বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা কমছে না৷ গত বছর সারাদেশে ২৬৫ জন শিশু হত্যার শিকার হয়৷ এদের মধ্যে ৬৪ জন নিহত হয় নিজ বাবা-মায়ের হাতে৷ বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার ও শিশু অধিকার বিশেষজ্ঞরা৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা যায়৷ মঙ্গলবার প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘‘গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৫৮৯টি শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৪১টি শিশু অপমৃত্যু এবং ৬৮৬টি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৫ হাজার ২১২টি শিশু বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিল৷ ২০১৬ সালে সংখ্যার দিক দিয়ে শিশু নির্যাতন কমেছে শকতরা ৩১ দশমিক ১৪ শতাংশ৷
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছর ৩৬টি শিশু হত্যার মামলার রায়, ২৫টি শিশু ধর্ষণ মামলার রায়, তিনটি শিশু অপহরণ মামলার রায় এবং একটি শিশুর ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ ঘটনার রায় হয়েছে৷ এ সব সহিংসতার দু-তিনটি ছাড়া বাকি সব ঘটনা ঘটেছিল ২০১০-২০১৪ সালে অথবা তারও আগে৷
এমরানুল হক
মঙ্গলবার প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান রিয়াজুল হক বাবা-মায়ের হাতে সন্তান নিহতের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন৷ তিনি বলেন, ‘‘দেশে ২০১৫ সালের চেয়ে ২০১৬ সালে শিশু হত্যা কমেছে৷ অথচ বাবা-মায়ের হাতে শিশু নিহতের ঘটনা বেড়েছে৷ এটা আশঙ্কাজনক৷''
তিনি বলেন, ‘‘মানবাধিকার কমিশন শিশু নির্যাতন কমাতে সভা-সেমিনারের আয়োজন করে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে৷ সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে গণমাধ্যমের ভূমিকা রয়েছে৷''
শিশু অধিকার ফোরামের চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘বাবা-মায়ের হাতে নিজেদের শিশু সন্তান হত্যার প্রধান কারণ পারিবারিক কলহ, অর্থনেতিক দুরবস্থা এবং অনৈতিক সম্পর্ক৷ আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নেতিবাচক দিক এখানে প্রভাব ফেলছে৷ শিশু হত্যাকে বাবা-মা প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিচ্ছে কখনো৷ আবার কখনো মনে করছে নিজে কষ্ট পাবে না, আবার সন্তনকেও কষ্ট থেকে মুক্তি দেবে৷ তাই তাদের হত্যা করে পরে নিজেরা আত্মহত্যা করে৷ এই ভয়ংকর মানসিক অবস্থা শিশুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে৷''
তিনি জানান, ‘‘পরিবারের বাইরে শিশু হত্যার কারণ জমিজমা নিয়ে বিরোধ, শত্রুতা, অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়, বিকৃত মানসিকতা, ধর্ষণ প্রভৃতি৷''
শিশুকে মারলে সে অংকে খারাপ করে
ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে শিশুকে মারধর করলে কিংবা তাকে মানসিকভাবে শাস্তি দিলে পরবর্তীতে সেটা তার লেখাপড়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷
