বাভেরিয়ার জঙ্গলে বনবিড়ালের খোঁজে বিজ্ঞানীরা কি-ই বা না করছেন! বনবিড়ালদের জিপিএস কলার পরানো থেকে শুরু করে বিমান থেকে গোটা জঙ্গল স্ক্যান করা, সব ধরনের হাই-টেক ব্যবহার করা হচ্ছে৷
ছবি: Imago/Nature Picture Library
বিজ্ঞাপন
ঘন জঙ্গল আর নির্জন উপত্যকা৷ বাভেরিয়ার অরণ্য জার্মানিতে মুক্ত, বন্য প্রকৃতির শেষ আশ্রয়গুলির মধ্যে অন্যতম৷ মাত্র এক হাজার বছর আগে এখানে মানুষের বসবাস শুরু হয়৷ আজ পর্যন্ত বিরল প্রাণীরা এখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পায়৷
লিনক্স নামের বনবিড়ালটি তাদের অন্যতম, যদিও লিনক্সরা আড়ালে থাকতেই ভালোবাসে – কাজেই তাদের ছবি তোলা দুরূহ কাজ৷ পাঁচ'শ বছর আগে লিনক্সরা ইউরোপের সব বনেজঙ্গলে ছড়িয়ে ছিল৷ শিকার আর মানুষের নিত্যনতুন বসতির কারণে এই বনবিড়ালটি জার্মানি থেকে পুরোপুরি উধাও হয়৷ মাত্র বছর বিশেক আগে লিনক্সরা পূর্ব ইউরোপ থেকে আবার জার্মানিতে আসতে শুরু করে, ফলে আজ জার্মানিতে নতুন করে লিনক্সদের দেখা যাচ্ছে৷ জার্মানির বনেজঙ্গলে লিনক্সদের সংখ্যা কতো আর তারা কীভাবে থাকে, তা নিয়ে গবেষণা চলেছে৷
বন বাঁচাতে বনবিড়াল
বাভেরিয়ার অরণ্য হলো মধ্য ইউরোপের বৃহত্তম বনাঞ্চল৷ লিনক্স নামের শিকারি জীবটি এখানে তৃণভোজীদের সংখ্যা সীমিত রাখতে সাহায্য করে৷ লিনক্সরা হরিণ শিকার করে, ফলে হরিণের দল গাছের কচি চারা খেয়ে ফেলে জঙ্গলের ক্ষতি করতে পারে না৷ শিকার আর শিকারিদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে জঙ্গল নিশ্চিহ্ন হবে – যে কারণে রেঞ্জারদের লিনক্স – এবং হরিণদের সংখ্যা সঠিকভাবে যাচাই করতে হবে; দেখতে হবে, বনবিড়ালরা যথেষ্ট পরিমাণে হরিণ শিকার করছে কিনা, নাকি মানুষ শিকারিদের আরো কিছু হরিণ শিকার করা প্রয়োজন৷ লিনক্সদের ওপর নজর রাখার জন্য যে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার নাম স্পাই-টেক: বনবিড়ালের গলায় জিপিএস কলার বেঁধে দিলেই হল৷
ছবি: Imago/Nature Picture Library
জিপিএস-এর তথ্য অনুযায়ী গভীর জঙ্গলেও লিনক্সদের চলাফেরার হদিশ রাখা সম্ভব৷ বন্যপশু জীববিজ্ঞানী মার্কো হয়রিশ জানালেন, ‘‘কলারে যে ট্রান্সমিটার আছে, তা জিপিএস অনুযায়ী লিনক্সটির অবস্থান এসএমএস-এর মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেয়৷ এ থেকে আমরা জন্তুটির চলাফেরা, সে কোথায় থাকে বা না থাকে, কী খায় বা না খায়, এ সব তথ্য জানতে পারি৷'' কলারের ট্রান্সমিটার থেকে পাঠানো ডিজিটাল তথ্য থেকে দেখা গেছে যে, লিনক্সটি প্রায় প্যারিসের মতো একটা বড় এলাকা জুড়ে শিকার করে থাকে৷
শুধু বনবিড়ালদেরই নয়, হরিণদের গলাতেও ট্রান্সমিটার ঝোলানো আছে, যাতে আন্দাজ করা যায়, শিকার আর শিকারির ঠিক কোথায় মোলাকাত হয় আর তাতে বনবিড়ালের পেট ভরে কিনা! কোনো হরিণের গলায় বাঁধা জিপিএস ট্রান্সমিটার যদি বার-বার একই জায়গা থেকে সংকেত পাঠাতে থাকে, তবে তার অর্থ: লিনক্সের শিকার সফল হয়েছে৷ দিক-নির্দেশনার অ্যান্টেনা আর জিপিএস নিয়ে অকুস্থলে দৌড়লেন রেঞ্জাররা৷
