জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে ধর্ষককে পালাতে সহায়তার অভিযোগ
২ মার্চ ২০২৩
বান্দরবানের লামায় এক মারমা বিধবা নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে এক বাঙালি যুবকের বিরুদ্ধে৷ ধর্ষকের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হলেও তাকে এখনো গ্রেপ্তার করা হয়নি৷
বিজ্ঞাপন
গত শুক্রবার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের হারগাজাপাড়ায় এ ঘটনায় একজনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়; পাঁচ দিনেও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি৷
এর প্রতিবাদে এবং দোষী যুবককে গ্রেপ্তারের দাবিতে বুধবার সকালে শহরে মধ্যমপাড়া রাজারমাঠে ‘বান্দরবান জেলা সচেতন ছাত্র সমাজ ও উইমেনস অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম' বিক্ষোভ করেছে৷
একটি বিক্ষোভ মিছিল শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে শেষ হয় পরে সেখানে তারা মানবন্ধন করেন৷
মানববন্ধনে মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের জেলা কমিটির সভাপতি উহ্লাচিং মারমা, বান্দরবান সরকারি কলেজ শাখার সভাপতি থোয়াই অং মারমা, খিয়াং ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধি হিরো খিয়াং, তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়শেসেন প্রতিনিধি বিটন তঞ্চঙ্গ্যা ও ম্রো স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি তনয়া ম্রো বক্তব্য রাখেন৷
বক্তারা অভিযোগ করেন, ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরার পরও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাকে পালাতে সুযোগ করে দিয়েছিলেন৷ ঘটনার চারদিন পরও অপরাধাীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারেনি৷
তারা স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধিকেও তদন্তের আওতায় আনাসহ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তির দাবি জানান৷
মানববন্ধনে সংহতি বক্তব্যে আইনজীবী উবাথোয়াই মারমা বলেন, মামলার এজাহার এবং ভুক্তভোগী নারী ও এলাকাবাসীর বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় ঘটনার পরপরই ধর্ষককে নিজের হেফাজতে নিয়ে বিচারের নামে আসামিকে পালানোর সুযোগ করে দেয় কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি৷
‘‘এ কারণে সংরক্ষিত আসনে এক মহিলা মেম্বার ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না৷ এর আগেও পার্বত্য এলাকায় যত ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়েছে অপরাধীরা কোনো না কোনোভাবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যায়; যার ফলে পাহাড়ে দিন দিন ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে৷”
মানববন্ধনে আরও বক্তব্য দেন উইমেন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম-এর জেলা কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট মাধবী মারমা৷
গত শুক্রবার লামা ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের হারগাজাপাড়ার বাসিন্দা মো. কায়সারের (৩৫) বিরুদ্ধে এক বিধবা মারমা নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে৷
এ ঘটনায় শনিবার বিকালে ওই নারী বাদী হয়ে লামা থানায় মো. কায়সারকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলা করেন৷
মামলা এজাহারে উল্লেখ করা হয়, শুক্রবার দুপরের দিকে পাড়ার একটা চরে শাক তুলতে গেলে মো. কায়সার পেছন থেকে আক্রমণ করে মুখে গামছা চেপে ধরে৷ টেনে নিয়ে পাশে একাশি গাছের বাগানে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে৷ বাধা দিলে মুখে চর থাপ্পড় দিয়ে খুন করার হুমকি দেওয়া হয়৷ চিৎকার শুনে এলাকাবাসী এগিয়ে গেলে কায়সার পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটক ও মারধর করে জনতা৷
পরে খবর পেয়ে ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়ন পরিষদের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য মো. কায়সারকে সঙ্গে নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়৷ পরে চেয়ারম্যান কায়সার সুস্থ হলে ‘স্থানীয়ভাবে' বিচারের আশ্বাস দেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়৷
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ফাঁসিয়াখালী ইউপি চেয়ারম্যান ডয়চে ভেলের কনটেন্ট পার্টনার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘শুক্রবার বিকালে ভুক্তভোগীরা যখন আমার কাছে আসে তখন ধর্ষণের অভিযোগ দেওয়া হয়নি৷ ধর্ষণের অভিযোগ আসলে সাথে সাথে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে থানায় দিয়ে দিতাম৷”
ধর্ষণ: কিছু ঘটনা ও দায়বদ্ধতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় একাধিক ধর্ষণের খবর প্রকাশ হয়৷ কোনোটি আলোচিত হয়, কোনোটি আড়ালেই থেকে যায়৷ এই প্রবণতা কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণি, বয়সের গণ্ডিতে আটকে নেই৷ শিক্ষা, ধর্ম, আইন কোনো কিছুই মানছেন না ধর্ষকরা৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
ক্ষমতার দাপট
গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের এমসি কলেজে স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নারী ধর্ষণের শিকার হন৷ তাকে ধর্ষণ করেন কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী৷ ৪ অক্টোবর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়৷ এক মাস আগে ঘটলেও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার আগ পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
অনিরাপদ পরিবহণ
