হেফাজতে ইসলাম নতুন করে আরো চাপের মুখে পড়ছে৷ সাবেক হেফাজত নেতারা দাবি করছেন ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে রাতে অবস্থানের দায় মাওলানা জুনাইদ বাবুনগরীর৷ তার আশা ছিলো অবস্থান নিলে সেনাবাহিনী নেমে আসবে৷
বিজ্ঞাপন
আর হেফাজতের সাবেক আামির মাওলানা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর প্রায় তিন মাস পর হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে৷
আহমদ শফী মারা যান গত ১৮ সেপ্টেম্বর৷ চট্টগ্রামের আদালতে দায়ের করা ওই মামলায় হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়ার হুমকিদাতা মাওলানা মামুনুল হকসহ ৩৬ জনকে আসামি করা হয়েছে৷ মামলাটি দায়ের করেছেন মাওলানা আহমদ শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মাঈনুদ্দিন৷ আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে৷ তার ছেলেরা মামলা না করে শ্যালক হয়ে কেন মামলা করলেন এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আল্লামা শফীর পুত্ররা হুমকির মুখে আছেন৷ তারা মামলা করতে যেতে পারছেন না৷ এ কারণেই তিনি মামলা করেছেন৷ আর মৃত্যুর পর মামলা না করে তিন মাস পরে কেন মামলা করা হলো তার জবাবে তিনি বলেন, তখনো তারা হুমকির কারণে মামলা করতে পারেননি৷ এমনকি মাওলানা শাহ আহমদ শফীর এক ছেলে আনাস মাদানীকে তার পিতার জানাজাও পড়তে দেয়া হয়নি৷ তিনি অভিযোগ করেন, ‘‘তিন দিন ধরে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হামলা ও ভাঙচুর চালিয়ে কৌশলে আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়৷'' তিনি এজাহারে অভিযোগ করেছেন, এটা একটি পরিকল্পিত হত্যা৷ আহমদ শফী ওই হামলার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাকে হাসপাতালে নিতে বাধা দেয়৷ অ্যাম্বুলেন্স ফিরিয়ে দেয়া হয়৷ হাসপাতালে নেয়ার পথে তার অক্সিজেন মাস্ক খুলে এবং মানসিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷’’
আহমদ শফীর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে
এর জবাবে মামলার আসামি হেফাজত নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেন, ‘‘মাওলানা আহমদ শফীর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই হয়েছে৷ তার মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে মোহাম্মদ ইউসুফ এবং মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ যে বিবৃতি দিয়েছে তাতে স্বাভাবিক মৃত্যুর কথাই বলা হয়েছে৷ আর আমি তো এই ঘটনার পুরোটা সময়ই ঢাকায় ছিলাম৷ ‘‘তিনি দাবি করেন, ‘‘মাওলানা আহমদ শফী বেঁচে থাকতে যারা তার ইমেজকে ব্যবহার করে নানা সুবিধা নিয়েছে তারাই এখন আমাদের প্রতিপক্ষ মনে করে এসব মিথ্যা মামলা করছে৷’’
এদিকে চট্টগ্রামে বুধবার শাহ আহমদ শফীর ওপর এক আলোচনা সভায় হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব সলিমুল্লাহ দাবি করেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের ঘটনার দায় বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর৷ তিনি তখন হেফাজতের মহাসচিব ছিলেন৷ শাপলা চত্বরে রাতে অবস্থানের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না৷ রাতে থাকলে সেনাবাহিনী নামবে বলে তিনি একক সিদ্ধান্তে রাতে অবস্থানের নিদেশ দেন৷ সাবেক হেফাজত নেতা সলিমুল্লাহ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘আমি নিজে যা দেখেছি তাই বলেছি৷ তিনি কী উদ্দেশ্যে এটা করেছেন৷ কাদের সাথে যোগাযোগ করেছেন তা তিনিই ভাল বলতে পারবেন৷’’
বাবুনগরী বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন
তিনি বলেন, ‘‘মাওলানা আহমদ শফী ও মাওলানা কাসেমী বলেছিলেন সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সমাবেশ শেষ করে যে যার মত চলে যাবেন৷ কাসেমী এবং মুফতি ওয়াক্কাস তাকে বার বার সমাবেশ শেষ করার জন্য বলছিলেন৷ কিন্তু বাবুনগরী বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করছিলেন৷ আর বলছিলেন অবস্থান করলে রাতে সেনাবাহিনী নামবে৷ এটা তিনি বার বার বলছিলেন৷ এরপর তিনি মাওলানা শফীকে না জানিয়ে রাতে অবস্থানের সিন্ধান্ত ঘোষণা করেন৷ তার কারণেই এত হতাহতের ঘটনা ঘটে৷’’
এই বিষয়ে চেষ্টা করেও জুনাইদ বাবুনগরীর বক্তব্য পাওয়া যায়নি৷ তবে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী দাবি করেন, ‘‘সলিমুল্লাহ সাহেবের এই বক্তব্য সম্পূর্ণ মিথ্যা৷ আমারও তখন দায়িত্বে ছিলাম৷ আমরা তো জানি না৷ উনি জানলেন কীভাবে?’’
