নতুন প্রজন্মের নতুন সিলেবাস। রবীন্দ্রনাথের জায়গা নিলেন বাবা রামদেব। বিজেপির উত্তরপ্রদেশে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস নিয়ে বিতর্ক।
বিজ্ঞাপন
উত্তরপ্রদেশের স্কুলপাঠ্যে এতদিন ছিল রবীন্দ্রনাথের ছুটি গল্পটি। দশম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে পড়ানো হয় এনসিইআরটি-র বই। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় শিক্ষা ব্যবস্থার পাঠ্যসূচি। সেখানেই ইংরেজি পাঠ্যসূচিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছুটি গল্পটির ইংরেজি অনুবাদ ছিল-- 'দ্য হোম কামিং'। দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং শিক্ষাবিদ সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণণের নিবন্ধ 'দ্য উইমেনস এডুকেশন'ও ছিল সেখানে। কিন্তু ওই সমস্ত লেখায় আপত্তি আছে যোগী সরকারের। তাই সিলেবাস থেকে লেখাগুলি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
কেন ঘরবাড়ি ছাড়ছে উত্তর প্রদেশের মুসলমানরা?
কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ- এমতাবস্থায় ভারতের উত্তরপ্রদেশে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের আধিপত্য চরমে৷ তাদের নানাবিধ প্রভাবে ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেক মুসলিম জনগোষ্ঠী৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাড়িছাড়ার হিড়িক
ভারতের উত্তর প্রদেশের নয়াবান গ্রামে মোট ৪ হাজার মানুষের মধ্যে ৪০০ জন মুসলিম৷ গত দুই বছরে তাঁদের মধ্যে প্রায় এক ডজন ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন অন্যত্র৷ আরো অনেকে গ্রাম ছাড়ার পরিকল্পনা করলেও সামর্থের অভাবে পারছেন না বলে তাঁরা রয়টার্সকে জানিয়েছেন৷ এর মধ্যে গত বছরের শেষে গরু নিয়ে সহিংসতার ক্ষত এখনো তাদের মধ্যে গদগদে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
গরু নিয়ে সহিংসতার জের
গত নভেম্বরে নয়াবানে গরু জবাইয়ের অভিযোগে সহিংসতা জড়ায় হিন্দুরা৷ পুলিশ গরু জবাই বন্ধ করতে পারেনি, এমন অভিযোগে মহাসড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখায় তারা৷ সে সময় সংঘর্ষে এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুইজন নিহত হয়েছিলেন৷ এরপর ওই ঘটনায় মামলা হয়, বিনা অপরাধে জেল খেটেছেন অনেক মুসলিম৷ ওই সংঘর্ষের জের এখনো রয়েছে বলে মনে করছেন মুসলিমরা৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
মাইকে আজান দেয়া নিষেধ
২০১৭ সালে যোগী আদিত্যনাথ উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে সেখানকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে৷ পরের রমজানে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক একটি মসজিদে আজান দেওয়া বন্ধ করে দেয় কট্টরপন্থি হিন্দুরা৷ দীর্ঘ সময় ধরে চললেও আজান দেওয়া বন্ধ করে দিতে হয় মুসলিমদের৷ মুসলিম বাসিন্দা আয়েশা বলেন, ‘‘এখন এখানে আমরা ধর্মীয় বিষয় প্রকাশ করতে পারি না৷ তাঁরা (হিন্দুরা) যা ইচ্ছা তা করতে পারে৷’’
ছবি: Reuters/A. Abidi
হিন্দুরা যান না মুসলিম দোকানে
গরু জবাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৬ দিন জেল খেটেছেন ৩৮ বছর বয়সি শরফুদ্দিন সাইফি৷ যদিও পরে এর কোনো প্রমাণ পায়নি পুলিশ৷ এখন হিন্দুরা তাঁর কাপড়ের দোকান এড়িয়ে চলেন৷ বিক্রি কমা আর মামলার পেছনে টাকা খরচ হওয়ায় দোকানে মালামাল তুলতে পারছেন না সাইফি৷ ছেলেকে ভালো স্কুল থেকে সরিয়ে আনতে হয়েছে তাঁকে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘ওরা পুলিশ মারে, আমরা কোন ছাড়’
উত্তর প্রদেশের নয়াবান ছেড়ে দিল্লির নিকটবর্তী মাসুরিতে চলে গেছেন কাঠমিস্ত্রী জব্বার আলী৷ এক সময়ের এই সৌদি প্রবাসী সেখানে একটি বাড়ি কিনেছেন৷ তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘যদি হিন্দুরা অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পুলিশকে হত্যা করতে পারে, তাহলে আমরা মুসলিমরা কোন ছাড়?’’