ছবি: picture alliance/dpa
শারীরিক শাস্তি
ইউনিসেফ-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ২ থেকে ১৪ বছর বয়সি প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ছয়জনকে নিয়মিতভাবে শারীরিক শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়৷ শিশুদের যাঁরা দেখাশোনা করেন তাঁরাই এই শাস্তি দিয়ে থাকেন৷ শারীরিক শাস্তি বলতে ইউনিসেফ বুঝিয়েছে এমন শাস্তি যেটা দিলে শিশু শরীরে ব্যথা কিংবা অস্বস্তি অনুভব করে৷ এমন শাস্তির মধ্যে রয়েছে শিশুর হাত, পা, মুখ, মাথা, কান কিংবা নিতম্ব ধরে ঝাঁকানো বা মার দেয়া৷
ছবি: Fotolia/Firma V
মানসিক শাস্তি
কোনো অপরাধের প্রেক্ষিতে শিশুর সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলা, তার কাছ থেকে কোনো সুযোগ কেড়ে নেয়া যেন শিশুটি মানসিকভাবে কষ্ট পায় ইত্যাদিকে মানসিক শাস্তি হিসেবে মনে করে ইউনিসেফ৷ তাদের গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৮০ শতাংশ শিশুকে বোঝানো হয়েছে যে, তারা (শিশু) যেটা করেছে সেটা ঠিক নয়৷ ৭০ শতাংশের ক্ষেত্রে চিৎকার করে সেটা করা হয়েছে৷ এছাড়া ৪৮ শতাংশের ক্ষেত্রে শিশুদের কিছু সুবিধা কেড়ে নেয়া হয়েছে৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
সবচেয়ে বেশি ইয়েমেনে
বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে অভাগা বলতে হবে এই দেশের শিশুদের৷ কেননা সেখাকার প্রায় ৯৫ জন শিশুকেই তাদের অপরাধের জন্য শারীরিক ও মানসিক শাস্তি পেতে হয়৷ অভাগাদের তালিকায় এরপর ক্রমান্বয়ে আছে ঘানা, টিউনিশিয়া, টোগো, ক্যামেরুন ও ফিলিস্তিনের শিশুরা৷ এই গবেষণা সম্পর্কে আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture alliance/dpa/P. Pleul
বাংলাদেশ বিষয়ক তথ্য
ইউনিসেফ-এর সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে ১ থেকে ১৪ বছর বয়সি শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশকে মারধর করেন মা-বাবাসহ অভিভাবকেরা৷ আর ৭৪.৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়৷ শৃঙ্খলা বলতে শিশুদের পড়াশোনায় মনোযোগী করাসহ অভিভাবকদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজকে বোঝানো হয়েছে৷ এছাড়া প্রতি তিনজন মায়ের মধ্যে একজন বিশ্বাস করেন, নিয়মকানুন শেখাতে সন্তানদের শাস্তি দেয়া প্রয়োজন৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
অংক স্কোর কম করে!
শিশুদের উপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির প্রভাব নিয়ে আরেকটি গবেষণা করেছে ইউনিসেফ৷ তাতে দেখা গেছে, ৮ বছর বয়সে যেসব শিশু এ ধরণের শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে তারা ১২ বছর বয়সে গিয়ে স্কুলে অংকে খারাপ স্কোর করেছে৷ শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তাদের অনীহা দেখা গেছে৷ শিশুকে শাস্তি দেয়ার এটি একটি নেতিবাচক প্রভাব বলে উল্লেখ করেছে ইউনিসেফ৷ আরও জানতে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture alliance/dpa