তিনি আরো দাবি করেন, ‘‘এটা বাবুনগরী সাহেবের ইমেজ ক্ষুন্ন করা এবং মূর্তি ও ভাস্কর্যবিরোধী আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ষড়যন্ত্র৷ একটি মহলের মদতে তিনি এসব করছেন৷'' তিনি আহমদ শফীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলাকেও মিথ্যা অভিহিত করে দাবী করেন, ‘‘যাদের আসামি করা হয়েছে তারা সবাই নির্দোষ৷’’
তার কথা, এসব করে মূর্তির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান থেকে সরানো যাবে না৷ এটা তাদের ঈমানী দায়িত্ব৷
ভাস্কর্য: শিক্ষক ও পড়ুয়ারা যা বলছেন
ভাস্কর্য, না মূর্তি- এই বিতর্ক নিয়ে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে৷
ছবি: Privat
শিল্প এবং ধর্ম এখন সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক নাসিমা হক বলেন, শিল্পসাহিত্য বিকাশের এই যুগে ভাস্কর্য এবং মূর্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই৷ ভাস্কর্য অথবা অন্যান্য যে-কোনো শিল্প নিছকই একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতির মাধ্যম, যা একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ শিল্পকে এখন আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই৷
ছবি: Privat
উদ্দেশ্যটাই মুখ্য
ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ বলেন, ‘‘সবই আসলে ভাস্কর্য৷ পার্থক্যের বিষয়টি চলে আসে সেটি কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে৷ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য, তিনি আমাদের দেশের জন্য আইকনিক একজন ব্যক্তিত্ব৷ সুতরাং তাঁর ভাস্কর্যকে ধর্মীয়ভাবে দেখার সুযোগ আদৌ আছে বলে আমি মনে করি না৷’’
ছবি: Privat
এ বিতর্ক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসিমুল খবির বলেন, ‘‘ভাস্কর্য বা মূর্তির বিষয়টি বহু আগে থেকেই সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি ধর্মীয়ভাবে মীমাংসিত৷ এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতেও ভাস্কর্য আছে৷ সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি বাংলাদেশে এখন যে ঘটনাটি ঘটছে, সেটি একধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পায়তারা ছাড়া কিছুই নয়৷’’
ছবি: Privat
সংজ্ঞাগত পার্থক্য সামান্য
ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী মৃৎমন্দির গুঞ্জন কুমার বলেন, ‘‘কে কীভাবে ভাস্কর্যটিকে উপস্থাপন করছে, সেটিই মুখ্য বিষয়৷ মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মাঝে দ্বান্দ্বিক কোনো পার্থক্য নেই৷ অনেক ভাস্কর্য আছে যেটি মূর্তি নয়৷ আসলে মূর্তি যখন অনুভূতি বা নান্দনিকতার জন্য তৈরি হয় তখন তা ভাস্কর্য হয়ে ওঠে৷’’
ছবি: Privat
শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন
তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন লামিয়া নোশিন নকশি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘চারুকলার একজন ছাত্রী হিসেবে আমার মাথায় প্রথমেই যা আসে সেটা হচ্ছে শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট এবং অর্থের ভিন্নতা৷ ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিছু ক্ষেত্রে মূর্তি নির্মিত হয়ে থাকলেও ভাস্কর্যের ব্যাপারটি পুরোপুরি শৈল্পিক৷’’
ছবি: Privat
ভাস্কর্যে নান্দনিকতা থাকে
তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সৌম্যক সাহা ধ্রুব বলেন, ‘‘মূর্তি এমন এক ত্রিমাত্রিক গঠন, যা কোনো কিছুকে মূর্ত করে, এটি বিমূর্ত নয়৷ পাশাপাশি মূর্তি যখন উপাসনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, তখন তাঁকে প্রতিমা বলা হয়৷ মূর্তি বা প্রতিমা ভাস্কর্যেরই প্রকারভেদ৷ ভাস্কর্যে মূলত নান্দনিকতাটাই প্রাধান্য পায়৷’’
ছবি: Privat
ভাস্কর্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে
ভাস্কর্য বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী পল্লব সমাদ্দার বলেন, ‘‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজন ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ভাস্কর্য তৈরি করে আসছে৷ ভাস্কর্য এবং মূর্তির মাঝে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও আমার মনে হয় দুটি বিষয় শেষ পর্যন্ত একই সুতোয় গাঁথা৷’’
ছবি: Privat
যাহা পানি, তাহাই জল
চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী তাহসিনা ফেরদৌস রিনিয়ার মতে, কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে ভাস্কর্য নাকি মূর্তি এ নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্ব থাকলেও এই ধারণার ভিত্তি বা গোড়া কিন্তু একই৷ তিনি ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্যের কথা এভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘সকল মূর্তিই ভাস্কর্য, কিন্তু সকল ভাস্কর্য মূর্তি না৷’’
ছবি: Privat
অমিল আছে, কিন্তু দ্বন্দ্বপূর্ণ নয়
চারুকলার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাবিলা তাবাসসুম বলেন, ‘‘মূর্তি অবধারিতভাবে মানুষ বা প্রাণীর আকৃতি হলেও ভাস্কর্যে প্রাণী বা কাল্পনিক ধারণা ফুটে উঠতে পারে৷ ভাস্কর্য দৃশ্যমান শিল্পের একটি শাখা, যা তৈরি করার পদ্ধতি মূর্তি থেকে ভিন্ন৷ ভাস্কর্যে শিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকবে এবং এর আকার যে-কোনো প্রকারের হতে পারে৷’’