চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলের খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রী দলের এক সদস্য জার্মানিতে সন্তানের বাবা-মায়েদের জন্য মাসিক একটা নির্দিষ্ট আয় নিশ্চিত করতে চান, তা সে বাবা-মায়ের নিজস্ব রোজগার যা-ই হোক না কেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বিজ্ঞাপন
প্রতি মাসে বাচ্চাদের বাবা-মা’কে একটা থোক টাকা দেওয়া হবে যার পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়নি৷ পরিমাণটা নির্ভর করবে বাচ্চাদের দেখাশোনার খরচ ও সেই সঙ্গে দম্পতির স্বাস্থ্য বিমার প্রিমিয়ামের উপর৷ ‘পরিবার চুক্তি’ হিসেবে এই থোক টাকাটা দেওয়া হবে বাচ্চার জন্ম থেকে তার প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া অবধি তা বাচ্চার বাবা-মা তাকে কিন্ডারগার্টেন অথবা ডে কেয়ার সেন্টারে পাঠান আর না-ই পাঠান৷
সিডিইউ বিধায়ক সিলভিয়া পান্টেল ও তাঁর দলের আর কিছু বিধায়ক মিলে এই ‘পরিবার চুক্তি’র উদ্যোগটি শুরু করেছেন৷ এই পন্থায় সন্তানদের কিন্ডারগার্টেন বা ডে কেয়ারে পাঠানো বা না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা পরিবারবর্গের হাতে থাকবে বলে তাঁদের ধারণা৷
শৈশব কি হারিয়ে যাচ্ছে?
ঢাকা-কলকাতার মধ্য বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুদের মধ্যে ক’জন আজকাল মাঠে-ময়দানে, জঙ্গলে খেলাচ্ছলে শৈশব উপভোগ করার সুযোগ পায়? জার্মানিতে শিশুদের ৬ বছরের আগে স্কুলে যাওয়া নিষেধ, অক্ষরজ্ঞান তখনই হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZB/P. Pleul
ফিরিয়ে দাও শৈশব
দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক নগরকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার মূলমন্ত্র হলো প্রতিযোগিতা৷ একেবারে ছোট বয়স থেকেই তাই চাপের শেষ নেই৷ পড়াশোনা, নাচগান, আঁকা, শরীরচর্চা, খেলাধুলা – সব কিছুতেই সেরা হয়ে ওঠার জন্য শিশুদের উপর চাপ দেওয়া হয়৷ এর পরিণাম কি ভালো হতে পারে?
ছবি: AP
সন্তান পালনে পেশাদারি সাহায্য
অন্য সব বিষয়ের মতো সন্তান পালনের ক্ষেত্রেও পুরানো অনেক ধ্যানধারণা আজ অচল হয়ে পড়েছে৷ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ধাত্রীরা জার্মানিতে বাবা-মায়েদের এই কাজে দক্ষ করে তোলার চেষ্টা করেন৷ দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের ভিত্তিতে তারা সন্তান পালন সংক্রান্ত নানা পরামর্শ দেন৷ স্বাস্থ্য বিমা সংস্থাই ধাত্রীর পারিশ্রমিক দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/U. Deck
বাবা-মা একটু সময় দিলে
জন্মের পর শিশুর জন্য বাবা-মায়ের স্পর্শ, তাদের আদর-ভালোবাসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু তাদের অত সময় আছে কি? জার্মানিতে নানা মডেলের আওতায় বাবা-মা প্রথম বছরে সন্তানের সঙ্গে অনেক সময় কাটানোর সুযোগ পান৷ রাষ্ট্র ও কর্মদাতা প্রতিষ্ঠান কর্মীদের জন্য সেই ব্যবস্থা করে দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পুঁথিগত শিক্ষার প্রস্তুতি
এক থেকে দুই বছর বয়সের মধ্যে জার্মানির শিশুরা সাধারণত কিন্ডারগার্টেনে যাবার সুযোগ পায়৷ কিন্তু সেখানে পুঁথিগত শিক্ষা নিষিদ্ধ৷ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মীদের কাছ থেকে খেলাচ্ছলে জীবনের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে নানারকম শিক্ষা পায় কচিকাচারা৷ স্কুলে যাবার আগে এই প্রস্তুতি তাদের খুব কাজে লাগে৷