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘এখন হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে খেলে না’
রাজধানী নতুন দিল্লিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চলেছেন ওই গ্রামের বাসিন্দা, ২২ বছর বয়সি জুনাইদ৷ আগে হিন্দু প্রতিবেশীদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কথা এখনো মনে পড়ে তাঁর৷ ‘‘আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন হিন্দু-মুসলিম একসঙ্গে খেলতাম- বিশেষ করে ক্রিকেট৷ আমি অনেক খেলেছি৷ কিন্তু গত একবছরে আমরা একসঙ্গে খেলিনি,’’ রয়টার্সকে বলেন জুনাইদ৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘সব শেষ করেছেন মোদী-যোগী’
হিন্দুত্ববাদের স্লোগান উচ্চকিত করে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন নরেন্দ্র মোদী৷ এরপর ২০১৭ সালে রাজ্যের ক্ষমতায় আসেন হিন্দু পুরোহিত যোগী আদিত্যনাথ৷ আগে সম্প্রীতি থাকলেও এখন তাঁদের প্রভাবে এলাকার সম্প্রীতি একেবারেই নষ্ট হয়েছে বলে মনে করছেন নয়াবানের মুসলিমরা৷ ‘‘মোদী আর যোগী সব শেষ করে দিয়েছে৷ তাঁদের প্রধান এজেন্ডাই হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি,’’ রয়টার্সকে বলেছেন নয়াবানের বাসিন্দা গুলফাম আলী৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
মোদীকে ভয়
লোকসভা নির্বাচনে এক্জিট পোলে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে ‘এগিয়ে’ নরেন্দ্র মোদী৷ বিজেপি আবার ক্ষমতায় আসলে পরিস্থিতি আরো বাজে হতে পারে বলে শঙ্কায় নয়াবানের মুসলিমরা৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
অস্বীকার করছে বিজেপি
ঘরবাড়ি ছাড়ার অভিযোগ মুসলিমরা করলেও কোনো ধরনের আধিপত্যের কথা অস্বীকার করেছে বিজেপি৷ দলের মুখপাত্র গোপাল কৃষ্ণ আগারওয়াল বলেন, ‘‘বিজেপির সময়ে কোনো দাঙ্গা হয়নি৷ অপরাধমূলক ঘটনার সঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের বিষয় মেলানোটা ভুল হবে৷’’ বিরোধী দলগুলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
‘যা-ই হোক, চলে যাব না’
অনেকের মনে এলাকা ছাড়ার প্রবণতা থাকলেও কোনো কোনো মুসলিম বলছেন লড়াই চালানোর কথা৷ তাঁদের মতো একজন ৪২ বছর বয়সি আয়াস মোহাম্মদ৷ নিকটবর্তী শহরে এই টাইলসের দোকানি রয়টার্সকে বলেন, ‘‘আমি লড়াই চালিয়ে যাব৷ আমি ভীত নই৷ তবে, মোদী আবার ক্ষমতায় আসলে অনেকের জন্য এখানে থাকা কঠিন হয়ে যাবে৷’’
ছবি: Reuters/A. Abidi
10 ছবি1 | 10
অন্যদিকে, উত্তরপ্রদেশ সরকারের সুপারিশ অনুযায়ী চৌধুরী চরণ সিং বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের পাঠ্যক্রমে ঢোকানো হয়েছে বাবা রামদেবের নিবন্ধ 'যোগ চিকিৎসা রহস্য'। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের 'হঠযোগ স্বরূপ'ও অবশ্যপাঠ্য করা হয়েছে।
এখানেই শেষ নয়, দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি বই থেকে বাদ পড়েছে আর কে নারায়ণের গল্প 'অ্যান অ্যাস্ট্রোলজার্স ডে'। মুকুল আনন্দের 'দ্য লস্ট চাইল্ড'ও বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাদ দেওয়া হয়েছে শেলির কবিতা। দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে সরোজিনী নায়ডুর কবিতা 'দ্য ভিলেজ সং'।
স্বাভাবিক ভাবেই উত্তরপ্রদেশের এই নতুন সিলেবাস নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কেন সরকার এই লেখাগুলি বাদ দিল, তা নিয়ে সরকারের তরফে কোনো কথা বলা হয়নি। বিরোধীরা সরব হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, লিবারাল লেখা বাদ দিয়ে হিন্দুত্ববাদী রচনা ঢোকানো হচ্ছে উত্তরপ্রদেশের সিলেবাসে। এটাই সত্যিকারের মগজধোলাই। ছাত্রছাত্রীরা ছোটবেলা থেকেই তৈরি হবে হিন্দুত্ববাদী চেতনা নিয়ে।