘যে সব অ্যালয় ও ধাতু উদ্ধার করা হয়, তার মধ্যে টাইটানিয়াম খুঁজতে হয়৷ সেটি অ্যালুমিনিয়ামের চেয়েওদামী৷ আমরা বিমানের গোটা জীবনকাল বিশ্লেষণ করে এই সব সমস্যা ছাড়াই বিমান ডিজাইন করতে চাই৷ ভবিষ্যতে অনেকটা রিসাইক্লিং-এর প্রয়োজন অনুযায়ী এমন ডিজাইন সৃষ্টি হবে৷''
বাতিল বিমান কাজে লাগানো
03:25
গোটা বিশ্বে বিমানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে৷ আগামী ২০ বছরে ইউরোপে প্রায় ৬,০০০ বিমানের আয়ু শেষ হয়ে যাবে৷ তাই সেগুলি ভেঙে কাজে লাগানোর প্রক্রিয়াকে লাভজনক করা অত্যন্ত জরুরি৷ পরিবেশের উপর তার প্রভাবও বড় দুশ্চিন্তার কারণ৷ শাতোরু বিমানবন্দর কর্মকর্তা মারত্যাঁ ফ্রেসিন বলেন, ‘‘বিমানের আয়ু শেষ হবার পর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি অতি সম্প্রতি শিল্পজগতের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে৷ তাই আমাদের আচরণবিধি ও সেরা সমাধানসূত্রগুলি স্থির করতে হবে৷ কড়া পরিবেশগত বিধিনিয়মের আওতায় যন্ত্রাংশ খুলে উপকরণ রিসাইক্লিং করতে হবে৷''
ক্ষতিকর তরল ও তেজস্ক্রিয় পদার্থ দূর করার পর বিমান টুকরো করার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে৷ এই পর্যায়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপকরণ চিহ্নিত করা অত্যন্ত জরুরি৷ তাই সুসংহতভাবে তার সন্ধান শুরু করতে হয়৷ ভালিয়ে এভিয়েশন কোম্পানির ওলিভিয়ে দিয়ো বলেন, ‘‘আমরা সব মূল্যবান যন্ত্রাংশ উদ্ধার করি৷ ল্যান্ডিং গিয়ার, ইঞ্জিন, এভিয়নিক্স, এয়ার কন্ডিশনিং ইত্যাদি৷ এ সব সেকেন্ডহ্যান্ড বাজারে বিক্রি করা যায়৷''
একটি বিমানে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত অ্যালুমিনিয়াম, ১৫ শতাংশ ইস্পাত এবং ১০ শতাংশ ‘প্রেশাস মেটাল' থাকে, যেমন টাইটানিয়াম৷ এই প্রক্রিয়ার কিছু অংশ কতটা লাভজনক, তা নিয়ে আলোচনা চলছে এবং অবশ্যই এর সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে৷
পরিবেশবান্ধব বিমান কেমন হবে?
বিমানে চড়ছেন মানেই আপনি পরিবেশের কিছুটা ক্ষতি করছেন৷ তাহলে কি বিমান ভ্রমণ ছেড়ে দেবেন! না, তবে সমাধান তখনই হবে যখন পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি ইলেকট্রিক বিমানগুলো পুরোদমে চালু হবে৷ কেমন হবে ভবিষ্যতের সেই বিমান? চলুন, দেখে আসি-
ছবি: Eviation
ছোট, হালকা এবং দূষণমু্ক্ত বিমান
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চলা বিমান কার্বন ডাই অক্সাইড এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন গ্যাস বা কণা– যেমন নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গমন করে না৷ এসব বিমান জীবাশ্ম জ্বালানিতে চলা বিমানের চেয়ে ছোট, হালকা এবং কার্যকরী হয়৷ ২০১৫ সাল থেকে স্লোভেনিয়ার স্টার্ট-আপ বিমান পরিবহন সংস্থা পিপিস্ট্রেল তাদের আলফা ইলেক্ট্রো মডেলের বিমান দিয়ে তা ইতিমধ্যে প্রমাণ করছে৷
ছবি: Pipistrel
ছোট বিমান নিয়ে নতুন আশা
বেশিরভাগ কোম্পানি আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইলেকট্রিক বিমান ব্যবহারের কথা ভাবছে৷ ইসরায়েলি স্টার্ট-আপ প্রতিষ্ঠান এভিয়েশন তাদের নয় আসন বিশিষ্ট ‘নাইন সিটার’ বিমান দিয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছে৷ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী তৈরি অ্যালিস বিমানটির প্রটোটাইপ ঘণ্টায় সাড়ে ছয়শ’ মাইল বা এক হাজার কিলোমিটার বেগে উড়তে পারে৷ প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০১৯ সাল নাগাদ তারা বাণিজ্যিকভাবে এই বিমান চালু করতে পারবে৷
ছবি: Eviation
সরাসরি ওঠানামা
জার্মান কোম্পানি লিলিয়ামের চালু করা ফ্লাইং ট্যাক্সি ২০১৭ সালের এপ্রিলে প্রথম সফলভাবে উড্ডয়ন করে৷ পাঁচ আসন বিশিষ্ট এই বিমানটি ওড়ার সময় রানওয়েতে না চলেই সরাসরি উড়তে পারে৷ আবার নামার সময় সরাসরি নামতে পারে৷ এটি ১৯০ মাইল যেতে পারে৷ লন্ডন থেকে প্যারিস যেতে এর এক ঘণ্টার বেশি সময় এর লাগে না৷
ছবি: Lilium
পুরনো এবং নতুনের মিশ্রণ
কিছু বিমান তৈরির প্রতিষ্ঠান প্রথমেই ইলেকট্রিক বিমান তৈরির দিকে না গিয়ে হাইব্রিড বিমান তৈরির কথা ভাবছে৷ ২০১৭ সালের নভেম্বরে এয়ারবাস, রোলস রয়েস এবং সিমেন্স বাণিজ্যিকভাবে হাইব্রিড-ইলেকট্রিক বিমান তৈরির ঘোষণা দেয় ৷ তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, তৈরি ই-ফ্যান এক্স মডেলের বিমানটিতে ৩টি গ্যাস টারবাইন এবং একটি ইলেকট্রিক মোটর থাকবে৷
ছবি: Airbus
পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা ইজিজেটের
ব্রিটেনের সাশ্রয়ী বিমান পরিবহন সংস্থা ইজিজেট আরও বেশি পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা করছে৷ অ্যামেরিকার স্টার্ট আপ কোম্পানি রাইট ইলেকট্রিকের সাথে সর্বোচ্চ ১৫০ যাত্রী বহন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিমান তৈরির ব্যাপারে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে৷ তবে এটি নিশ্চিত নয়, কবে নাগাদ ওই বিমানের একটি পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন দেখতে পাওয়া যাবে৷
ছবি: Wright Electric
বিদ্যুতায়িত ভবিষ্যৎ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইলেকট্রিক বিমানে ২০ বছরের মধ্যেই পুরোদমে চালু হয়ে যাবে৷ বেশ কিছু বিমান তৈরির সংস্থা ১৫০ থেকে সাড়ে ৬০০ মাইল যেতে সক্ষম৷ কিন্তু ইতিহাসের যে-কোনো সময়ের চেয়ে প্রযুক্তি এখন সবচেয়ে দ্রুত গতিতে ৷ কে জানে অদূর ভবিষ্যতেই হয়তো আমরা নবায়নযোগ্য শক্তিতে চলা বিমান দিয়ে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবো৷