কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দৃশ্য অভিনয় করে দেখাল শিশুরা৷ প্রতিষ্ঠিত হল রাম মন্দির৷ ঘটনাটি ঘটেছে তামিলনাড়ুর একটি আরএসএস চালিত স্কুলে৷ যা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে নাগরিক সমাজে৷
বিজ্ঞাপন
বিশিষ্টজনদের একটা বড় অংশ বলছেন, দেশে হিন্দুত্ববাদের চাষ হচ্ছে৷ কী ভাবে হচ্ছে, তা দেখিয়ে দিল দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুর একটি স্কুল৷ সম্প্রতি স্কুলের এক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের নাটকে উঠে এসেছে বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির তৈরির দৃশ্য৷ যা আলোড়ন ফেলে দিয়েছে গোটা দেশে৷ ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা নিয়ে শিশুদের দিয়ে এমন নাটক করানোর পরে প্রশ্ন উঠেছে, যে মামলা এখনও আদালতে বিচারাধীন, তা নিয়ে এমন নাটক কি আদৌ করানো যায়? এ ভাবে শিশুদের মনে বিদ্বেষের বীজ পুঁতে দেওয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে নাগরিক সমাজ৷
তামিলনাড়ুর যে স্কুলে এই ঘটনা ঘটেছে, সেটির পরিচালক আরএসএস নেতা প্রভাকর ভাট৷ স্কুলের নাম শ্রী রাম বিদ্যাকেন্দ্র হাই স্কুল৷ রবিবার সেই স্কুলের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সদানন্দ গৌড়া এবং প্রাক্তন আইপিএস এবং রাজনীতিক কিরণ বেদি৷ এ ছাড়াও রাজ্যের আরও বেশ কয়েকজন বিজেপি নেতা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন৷ সেখানেই ১১ এবং ১২ ক্লাসের ছাত্ররা মঞ্চের উপর বাবরি মসজিদের পোস্টারের সামনে হাজির হয়৷ স্পিকারে বাজতে শুরু করে, 'হনুমান ভক্তরা হনুমানের শক্তি দিয়ে মসজিদ ভেঙে ফেলো৷'
মঞ্চ জুড়ে ধ্বনিত হয়, 'বলো শ্রী রামচন্দ্রের জয়৷' এরপরেই পোস্টারের মসজিদ নামিয়ে সেখানে রাম মন্দির স্থাপন করে ছাত্রছাত্রীরা৷ সোমবার থেকে সেই দৃশ্য সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ভাইরাল হয়ে যায়৷ নাগরিক সমাজে নিন্দা শুরু হয়৷
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গৌড়াকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ওই নাটক হওয়ার পরে তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন৷ কিরণ বেদি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে না চাইলেও পরে একটি টুইট করেন৷
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, যে আরএসএস নেতার স্কুল ঘিরে এই বিতর্ক শুরু হয়েছে, সেই প্রভাকর ভাটের বিরুদ্ধে বার বার সরব হতেন হিন্দুত্ববাদী আততায়ীদের হাতে খুন হওয়া বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ৷ একাধিকবার ভাটের দুটি স্কুলের বিরুদ্ধে লিখেছেন তিনি৷ বলার চেষ্টা করেছেন, কী ভাবে ওই স্কুলগুলিতে হিন্দুত্ববাদ এবং বিভেদের মন্ত্র ছোটদের মনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়৷ রবিবারের ঘটনায় গৌরী লঙ্কেশের বক্তব্যই স্পষ্ট হল বলে দাবি করছে নাগরিক সমাজ৷
যদিও শিশুদের দিয়ে এই অভিনয় করানোর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছেন না স্কুলের পরিচালক প্রভাকর ভাট৷ তাঁর বক্তব্য, ''জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা যদি নাটকে আসতে পারে, তাহলে বাবরির ঘটনা আসবে না কেন? আমি এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখছি না৷'' একই সঙ্গে বাবরি ধ্বংস নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে যে মামলা চলছে, তা নিয়েও বেশ কিছু আলটপকা মন্তব্য করেন তিনি৷
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