ইউনিসেফ-এর উদ্যোগ
শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেয়া নিষিদ্ধ করতে জাতিসংঘের এই সংস্থাটির ‘কনভেনশন অন দ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড’ রয়েছে৷ এখন পর্যন্ত ১৪০টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে৷ তবে এর মাধ্যমে বিশ্বের মাত্র ৮ শতাংশ শিশুকে শারীরিক শাস্তির হাত থেকে রক্ষা করা গেছে বলে জানিয়েছেন ইউনিসেফ এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেল রুটস্টাইন৷ ১৯৮৯ সালে গৃহীত এই কনভেনশনে ১৯৯০ সালে সই করে বাংলাদেশ৷
ছবি: picture alliance/ANP/R. Koole
6 ছবি1 | 6
মায়ের হাতে সন্তান হত্যার উদাহরণ হিসেবে গত ১১ জানুয়ারি রাজধানীর দিয়াবাড়িতে মা তার এক সন্তানকে পাশে বসিয়ে রেখে অন্য সন্তানকে হত্যা করে৷ পরে নিজেও আত্মহত্যা করে সেই মা৷ এক্ষেত্রে দারিদ্র্যকে দায়ী করে এমরানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘‘শিশু হত্যার পেছনে দারিদ্র্য অনেকখানি দায়ী৷ আমাদের তাই সবার আগে দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হবে, শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে সচেতন করতে হবে৷''
তিনি বলেন, ‘‘শিশুরা সবচেয়ে দুর্বল, তাই তারাই সবার আগে সহিংসতার শিকার হয়৷ আমাদের সমাজ ও মানসিকতা শিশুবান্ধব নয়৷ আইন আছে, কিন্তু তার কার্যকর প্রয়োগ নেই৷ তাই ব্যাপক গণসচেতনতা ও মানসিকতার পরিবর্তন আনা না গেলে শিশুর প্রতি সহিংসতা কমবে না৷''
এছাড়া শিশুর প্রতি সহিংসতার তেমন বিচার হয় না৷ এখানে বিচারহীনতার এক স্থায়ী সংস্কৃতি লক্ষ্য করা যায়৷ পরিসংখ্যান বলছে, শিশুর প্রতি এক বছরে সহিংসতার যে ঘটনা ঘটে তার শতকরা পাঁচ ভাগেরও বিচার হয় না৷ তাই এমরানুল হক চৌধুরীর কথায়, ‘‘এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর করতে হবে৷''
যৌন হয়রানির হাত থেকে কীভাবে বাঁচাবেন শিশুকে
শিশুরা বিকৃতকাম মানুষের সহজ শিকার৷ সারল্যের সুযোগ নিয়ে সহজে ভোলানো যায় তাদের৷ অনেক সময় শিশুরা বুঝতে পারে না, চিনতে পারে না পিশাচের থাবা৷ আর বুঝলেও করতে পারে না প্রতিবাদ, প্রতিরোধ৷ শুধু একটা অস্বস্তি থেকে যায় সারাটা জীবন৷
ছবি: picture alliance/abaca
ভয়াবহ অবস্থা ভারতে
ভারতের জাতীয় ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের অর্ধেকেরও বেশি বাচ্চা যৌন নিগ্রহের শিকার৷ তবে সবচেয়ে ভয়ংকর সত্য হলো, নাবালিকা বা শিশুর ওপর যৌন হেনস্থার ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটছে পরিবারের মধ্যে, পরিবারেরই কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত সদস্যের হাতে৷ তাই সে সব ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছাচ্ছে না, হচ্ছে না কোনো ডাইরি অথবা মামলা৷
ছবি: Fotolia/Gina Sanders
হারিয়ে যাচ্ছে শৈশব