ছবি: picture-alliance/ZB/P. Pleul
প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মবোধ
ঢাকা-কলকাতার মতো শহরের কংক্রিটের জঙ্গলে অনেক শিশু সহজে মাটির সংস্পর্শে আসতে পারে না৷ জার্মানিতে শিশুদের প্রকৃতির কোলে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়৷ এমনকি কিছু এলাকায় জঙ্গলের মধ্যেই কিন্ডারগার্টেন রয়েছে৷ গাছপালা ও নানা প্রাণীর সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হয় তাদের৷
ছবি: Jens Schlueter/ddp
স্কুলে যাওয়া বাধ্যতামূলক
সাধারণত ৬ বছর বয়সে স্কুলে যায় জার্মানির বাচ্চারা৷ তখনই পড়াশোনা শুরু হয়৷ প্রাথমিক স্কুলশিক্ষা বাধ্যতামূলক৷ স্কুলে আলাদা ইউনিফর্ম নেই৷ প্রথম দিনে কচিকাচাদের উপহারে ভরা এক বিশেষ ঠোঙা দেওয়ার রেওয়াজ আছে৷
ছবি: DW
পড়ার চাপ
স্কুলের পড়াশোনা স্কুলেই শেখানোর চেষ্টা করা হয়৷ বাড়িতে ফিরে কিছু হোমওয়ার্ক করলেই চলে৷ সাধারণত গৃহশিক্ষক বা কোচিং ক্লাসের প্রয়োজন পড়ে না৷ তবে কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা দূর করতে বাড়তি সাহায্যের ব্যবস্থা রয়েছে৷ শিক্ষা রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তের আওতায় পড়ে বলে জার্মানিতে অনেক সংস্কার আটকে আছে বলে নানা মহলে অভিযোগ ওঠে৷
ছবি: Imago/Jochen Tack
7 ছবি1 | 7
জার্মানিতে বাবা-মায়েরা বর্তমানে সন্তানের জন্মের পর ১৪ মাস ধরে ‘এল্টার্নগেল্ড’ বা ‘বাবা-মায়ের মাসোহারা’ পেতে পারেন৷ এই বাবা-মায়ের মাসোহারা নির্ভর করে সন্তানের জন্মের সময় অভিভাবকদের বুনিয়াদি আয়ের উপর৷ বাভেরিয়ায় বাবা-মায়েরা যদি সন্তানকে কোনো সরকারি কিন্ডারগার্টেনে না পাঠান, তাহলে সন্তান স্কুলে না যাওয়া পর্যন্ত মাসে ১৫০ ইউরো করে ‘বেট্রয়ুংসগেল্ড’ বা ‘তত্ত্বাবধানের টাকা’ পেতে পারেন৷
পাঁচ সন্তানের জননী
সিলভিয়া পান্টেল নিজে পাঁচটি সন্তান মানুষ করেছেন৷ তিনি বলেন, তাঁর পরিকল্পনার ফলে বাবা-মায়েদের উপর সন্তান প্রতিপালন করার সঙ্গে সঙ্গে অর্থোপার্জন করার দায় ও চাপ কমবে৷ পান্টেল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমি জানি, অনেকে আমাকে পাগল মনে করেন, কিন্তু আমরা কমবয়সি মহিলাদের কাছ থেকে বড় বেশি দাবি করছি; আমরা মানুষজনকে অসুস্থ করে তুলছি, আমাদের জন্য বহু পরিবার ভেঙে যাচ্ছে৷’’
ছাড়াছাড়ি মা-বাবার, ভোগান্তি সন্তানের
প্রযুক্তির সুবিধা বাড়ার সাথে বাড়ছে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা৷ বাড়ছে স্বামী-স্ত্রীর আলাদা থাকার প্রবণতাও৷ বিশেষজ্ঞদের মতে এসবের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সন্তানের মনোজগতে৷ ওর স্বাভাবিক বিকাশ হচ্ছে বাধাগ্রস্ত৷
ছবি: Getty Images/AFP/R. Beck
শিশুদের ভয় আর আতঙ্ক
সন্তানের কাছে মা-বাবার ছাড়াছাড়ি মেনে নেয়া অনেক কষ্টকর৷ বিশেষ করে সন্তানের বয়স যদি কম থাকে৷ এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, হঠাৎ করে একজনের সাথে, অর্থাৎ মা বা বাবার সাথে থাকতে হয় বলে শতকরা ৩৭ থেকে ৪৮ ভাগ শিশু-কিশোরের মনেই অন্যজনকে হারানোর ভয় থাকে৷
ছবি: goodluz - Fotolia
যে কষ্ট তারা বোঝাতে পারে না