শিকার ও শিকারি
মৃত হরিণটিকে খুঁজে পেতেও বেশি সময় লাগল না৷ মার্কো হয়রিশ পরীক্ষা করে দেখে বললেন, ‘‘বেশ একটু ফুলে উঠেছে৷ বেশ কিছুক্ষণ ধরে এখানে পড়ে রয়েছে বোধহয়৷'' কী ঘটেছে, তার চিহ্ন সর্বত্র৷ একটি লিনক্স হরিণটিকে মেরেছে, কিন্তু খাবার সময় সম্ভবত কোনো ব্যাঘাত ঘটে থাকবে৷ বনবিড়ালটি খুব সম্ভবত আবার শিকারের কাছে ফিরবে৷ ঠিক সেই মুহূর্তটিকে ধরে রাখার জন্য গবেষকরা আরেকটি প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছেন৷ ইনফ্রা-রেড সেন্সর লাগানো ক্যামেরাটি অন্ধকারেও সামান্যতম নড়াচড়া ঘটলেই শাটার টিপে দেয়৷
ছবি: fotolia/magann
গবেষকরা যতক্ষণ কাছাকাছি আছেন, ততক্ষণ লিনক্স শিকারের ধারে-কাছেও আসবে না৷ বনবিড়ালদের ইন্দ্রিয় মানুষের চেয়ে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ; ওরা অনেক বেশি ভালো দেখে ও শোনে৷ কিন্তু গভীর জঙ্গলেও লিনক্সরা ক্যামেরা ট্র্যাপে ধরা পড়ে৷ এছাড়া গবেষকরা প্রতিটি লিনক্সকে শনাক্ত করতে সক্ষম৷ মার্কো হয়রিশ বললেন, ‘‘লিনক্সদের ক্ষেত্রে সুবিধে হলো এই যে, ওদের চামড়ায় একটা বিশেষ নকশা থাকে৷ একটা লিনক্সের দু'পাশ থেকে তোলা ছবি থাকলে, তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে শনাক্ত করা যায়, বলা চলে: এটা ঠিক ঐ বনবিড়াল!''
জঙ্গল ‘স্ক্যান'
লিনক্সকে নিয়ে সব মাতামাতি সত্ত্বেও জঙ্গলের অন্য বাসিন্দাদেরও ভুললে চলবে না৷ লিনক্সটির শিকারের পরিধির পূর্ণচিত্র পাবার জন্য বিমান থেকে গোটা জঙ্গল ‘স্ক্যান' করে দেখা হয়৷ মানুষের চোখ যেখানে শুধু গাছের চূড়া দেখে, থার্মোসেন্সিটিভ ক্যামেরা সেখানে মাটিতে উষ্ণরক্তের জীবদের উপস্থিতির সন্ধান করতে পারে৷ এভাবে এখানে যে সব জীবজন্তুর বাস, তাদের সংখ্যা আন্দাজ করা চলে৷
স্পাই-টেক নামের প্রযুক্তির ফলেই লিনক্সের মতো একটি সাবধানী পশুর হদিশ পাওয়া ও হদিশ রাখা সম্ভব হয়েছে৷ দেখা যাক, ভবিষ্যতে প্রযুক্তি আমাদের আর কী দেখায় ও শেখায়৷
জার্মানির চিড়িয়াখানার ইতিহাস
প্রতি বছর কোটি কোটি মানুষ জার্মানির চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে৷ একজন দর্শনার্থী চিড়িয়াখানায় গিয়ে এখন যা দেখেন, তা এ রকম ছিল না৷ সময়ে সময়ে বদলেছে ধরণ, সমৃদ্ধ হয়েছে কালে কালে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
জার্মানির প্রথম চিড়িয়াখানা
প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক মার্টিন হিনরিশ লিশটেনস্টাইন লন্ডনে জুলোজিক্যাল গার্ডেন দেখে এ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ এরপর তাঁর মধ্যে এ বিষয়ে কিছু একটা করার ইচ্ছা জাগে৷ ১৮৪১ সালে প্রুশিয়ার রাজা চতুর্থ ফ্রিডরিশ ভিলহেল্মকে রাজি করান৷ রাজা এক ডিক্রির মাধ্যমে বার্লিনের টিয়ারগার্টেনে ৫৪ একর জমি বরাদ্দ দেন৷ সেখানেই গড়ে ওঠে জার্মানির প্রথম জুলোজিক্যাল গার্ডেন৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