এভাবে প্রতিদিন বিকৃত যৌন নির্যাতনে হারিয়ে যাচ্ছে অগুন্তি শৈশব৷ অনেকক্ষেত্রেই শিশুরা বুঝে উঠতে পারছে না, বলে উঠতে পারছে না তাদের অমানবিক সেই সব অভিজ্ঞতার কথা৷ তাই শিশুদের প্রতি যৌনাসক্ত, বিকৃত মানুষগুলো থেকে যাচ্ছে লোকচক্ষুর আড়ালে৷ সমাজবিদরা বলছেন, এ জন্য আগাম সতর্কতার দায়িত্ব নিতে হবে অভিভাবক এবং স্কুলের৷ শিশুকে দিতে হবে তার প্রাপ্য শৈশব৷
ছবি: Fotolia/Kitty
যেভাবে বোঝাবেন বাচ্চাদের
সহজ ভাষায় খেলা বা গল্পচ্ছলে শিশুদের এ বিষয়ে একটা ধারণা গড়ে তোলা যেত পারে৷ বাচ্চাদের বলতে হবে যে, তাদের শরীরটা শুধুমাত্র তাদের৷ অর্থাৎ কেউ যেন তাদের ‘গোপন’ জায়গায় হাত না দেয়৷ তাই কোনো আত্মীয় বা পরিচিত ব্যক্তির আচরণ অস্বস্তিকর ঠেকলে, কেউ তাদের জোর ঘরে কোনো ঘরে নিয়ে গেলে, খেলার ছলে চুমু দিলে বা শরীরের কোথাও হাত দিলে – তা যেন মা-বাবাকে জানায় তারা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিনিয়ে দিন যৌনাঙ্গ
অনেক বাবা-মা নিজ সন্তানের সঙ্গে যৌনাঙ্গ নিয়ে কথা বলতে কুণ্ঠা বোধ করেন৷ কিন্তু এই লজ্জা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং খুব ছোটবেলাতেই ছবি এঁকে অথবা গল্পে-গানে বাচ্চাকে তার শরীরের অন্য সব অঙ্গের মতো যৌনাঙ্গ, লিঙ্গ ইত্যাদি চিনিয়ে দিতে হবে৷ এমনটা করলে কেউ যদি তাদের সঙ্গে পিশাচের মতো ব্যবহার করে, তাহলে শিশুরা সহজেই বলতে পারবে কে, কখন, কোথায় হাত দিয়েছিল৷
ছবি: DW/S.Rahman
শিশুর কথা শুনুন, তার পক্ষ নিন
শিশু যাতে আপনাকে বিশ্বাস করতে পারে, বন্ধুর মতো সবকিছু খুলে বলতে পারে – সেটা নিশ্চিত করুন৷ আপনার বাচ্চা যদি পরিবারের কাউকে বা আপনার কোনো বন্ধুকে হঠাৎ করে এড়িয়ে যেতে শুরু করে অথবা আপনাকে খুলে বলে বিকৃত সেই মানুষের কৃতকর্মের কথা, তবে সময় নষ্ট না করে শিশুটির পক্ষ নিন আর তিরস্কার করে বাড়ি থেকে বার করে দিন ঐ ‘অসুস্থ’ লোকটাকে৷
ছবি: Fotolia/pegbes
স্কুলেরও দায়িত্ব আছে
বাচ্চারা দিনের অনেকটা সময় স্কুলে কাটায়৷ তাই যৌন শিক্ষার ক্ষেত্রে স্কুলের একটা বড় দায়িত্ব থেকে যায়৷ তবে স্কুলের মধ্যে, বিদ্যালয় চত্বরেও ঘটতে পারে শিশু নির্যাতনের ঘটনা৷ তাই স্কুল থেকে ফেরার পর বাচ্চা যদি অতিরিক্ত চুপচাপ থাকে, একা একা সময় কাটায় বা পড়াশোনা করতে না চায়, তাহলে ওর সঙ্গে কথা বলুন৷ জানতে চান কী হয়েছে, প্রয়োজনে স্কুল কর্তৃপক্ষকেও জানান৷
ছবি: picture-alliance/blickwinkel
ছেলে-মেয়ে সমান!
আমাদের সমাজে ছোট থেকেই মেয়েদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়৷ মেয়ে হলেই হাতে একটা পুতুল আর ছেলে হলে ধরিয়ে দেয়া হয় বল বা খেলনার পিস্তল৷ ছেলের পাতে যখন তুলে দেয়া হয় মাছের বড় টুকরোটা, তখন মেয়েটির হয়ত এক গ্লাস দুধও জোটে না৷ এ বৈষম্য বন্ধ করুন৷ বাবা-মায়ের চোখে ছেলে-মেয়ে সমান – সেভাবেই বড় করুন তাদের৷ তা না হলে নারীর ক্ষমতায়ন হবে কীভাবে? কীভাবে কমবে শিশু নির্যাতন?
ছবি: picture alliance/abaca
7 ছবি1 | 7
বন্পধু, আপনার কি কিছু বলার আছে? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