২০১৭ সালে টাঙ্গাইলে চলন্ত বাসে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক তরুণীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা আলোচিত হয়৷ তবে এর পরেও নারীদের জন্য গণপরিবহণ নিরাপদ হয়ে ওঠেনি৷ গত ২৬ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টার অভিযোগে এক বাসচালককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত বছর গণপরিবহণে ৫২টি ঘটনায় ৫৯ নারী ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
নিরাপত্তাহীন সড়ক
২০২০ সালের পাঁচ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ঢাকার কুর্মিটোলায় ধর্ষণের শিকার হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী৷ বাস থেকে নামার পরপরই তাকে সড়কের পাশে তুলে নিয়ে যায় ধর্ষক মজনু৷ খোদ রাজধানীর ব্যস্ত সড়কে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এই ঘটনায়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
শিশুরাও ধর্ষণের শিকার
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিন শিশু ধর্ষণের খবর উঠে আসছে৷ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) এর হিসাবে ২০২০ সালে ৬২৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে এই সংখ্যাটি ৯৭৪৷ এসব ঘটনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিবারের সদস্য বা স্বজনরাও জড়িত৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাদ নেই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান
সম্প্রতি চট্টগ্রামে এক মাদ্রাসা শিক্ষক গত দুই বছর প্রতিরাতে শিশু ছাত্রদের যৌন নিপীড়নে বাধ্য করতেন বলে স্বীকার করেছেন৷ নভেম্বরে কুমিল্লার এক মাদ্রাসায় ১১ বছরের ছাত্রকে জোরপূর্বক ধর্ষণের অভিযোগে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করে পুলিশ৷ গত ১২ মার্চ রাজধানীতে আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মসজিদের ইমাম গ্রেপ্তার হন৷ অক্টোবরে ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে এক মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দেড় হাজার নারী
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে ১,৫৪৬ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫১ জনকে, আত্মহত্যা করেছেন ১৪ জন৷ ২০১৯ সালে ১,৪১৩ জন নারী, ২০১৮ সালে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন৷ বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১,২৪৭টি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের তথ্য পেয়েছে৷ যদিও প্রকৃত ঘটনা এর চেয়েও বেশি বলে মনে করা হয়৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
রক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ সালে খুলনা রেলওয়ে থানায় এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে পুলিশের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে৷ একই বছর মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে৷ গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ধর্ষণের মামলায় পুলিশের এক উপপরিদর্শককে গ্রেপ্তার করা হয়৷ এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে অক্টোবরে রংপুরে পুলিশের এক এএসআইকে বরখাস্ত করা হয়৷
ছবি: Samir Kumar Dey/DW
বিচারহীনতা
২০১২ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ২৫টি ধর্ষণ মামলা নিয়ে পর্যালোচনা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেখানে তারা দেখেছে প্রতিটি মামলাতেই আসামি ১৫ দিনের মধ্যে জামিন পেয়েছে৷ তিন জন অভিযুক্ত কারাগারে রয়েছেন, দুই জন প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় রয়েছে, তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে অথচ তাদের গ্রেফতার করা যায়নি৷ গত ১৪ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই তথ্য জানিয়েছে৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
সমাধান বিয়ে!
ধর্ষণের পর সালিশ বা আদালতের মাধ্যমে সমাধান হিসেবে ধর্ষকের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর বিয়ে হয়৷ প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৪ নভেম্বর কুমিল্লার আদালতে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়েছে৷ ১৯ নভেম্বর ফেনী কারাগারে ধর্ষণ মামলার আসামির সঙ্গে ভুক্তভোগীর বিয়ে হয়৷ একইদিনে নাটোরেও এমন একটি ঘটনা ঘটে৷ ২২ অক্টোবর উচ্চ আদালতের নির্দেশে ধর্ষণের মামলায় যাবজ্জীবন আসামি ও ভুক্তভোগীর কারাফটকে বিয়ে হয়৷
ছবি: Sazzad Hossain/DW
দায় পোশাকের?
ধর্ষণের হাত থেকে শিশু, বৃদ্ধ নিস্তার পাচ্ছেন না কেউ৷ বাদ নেই স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই৷ তবুও এই প্রবণতার জন্য কেউ কেউ নারীর পোশাককে কটাক্ষ করেন৷ ধর্ষণের জন্য ‘অশালীন পোশাককে’ দায়ী করে এক ভিডিও বার্তা দিয়ে সমালোচিত হন চিত্রনায়ক অনন্ত জলিল৷ নভেম্বরে সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিলের আলোচনায় সংসদ সদস্য রেজাউল করিম বাবলু ধর্ষণের জন্য নারীদের পোশাককে দায়ী করে বক্তব্য দেন৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
10 ছবি1 | 10
তিনি বলেন, ভুক্তভোগী বলেছিল, তাকে গামছা দিয়ে মুখে চেপে ধরেছে, চর থাপ্পড় দিয়েছে৷ তখন অভিযুক্ত ব্যক্তিকেও পাড়াবাসীরা মারধর করার পর তিনিও মুর্মূষু অবস্থায় ছিল৷ এ কারণে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সুস্থ হওয়ার পর বিচার করার কথা বলা হয়েছিল৷
‘‘সুস্থ হওয়ার দুদিনের মধ্যে বিচারের মুখোমুখি করার শর্তে কায়সারকে তার বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল৷ পরে চকরিয়ার একটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার কথা শুনে পালিয়ে গেছে বলে শুনেছি৷”
ধর্ষক কায়সারকে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে জানান লামা থানা ওসি শহিদুল ইসলাম চৌধুরী৷