প্রথম প্রাণী
১৮৪৫ সালের মধ্যে দু’টি কোয়াটি, তিনটি সুমেরুর শিয়াল, একটি লাল শিয়াল, দু’টি ব্যাজার, ২৪টি বানর এবং তিনটি সাইবেরিয়ার ভাল্লুক এখানেআনা হয়৷ ১৮৪৬ সালে সিংহ এবং বাঘকে পৃথক ভবনে নিয়ে আসা হয়৷ ১৮৫৭ সালে প্রথম হাতি আনা হয়৷ ১৮৬১ সালে আনা হয় প্রথম জেবরা৷ তবে তখন প্রাণীর মৃত্যুর হার ছিল অত্যন্ত বেশি৷
ছবি: picture alliance/dpa/arkivi
রোল মডেলের ভূমিকায় ভিয়েনা
ভিয়েনার শ্যোনব্রুন চিড়িয়াখানা ছিল একেবারে অন্য রকম৷এ জগতে নানা সংযোজনে তাদের অবদান রয়েছে৷ ১৯০৬ সালে এখানে প্রথম হাতির বাচ্চা জন্মগ্রহণ করে৷ ৭২৭ প্রজাতির ৩৫শ’ প্রাণী নিয়ে ১৯১৪ সালে এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম চিড়িয়াখানায় পরিণত হয়৷ এটা বার্লিনের চিড়িয়াখানার রোল মডেল হয়ে দাঁড়ায়৷ এটি বিদ্যমান সবচেয়ে পুরাতন চিড়িয়াখানাগুলোর একটি৷ বলা হয়ে থাকে, ইউরোপের মধ্যে এই চিড়িয়াখানাতেই সবচেয়ে বেশি দর্শনার্থী যায়৷
ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান ভাষাভাষী দেশগুলোতে বহু চিড়িয়াখানা গড়ে ওঠে৷ তবে এসব চিড়িয়াখানার পূর্বসুরী হিসাবে রয়েল পার্কের কথাই বলা হয়৷ এটাও প্রুশিয়ার রাজপরিবার গড়ে তুলেছে৷ সেখানে রাজা কেবল শিকারই করতেন না, বরং এখানে প্রকৃতি গবেষকদের বসবাস করার অনুমতি দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P.Pleul
ভবন সংরক্ষণ এবং প্রাণী সুরক্ষা
বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে অবস্থিত অ্যান্টিলোপ হাউজের মতো অনেক ভবনই ঊনিশ শতকে নির্মাণ করা হয়৷ এর মাধ্যমে এখানে প্রাণীদের জন্য একটা ভিন্ন আবহ আনার চেষ্টা করা হয়৷ কিন্তু এটা যতটা না নান্দনিক করা হয়েছে, নির্মাণের সময় সংশ্লিষ্ট প্রজাতির প্রাণীদের সুবিধার কথা ততটা ভাবা হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/dpaweb/B. Setnik
শিক্ষা
২০ শতকে এসে জার্মানি জুড়ে অনেক চিড়িয়াখানা হয়৷ মানকি পার্ক, ওশান পার্ক, বার্ড পার্ক প্রভৃতি ক্রেজ জেঁকে বসে৷ এমনকি মানুষ সাফারি পার্কের মাঝে নিজেদের গাড়ি বা বাস নিয়ে যাওয়ারও সুযোগ পায়৷ ৫০ ও ৬০-এর দশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট শহরগুলোও চিড়িয়াখানা বা প্রাণী পার্ক গড়ে তোলে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Leonhardt
গতির ঝড়
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানিতে চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটা উন্মাদনা দেখা দেয়৷ দূর দূর ভূখণ্ডের প্রাণী দেখতে মানুষ আকুল হয়ে উঠে৷ একটা সময়ে এসব চিড়িয়াখানা জীবন্ত ক্লাসরুমে পরিণত হয়৷ কিন্তু প্রাণীদের রাখার ক্ষেত্রে তাদের উপযোগী করে পরিবেশ তৈরির বিষয়টি তখনও অগ্রাধিকারে ছিল না৷ ৭০-এর দশকের পর প্রাণী-মনস্তত্ত্ব নিয়ে নতুন নতুন দিক বের হয়ে আসে৷ তখন চিড়িয়াখানাগুলো তাদের ডিজাইন বদলাতে শুরু করে৷