যে কোনো সন্তানের কাছে মা-বাবাই তার সবচেয়ে কাছের, ভালোবাসার মানুষ৷ আর তাদের মধ্যেই যখন বোঝাপড়া না হয়, তখন শিশুরা হয়ে পড়ে অসহায়৷ যা থেকে অনেক শিশু বা কিশোর-কিশোরী প্রচণ্ড আঘাত পায় আর সেই আঘাতের ক্ষত হয়তো তাকে সারা জীবনই কষ্ট দেয়৷ এমনটাই মনে করেন মিউনিখের মনোচিকিৎসক বেনেডিক্ট ক্লাউকে৷
ছবি: Fotolia/Kitty
‘আমাকে কেউ ভালোবাসে না, আমি মূল্যহীন’
মা-বাবার ছাড়াছাড়ির মনোকষ্টের কথা শিশুরা সহজে বোঝাতে পারে না৷ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, পড়াশোনায় মনোযোগ না থাকা বা অকারণে হঠাৎ করে রেগে যাওয়া – এ সবের মধ্য দিয়েই শিশুদের কষ্টের প্রকাশ ঘটে৷ ওদের তখন মনে হয়, ‘‘আমার কেউ নেই৷ আমাকে কেউ ভালোবাসে না৷ আমি মূল্যহীন৷’’ ওরা ভাবে, ওদের যদি কেউ ভালোবাসে, তাহলে ভালোবাসার দু’জন মানুষের মধ্যে একজন তাকে ছেড়ে যাবে কেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
দীর্ঘস্থায়ী বিষণ্ণতা
ডিভোর্স বা ছাড়াছাড়ি যেমন মা-বাবার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, তেমনি সন্তানের জন্যও৷ সমীক্ষায় জানা গেছে, পরিবারকে নতুন পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে মা এবং বাবাকেই বড় ভূমিকা নিতে হবে৷ সন্তানের সাথে কথা বলার জন্য যে কোনো পরিস্থিতেই পিতা-মাতাকে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ তাছাড়া সন্তানের কাছে একে অপরকে দোষারোপ করাও উচিত নয়, কারণ, এই জটিল ব্যাপারে বাবা বা মায়ের পক্ষ নিতে গিয়ে সন্তানকে যেন বিচারকের ভূমিকা না নিতে হয়৷
মা-বাবা যা করবেন
যেসব দম্পতির ছাড়াছাড়ি হয়েছে তাঁদের প্রতি বেনেডিক্ট ক্লাউকের পরামর্শ, ‘‘সন্তান যার কাছেই থাকুক না কেন, ওকে এমন একটা অনুভূতি বা ধারণা দিন যেন ও মনে করে, আপনারা আলাদা থাকলেও ওকে দু’জনই সমান ভালোবাসেন, কারণ, শিশুর জন্য মানবিক সম্পর্কের জায়গাগুলো বেশ জটিল৷ তাই যতটা সম্ভব ওর সাথে সময় কাটান৷ ‘তোমাকে ভালোবাসি’ বলতে ভুলবেন না৷ জানিয়ে দিন, ওর যে কোনো সমস্যায় আপনারা ওর সাথে আছেন এবং থাকবেন৷’’
ছবি: picture-alliance/dpa
5 ছবি1 | 5
জার্মানি প্রতিবছর প্রায় ৫০০ কোটি ইউরো ‘এল্টার্নগেল্ড’ বা বাবা-মায়ের মাসোহারা হিসেবে দিয়ে থাকে৷ তাঁর প্রস্তাবিত পদ্ধতির ফলে এই খরচ বাড়বে না, বলে পান্টেল মনে করেন, বিশেষ করে যদি কিন্ডারগার্টেন ও অন্যান্য সন্তান প্রতিপালন সহায়ক কর্মসূচি চালানোর খরচকে এর মধ্যে ধরা যায়৷ পান্টেলের ভাষ্যে, ‘‘বর্তমানে আমাদের যা পন্থা, তা অনুযায়ী আমরা বাচ্চাদের খুব কম বয়সে কিন্ডারগার্টেনে পাঠিয়ে দিই ও সেখানে বহুদিন রাখি, যা'তে তাদের বাবা-মায়েরা চাকরি খুঁজে পান, ক্যারিয়ার বানান, ভালো পেনশন পাবার মতো রোজগার করেন৷ এবং বাচ্চা হলে তার সব ঝুঁকিই সাধারণত মায়েদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ে৷’’
জার্মানিতে জন্মের হার বিশ্বের সর্বনিম্নগুলির মধ্যে৷ জন্মহার বাড়ানোর যাবতীয় সরকারি প্রচেষ্টা মোটামুটি ব্যর্থ হয়েছে, যদিও আপাতত অভিবাসীদের কারণে জন্মহার কিছুটা বেড়েছে৷ ‘‘তরুণ, শিক্ষিত মহিলাদের আপাতত বলা হচ্ছে, শ্রমবাজারে তোমার শিক্ষার মূল্য অনেক, কাজেই তোমার কাজ করা উচিৎ৷ কিন্তু আমরা যদি চাই যে, আমাদের জনসংখ্যা ঠিকমতো বাড়ুক, তাহলে আমাদের সেই সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে - ভালোভাবে, শুধু সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে (কিন্ডারগার্টেন বা ডে কেয়ারে) ছেড়ে দিয়ে এসে নয়৷’’