ছবি: picture alliance/blickwinkel/K. Hennig
প্রকৃতিতে ফিরে আসা
চিড়িয়াখানা ডিজাইনে বিস্তৃত পরিসর রাখার বিষয়টি পুরো ব্যাপারটাই বদলে দেয়৷ যেমনটা হয়েছিল হামবুর্গের কার্ল হাগেনবেকে৷ সিংহ বাস করত জিরাফ, হাতি এবং জেব্রার কাছাকাছি৷ চিড়িয়াখানায় অঞ্চলভেদেও বিভক্তি ছিল৷ যেমন, চিড়িয়াখানার আফ্রিকা অঞ্চল৷ ছবিতে উঠে আসা কোলন চিড়িয়াখানার গ্রিনজোনের সব প্রাণী, যারা তাদের নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকতে পারে৷
ছবি: DW/Nelioubin
ভবিষ্যতের চিড়িয়াখানা
চিড়িয়াখানার ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করবে দক্ষ ব্যবস্থাপনার উপর৷ কিছু কিছু চিড়িয়াখানা কিছু প্রাণী রাখা বন্ধ করে দিচ্ছে৷ যেমন, ফ্রাঙ্কফুট চিড়িয়াখানা তাদের হাতির ঘর বন্ধ করে দিচ্ছে৷ শহরের মাঝখানে ২৭ একর জমি নিয়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানা প্রাণীদের পর্যাপ্ত জায়গা দিতে পারছে না৷
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Zinken
আসছে পান্ডা
চড়ার জন্য গাছ, কৃত্রিম নদী, পছন্দসই গাছ– এ সবই করা হচ্ছে চীনের দুই পান্ডা জিয়াও কুয়িং (ছবিতে) এবং মেং মেং-এর জন্য৷ আগামী ২৪ জুন বিমানের প্রথম শ্রেণির আসনে চড়ে তারা আসছে জার্মানিতে৷ তারা আসার পর বার্লিন জুলোজিক্যাল গার্ডেনে চালু করা হবে পান্ডাপ্লাজা৷ দুই পান্ডার জন্য এত সব আয়োজনই বলে দিচ্ছে, চিড়িয়াখানায় এসব প্রাণীর জীবন পাল্টে গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
চিড়িয়াখানা গবেষণা
চিড়িয়াখানার নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম হচ্ছে, যাদেরকে তাদের নিজস্ব পরিবেশে ছেড়ে দেয়া হবে৷ পরিবেশ সংরক্ষণেও তারা কাজ করছে এবং প্রাণীর প্রাকৃতিক বাসস্থান সম্পর্কে দর্শনার্থীদের জানাচ্ছে৷ কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, বিভিন্ন প্রাণীর কিছু কিছু প্রজাতিকে কেবল চিড়িয়াখানায় বাঁচিয়ে রাখা অনৈতিক৷ অবিকৃত প্রাকৃতিক বাসস্থান দেয়া লক্ষ্য হওয়া উচিত৷
জার্মানিতে খেলাধুলার চেয়ে চিড়িয়াখানায় বেশি দর্শনার্থী যায়৷ মানুষ বিনোদনের জন্য এই দিকে বেশি ঝুঁকছে৷ সম্প্রতি কোলন চিড়িয়াখানায় একটা ছোট্ট খামার উদ্বোধন করা হয়েছে৷ সেখানে দর্শনার্থীরা গরু ও ছাগলের যত্ন নিতে পারবেন৷ চিড়িয়াখানা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, কোনো কিছুই এর স্থলাভিসিক্ত হতে পারে না৷ এটা কেবল প্রাণীকে মানুষের সঙ্গে যুক্ত করতেই ভূমিকা রাখছে না৷ বরং বহু বিপন্ন প্রাণীর সংরক্ষণেও কাজ করছে৷